ছবি রয়টার্স।
এত দিন বেসরকারি হাসপাতালে গেলে ৫০০ টাকাতেই দু’ডোজ় কোভিড-প্রতিষেধক মিলছিল। সরকারি হাসপাতালে তা মিলছিল নিখরচায়। কিন্তু এ বার কেন্দ্রীয় সরকার ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সিদের প্রতিষেধক নেওয়ার সুযোগ করে দিলেও, অন্তত ৩-৪ গুণ বেশি দাম গুনতে হবে।
বিরোধীদের প্রশ্ন, গরিব মানুষের পক্ষে কি চাইলেও দেড়-দু’হাজার টাকা দিয়ে প্রতিষেধক নেওয়া সম্ভব?
কেন্দ্র গতকাল সিদ্ধান্ত নেয়, আগামী ১ মে থেকে ৪৫ বছরের কম, ১৮ এবং তার বেশি বয়সি ব্যক্তিরা প্রতিষেধক নিতে পারবেন। কিন্তু ইচ্ছুক ব্যক্তিকে সরাসরি বাজার থেকে প্রতিষেধক কিনতে হবে। রাজ্যগুলিও প্রতিষেধক নির্মাতা সংস্থাগুলির কাছ থেকে প্রতিষেধক কিনতে পারবে। কিন্তু তার খরচ কেন্দ্র দেবে না। রাজ্যগুলি ৪৫ বছরের কম বয়সি গরিব মানুষ বা কোভিডের মোকাবিলায় প্রথম সারিতে থাকা কর্মীদের বিনামূল্যে প্রতিষেধক দিতে চাইলে, তার খরচও তাদেরই বহন করতে হবে।
কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরমের অভিযোগ, কেন্দ্র নিজে সস্তায়, নির্দিষ্ট দরে প্রতিষেধক কিনছিল, কিন্তু কম বয়সিদের প্রতিষেধকের জন্য তারা দর বেঁধে দিল না। ফলে কম খরচে প্রতিষেধক দিতে হলে তার ভর্তুকির পুরো দায় রাজ্যের ঘাড়ে এসে পড়ল। এমনকি, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে সবথেকে অসুবিধায় পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদেরও টিকা নিতে হলে নিজের পকেটের কড়ি গুণতে হবে। যদি না রাজ্যগুলি বিনা মূল্যে প্রতিষেধক দেওয়ার বন্দোবস্ত করে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধীর মতে, এই নীতি বৈষম্যমূলক। সমাজের দুর্বল অংশের মানুষ যে প্রতিষেধক পাবেন, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
বর্তমানে সিরাম ১৫০ টাকায় ও ভারত বায়োটেক ২০৬ টাকায় যথাক্রমে কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্সিন বিক্রি করে কেন্দ্রকে। সরকারি হাসপাতালে সেই প্রতিষেধক বিনামূল্যে ও বেসরকারি হাসপাতালে সেই প্রতিষেধক আড়াইশো টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। ৪৫ বছরের কমবয়সি কেউ টিকা নিতে গেলে সিরাম সংস্থার টিকার দু’টি ডোজ়ের জন্য প্রায় দু’হাজার টাকা লাগতে পারে। কোভ্যাক্সিনের দাম পড়বে আনুমানিক ৮০০-১০০০ টাকার কাছাকাছি। রুশ
স্পুটনিক-ভি-র একটি ডোজ়ের দাম ৭৫০-৮০০ টাকা হতে পারে।
বেশ কিছু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দাবি তুলেছিলেন, রাজ্যগুলিকে নিজেদে প্রয়োজনমতো প্রতিষেধক কিনতে দেওয়া হোক। কিন্তু তার আর্থিক দায়ও যে রাজ্যের ঘাড়ে কেন্দ্র ঠেলে দেবে, তা তাঁরাও আঁচ করতে পারেনি। চিদম্বরমের প্রশ্ন, এমনিতেই কোষাগারের অবস্থা করুণ। রাজ্য এই অর্থ কোথা থেকে পাবে? উল্টো দিকে বিজেপি শিবিরের যুক্তি, এত দিন তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, উদ্ধব ঠাকরেরাই সরাসরি প্রতিষেধক কিনতে চাইছিলেন। কিন্তু তার আর্থিক দায় নেওয়ার কথা ভাবেননি?
প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব কে সুজাতা রাওয়ের মতে, এ হল রাজ্যের গলায় ফাঁস লাগানোর জন্য রাজ্যের হাতেই লম্বা দড়ি ধরিয়ে দেওয়া। তাঁর বক্তব্য, রাজ্যগুলিকে আরও বেশি মানুষকে প্রতিষেধক দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিষেধক কেনার জন্য অর্থসাহায্য করা হবে না। এ একেবারে পরিষ্কার ফাঁদ। অর্থনীতিবিদ রথীন রায়েরও মতে, কেন্দ্র কার্যত টিকাকরণ থেকে হাত তুলে নিল। এর পর রাজ্যগুলির আর কেন্দ্রকে দোষারোপ করার উপায়ই থাকবে না। কারণ, কেন্দ্র আগেই বলে দিচ্ছে, তারা আর কিছু করবে না।
এত দিন বণিকসভা, বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থাগুলি সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছিল, সরকার তাদের প্রতিষেধক কেনার অধিকার দিলে তারা নিজেদের কর্মীদের টিকা দিতে পারে। বণিকসভার কর্তাদের ক্ষোভ, আগেই তা করা হলে আরও বেশি কর্মী-শ্রমিক পুরোদমে কাজ করতে পারতেন। কিন্তু এত দিন কেন্দ্র তা করেনি। এ বার ৪৫ বছরের কমবয়সিদের টিকার ছাড়পত্র দেওয়ার পরে শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল বণিকসভার কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এখন গয়াল বলছেন, বণিকসভাগুলি চাইলে বেসরকারি সংস্থার থেকে, এমনকি, বিদেশি সংস্থার থেকেও সরাসরি প্রতিষেধক কিনে নিতে পারে।
বিরোধীদের অভিযোগ, এমন সময়ে কেন্দ্র রাজ্যের উপরে দায় ঠেলে দিচ্ছে, যখন কোভিড সংক্রমণের হার মাত্রাছাড়া এবং প্রতিষেধকের জোগান নেই। এত দিন মোদী সরকার আত্মনির্ভর ভারতের কথা বলে শুধু দু’টি সংস্থার উপরে ভরসা রেখেছে। রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি-কেও ছাড়পত্র দেয়নি। এখন খোলা বাজারে যত ইচ্ছে দামে প্রতিষেধক বিক্রির ছাড়পত্র দিয়ে মুনাফা করতে দিচ্ছে। এতে প্রতিষেধকের কালোবাজারি, বেআইনি মজুতও হবে।
বিরোধীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মোদী সরকারের এই দায় ঝেড়ে ফেলার ইতিহাস নতুন নয়। বিহারের নির্বাচনী প্রচারে সবাইকে বিনা মূল্যে করোনা প্রতিষেধকের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু পরে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব রাজেশ ভূষণ জানিয়ে দেন, দেশের প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রতিষেধক দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা নেই সরকারের।