প্রতীকী চিত্র।
এত দিন পুরোটাই ছিল আশঙ্কা। সেই আশঙ্কা যে অমূলক নয়, এ বার তা নানান সমীক্ষা এক এক করে প্রমাণ করে চলেছে। আর তাদের এক জোট করে সাজিয়ে দেখলে ভবিষ্যতের যে ছবিটা দাঁড়াচ্ছে তাতে হাড় হিম না-হলেই অবাক হওয়ার অবকাশ থাকবে।
তবে একই সঙ্গে এটাও বলে নেওয়া ভাল যে এই ছবিটা যাকে বলে নিকট ভবিষ্যতের। এর থেকে কতটা, কবে এবং কী ভাবে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে তা কিন্তু এখনই বলা দুষ্কর। এই মুহূর্তের যে ছবিটা আমরা পাচ্ছি তা হল কোভিডের প্রত্যক্ষ আঘাত। এর পরে কিন্তু প্রস্তুত থাকতে হবে পরোক্ষ অভিঘাতের। বাজারের উপর এর চাপ ফুটে উঠছে কাজ যাওয়ার সংখ্যায়। পরবর্তীতে কিন্তু পরোক্ষ আঘাতে বেকারের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা একই ভাবে অমূলক নয়।
যেমন, গতকাল প্রকাশিত সেন্টার ফর মনিটরিং ইকনমি বা সিএমআইই-র সমীক্ষা। এই সমীক্ষা বলছে— গত মার্চ মাসে কোভিড সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করার দিন কয়েকের মধ্যে এ দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ৮.৭ শতাংশ। ২০১৬ সালের পরে এটাই ছিল সর্বোচ্চ। মার্চ মাসটা ছিল বাজার জুড়ে কোভিডের প্রথম ছোবলে নীল হওয়ার শুরুর মাস। আর ৫ এপ্রিলের মধ্যে এটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩.৪ শতাংশে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে কাজের বাজার থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে ৯০ লক্ষ কর্মীকে। আর কারণ সেই করোনাই। এই হিসাব কাজের বাজারের সবাইকে ধরে। এই সমীক্ষা আরও বলছে— দেশের কাজের বাজারে ৫২ শতাংশ স্বনিযুক্ত আর ২৩ শতাংশ দিন-আনি-দিন খাই শ্রেণির। আর এঁরাই কিন্তু অতিমারির কারণে ঘোষিত লকডাউনের সবথেকে বড় ও সহজ প্রাথমিক শিকার। কারণ, লকডাউনের কারণে বাজারের সঙ্গে এঁদের যোগাযোগই ছিন্ন হয়েছে সব থেকে প্রথমে।
কিন্তু গল্পটা এখানেই শেষ নয়। অসংগঠিত শিল্পের কর্মীরা যে প্রাথমিক বলি হবেনই সেটা তো আমরা প্রথম থেকেই জানতাম। লকডাউন হলে পর্যটনের মতো প্রায় প্রতিটি পরিষেবা শিল্প থেকে নির্মাণ শিল্পের মতো ক্ষেত্রে কাজ বন্ধ মানেই কর্মীদের আয় বন্ধ। তাই এরাই প্রাথমিক বলি।
লকডাউন উঠলে অবশ্যই বাজারের চাকা ঘুরতে শুরু করবে। কিন্তু তা কি কাজ হারানোর এই প্রবণতা আটকাতে পারবে? সংশয়ের জায়গা তৈরি হয়েছে বণিক সভা সিআইআই-এর একটি সমীক্ষা থেকে। সদস্য সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের মধ্যে লকডাউনের অভিঘাত নিয়ে সিআইআই এই সমীক্ষাটি করে। তাতে দেখা যাচ্ছে ৫২ শতাংশ শীর্ষকর্তা মনে করছেন লকডাউন উঠে যাওয়ার পরে সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংকোচন শুরু হবে। কতটা? ৪৭ শতাংশ মনে করছেন ১৫ শতাংশের মতো। আর ৩২ শতাংশ কর্তার মতে এই অঙ্কটা অন্তত ১৫ শতাংশ তো হবেই, বেড়ে ৩০ শতাংশ হলেও তাঁরা অবাক হবেন না।
অর্থাৎ? বাজার তো খুলবেই। আজ হোক বা কাল। কিন্তু ট্যাঁকে টাকা থাকবে তো থলি ভরার? আর এখানেই শুরু পরোক্ষ প্রভাবের। খেতে সব্জি শুকিয়ে যাচ্ছে। মান্ডিতে নিয়ে যাওয়ার লোক নেই। এখন যাঁদের আয় নেই তাঁদের সঞ্চয় কত দিন টিকবে? এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যার উপর করোনার ছোবল পড়েনি। কতটা তা বুঝতে বণিক সভা ফিকি-র সমীক্ষার একটা তথ্যেই চোখ দেওয়া যাক।
ফিকি বলছে— আমাদের দেশের হিরে রফতানির ৩৬ শতাংশই যায় চিনে। আর চিন আমদানির দরজা বন্ধ করেছে আগেই। ২০ মার্চ প্রকাশিত এই সমীক্ষা বলছে— এর ফলে এক জয়পুর শহরেই এই ক্ষেত্রে ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়াবে আট থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। মৎস রফতানিতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো।
মার্চ মাসে এই সমীক্ষা চালানোর সময়েও বিশ্বের সব দেশ নিজেদের দরজা বন্ধ করেনি। দেশের বাজারে এক চিনে রফতানি বন্ধ হওয়ার চাপই ছিল এতটা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে করোনার সংক্রমণ যত ছড়াচ্ছে, ক্ষতির হিসাব তাল মিলিয়ে বাড়ছে। এবং করোনার ছোবল গোটানোর পরেও তার বিষ কিন্তু বাজারে থাকবেই!
