দুর্ঘটনায় মৃত এ রাজ্যের চার শ্রমিক। অজিত মাহাতো, গণেশ রাজোয়াড়, মিলন বাদ্যকার, চন্দন রাজোয়াড়। ছবি: এএফপি।
মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেঘোরে প্রাণ গেল আরও অন্তত ৩৩ জন পরিযায়ী শ্রমিকের। লকডাউনের পরে বাড়ি ফিরতে গিয়ে যাঁদের মৃত্যুর খবর এখন প্রায় রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজ লখনউ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে ঔরৈয়ায় পথ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন ৪ বাঙালি-সহ অন্তত ২৫ জন পরিযায়ী শ্রমিক। দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকে ধাক্কা মারে একটি ট্রেলার। দু’টিতেই ছিলেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। পশ্চিমবঙ্গের মৃত শ্রমিকেরা পুরুলিয়ার বাসিন্দা। তাঁদের নাম, মিলন বাদ্যকর (২১), চন্দন রাজোয়াড় (২৮), অজিত মাহাতো (৪০) এবং গণেশ রাজোয়াড় (২০)। আহত প্রায় ৪০ জন। এ ছাড়া, আজই মধ্যপ্রদেশের সাগর, গুনা ও বড়ওয়ানী জেলায় তিনটি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন ৪ মহিলা-সহ ৮ জন পরিযায়ী শ্রমিক।
উত্তরপ্রদেশের দুর্ঘটনাটি ঘটে ভোর সাড়ে ৩টে নাগাদ। দিল্লি থেকে একটি ট্রাকে চেপে মধ্যপ্রদেশের ছতরপুরে যাচ্ছিলেন ৫ মহিলা-সহ ২২ জন পরিযায়ী শ্রমিক। ৭টি শিশুও ছিল। ১৯ নম্বর জাতীয় সড়কের ঔরৈয়া-কানপুর দেহাত অংশে একটি ধাবায় ট্রাক থামিয়ে চা খেতে নামেন কয়েক জন। আর তখনই ট্রাকে ধাক্কা মারে রাজস্থান থেকে আসা ট্রেলারটি। তাতে ৪৩ জন শ্রমিক ছিলেন।
আরও পড়ুন: লকডাউনের চতুর্থ দফায় বিমান চালুর চিন্তা, নজরে গণপরিবহণ
দু’টি গাড়িতে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের শ্রমিকেরা ছিলেন। জেলাশাসক অভিষেক সিংহ জানান, ট্রেলারটিতে বোঝাই করা ছিল ওয়াল-পুট্টির বস্তা। শ্রমিকেরা বস্তার উপরেই বসেছিলেন। সংঘর্ষের পরে ট্রাক ও ট্রেলারটি উল্টে নিচু জমিতে পড়ে। শ্রমিকেরা অনেকেই ওই বস্তার নীচে পিষে যান। মৃতদের মধ্যে কোনও মহিলা নেই। ১৪ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
মৃত মিলন বাদ্যকর ও চন্দন রাজোয়াড়ের বাড়ি পুরুলিয়া মফস্সল থানার দুমদুমি গ্রামে। অজিত মাহাতোর বাড়ি কোটশিলা থানার উপরবাটরি গ্রামে। জয়পুর থানার ঝালমামড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন গণেশ রাজোয়াড়। মিলন, চন্দন এবং অজিত রাজস্থানে মার্বেল কারখানায় কাজ করতেন। ওই রাজ্যেরই অন্য কারখানায় কাজ করতেন গণেশ।
আরও পড়ুন: ‘বিমানে যেন শুধু যাত্রীরাই ওঠেন, প্যাথোজেন নয়!’
দুমদুমির দাসপাড়ার মিলন ২০১৮ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। রাজোয়াড়পাড়ার চন্দন পুরুলিয়ার জেকে কলেজে কলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। পড়া ছেড়ে ঝাড়খণ্ডের এক দালালের মারফত দু’জনেই পুজোর আগে রাজস্থানের জয়পুরে একটি মার্বেল কারখানায় যোগ দেন। মিলনের দাদা দেবাশিস ওই কারখানারই কর্মী। জানুয়ারিতে ছুটি নিয়ে তিনি গ্রামে ফিরেছিলেন। পরে ফেরার কথা ছিল মিলনের। দেবাশিস জানান, লকডাউন নিয়ে চিন্তায় ছিলেন মিলন। তাই ঝাড়খণ্ডের কয়েক জন শ্রমিকের সঙ্গে বাড়ি রওনা হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘ঘরে অভাব বলেই বাইরে কাজ করতে গিয়েছিল ভাই। প্রাণটাই চলে গেল!’’ দেবাশিসদের থেকেই খবর পান চন্দনের পরিজনেরা। চন্দনের বাবা ভিক্ষাকর রাজোয়াড় এবং দাদা আদিত্য রাজোয়াড় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। ভাই দিনমজুর। চন্দনই বাড়ির মধ্যে প্রথম কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। আদিত্য বলেন, ‘‘বাড়িতে অভাব। তাই কাজটা পেয়ে পড়া ছেড়ে ভাই চলে গিয়েছিল।’’ বৃহস্পতিবার শেষ ফোনে চন্দন বলেছিলেন, ‘‘লকডাউন আরও বাড়তে পারে। বাড়ি ফিরব বলে বেরিয়েছি। দিল্লি যেতে পারলে একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।’’
ঘরে ফেরেননি...
দুর্ঘটনায় মৃত্যু
• ৮ মে মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে রেলের ধাক্কা: ১৬
• ১৪ মে মধ্যপ্রদেশের গুনার সড়কে: ৮
• ১৪ মে বিহারের সমস্তিপুর সড়কে: ২
• ১৪ মে উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরে: ৬
• ১৬ মে উত্তরপ্রদেশের ঔরৈয়া সড়কে: ২৫
• ১৬ মে মধ্যপ্রদেশে ৩টি সড়ক দুর্ঘটনায়: ৮
অজিতের তিন মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। মেজো মেয়ের বিয়ের কথা চলছে। বছর বারোর ছোট মেয়ে এবং বছর দশেকের ছেলে স্কুলপড়ুয়া। স্ত্রী ঊর্মিলা মাহাতো জানান, যখন যা কাজ পেতেন, তা-ই করতেন অজিত। জানুয়ারির শেষে রাজস্থানে যান। ঊর্মিলা বলেন, ‘‘কোথায় কাজ করতেন জানি না। শুধু বলেছিলেন, রাজস্থানে পাথর কারখানায় পাকা কাজ পেয়েছি।’’ অজিতও বৃহস্পতিবার সকালে শেষ বার ফোনে স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘‘বাড়ি যাব বলে বেরিয়েছি। আপাতত হাঁটছি। ফোন কোরো না। দরকার হলে আমি ফোন করব।’’ গণেশের বাবা তারাপদ রাজোয়াড় ইটভাটার শ্রমিক। ভাই কার্তিক রাঁচীতে শ্রমিকের কাজ করেন। গণেশ সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। মাস সাতেক আগে কারখানার কাজ পেয়ে রাজস্থানের জয়পুরে যান।
চার শ্রমিকের বাড়িতে গিয়ে রাজ্য সরকারের তরফে দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণের কথা জানান পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়। দেহ আনার ব্যাপারে সাহায্যের আশ্বাস দেন তিনি। নবান্নে স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ও ওই ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইটারে শোকপ্রকাশ করেন।
শোকপ্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। স্থানীয় দুই পুলিশ অফিসারকে সাসপেন্ড করেছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। টুইটারে প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা জানান, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ১০০০টি বাস চালাতে চেয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে চিঠি লিখেছেন তিনি। বাসের খরচ কংগ্রেসই দেবে।