একটা তথ্যের উপর চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক পরের অধ্যায়ের আশঙ্কার কারণটা বুঝতে। এই মুহূর্তে আমাদের ব্যাঙ্কগুলির দেওয়া মোট ঋণের ২৮ শতাংশের মতো গিয়েছে গাড়ি, মোটর সাইকেল বা বাড়ির মতো ব্যক্তিগত ঋণ খাতে। এই হারে আয় কমলে ঋণ খেলাপির সংখ্যা বাড়বে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮ সালের ঋণ খেলাপির কারণে বিশ্বজুড়ে মন্দার ছায়া পড়েছিল। এই ঋণ যে ভাবে দেওয়া হয়েছিল তার সঙ্গে আমাদের দেশের ব্যক্তিগত ঋণ দেওয়ার পদ্ধতির মধ্যে ফারাক আছে। আমাদের দেশে কোনও না কোনও সম্পদ বন্ধক রেখে যে ভাবে ঋণ দেওয়া হয়, তাতে নাকি ঋণ খেলাপির বিপর্যয় ওই মাত্রা কখনই নেবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে না তো?
আরও পড়ুন: লকডাউনের সময়সীমা বাড়বে, সর্বদলীয় বৈঠকে ইঙ্গিত মোদীর
আর এই প্রশ্ন থেকেই শুরু পরোক্ষ সূত্রে কাজ হারানোর অঙ্ক। আমরা সবাই জানি, ব্যাঙ্কগুলোর কী হাল হয়েছে বড় সংস্থাগুলির ঋণ খেলাপির কারণে। আর তার পর থেকেই, সরকার যাই বলুন না কেন, ছোট ব্যবসার পক্ষে ঋণ পাওয়া আগের থেকেও কঠিন হয়ে উঠেছে। আজ যাঁদের আয় বন্ধ হয়েছে তাঁদের অনেকেই ঋণ নিয়ে বাড়ি-গাড়ি করেছেন। তাঁরা তাঁদের ঋণ শোধ করবেন কী করে? ঋণের খেলাপ তো শুরু হবেই। আর ব্যাঙ্কগুলিও মুঠি শক্ত করবে।
লকডাউন উঠলে ছোট সংস্থাগুলির ফের ঝাঁপ খুলতে টাকা লাগবে। কিন্তু ব্যাঙ্কগুলি নগদের চাপে যে ভাবে জেরবার, তাতে যে যাই বলুক ঋণ পাওয়া সহজ সাধ্য হবে না। বাজারের ঘুরে দাঁড়ানোর মুখে কিন্তু এটা একটা বড় প্রতিবন্ধক হবেই। আর ব্যবসা যদি সহজেই বাজারে ফিরতে না পারে তা হলে কাজের সংস্থান কী করে হবে? আমরা বলছি লকডাউনের ফলে শুধু চাহিদার নয়, সমস্যা তৈরি হয়েছে জোগানেরও। এক দিকে কাজ নেই তাই চাহিদা নেই, অন্য দিকে সবাই গৃহবন্দি তাই কারখানার চাকাও বন্ধ।
আরও পড়ুন: দেশে প্রথম: ১৫ জেলায় হটস্পটগুলি সিল করছে যোগী সরকার
লকডাউন উঠলে? যা অবস্থা তাতে চাহিদা বাড়ার সম্ভাবনা কম, কারণ কর্মচ্যূতি— সবার ট্যাঁক খালি। উল্টো দিকে অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে ছোট ব্যবসার নতুন পুঁজির প্রয়োজন হবে। কিন্তু ঋণ খেলাপির ভয়ে ব্যাঙ্কও চট করে মুঠো আলগা করতে চাইবে না। তাই জোগানের চাকাও গড় গড় করে ঘুরতে শুরু করবে না। আর তা যদি না হয়, তৈরি হবে না নতুন কাজের সুযোগও। চাহিদা-জোগানের এই দুষ্টচক্রে কিন্তু পিষে মরবে সাধারণ মানুষই। আরও কাজ হারিয়ে। এখন প্রশ্ন কতটা? উত্তর সময়ই দেবে।