প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় চিনের সেনা জওয়ানরা। ফাইল চিত্র।
চিনের তরফে অরুণাচল প্রদেশের বিভিন্ন এলাকার নাম বদলে ফেলা কিংবা প্যাংগং লেকের উপরে সেতু তৈরির মতো পদক্ষেপের জোরালো প্রতিবাদ করেছে সাউথ ব্লক। কিন্তু ঘটনা হল, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা সংলগ্ন লাদাখ সেক্টরের জট ছাড়াতে আলোচনায় বসার জন্য তারিখ নির্বাচনে কিছুতেই ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছে না দিল্লি এবং বেজিং। সূত্রের খবর, সামগ্রিক সেনা পশ্চাদপসরণের ভারতীয় প্রস্তাবে ‘না’ করে দিয়েছে চিন। আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান খোঁজা নয়, বরং তাকে জিইয়ে রেখে সীমান্তে পরিকাঠামো গড়াই আপাতত তাদের লক্ষ্য।
২০২০ সালের মে মাসে পূর্ব লাদাখে শুরু হয়েছিল চিনের সঙ্গে সংঘাত। তার পরে দু’টি শীত প্রায় অতিক্রান্ত। সামরিক বাহিনী পর্যায়ের তেরো রাউন্ড বৈঠক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও চিনা সেনাকে (পিএলএ) ফেরানোর রাস্তা দেখাতে পারছে না ভারতীয় সামরিক বাহিনী এবং কূটনৈতিক নেতৃত্ব।
সামরিক পর্যায়ে আলোচনার পাশাপাশি ভারত এবং চিনের মধ্যে ওয়ার্কিং মেকানিজ়ম ফর কনসাল্টেশন অ্যান্ড কোঅর্ডিনেশনের (ডব্লিউএমসিসি) দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সূত্রের খবর, শেষ পর্যন্ত ভারতের দেওয়া প্রস্তাবে সম্মত নয় চিন। ভারতের আশঙ্কা, এই সংঘাত যদি দ্রুত কমানো না যায়, তাহলে বরফ গলার পরে নিয়ন্ত্রণ রেখায় ফের রক্তপাতের আশঙ্কা থাকছে। তা ছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে একই জায়গায় অবস্থান করার ফলে পিএলএ তথা চিনের টহলদারির এলাকা স্থায়ী ভাবে বাড়বে। ভারতকে ছাড়তে হবে ভূখণ্ড। গত ষাট বছরে, দু’পা এগিয়ে এক পা পিছিয়ে আসার যে রণনীতি নিয়ে চলছে চিন, তা এখানেও সফল হবে।
এ ভাবে অন্য দেশের সঙ্গে কিছু বিতর্কিত সীমান্তেও নিজেদের ভূখণ্ডের অধিকার সম্প্রসারণ করেছে বেজিং। বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে সরকারকে আক্রমণ করে যাচ্ছে কংগ্রেস। শুক্রবারও রাহুল গান্ধীর টুইট, ‘‘আমাদের সীমান্তে যা ঘটে চলেছে, তা জাতীয় নিরাপত্তার চূড়ান্ত গাফিলতি। প্রধানমন্ত্রী কি কখনও এই নিয়ে মুখ খুলবেন?’’
সূত্রের খবর, ১০ অক্টোবর দু’দেশের মধ্যে হওয়া ত্রয়োদশ সামরিক পর্যায়ের বৈঠকে ভারত বেশ কিছু প্রস্তাব চিনকে দিয়েছিল। যার মূল কথা ছিল, দেপসাং থেকে চুমার পর্যন্ত সেক্টরে বিভিন্ন সংঘর্ষ-বিন্দুগুলির সমাধান এক লপ্তে করতে হবে। অর্থাৎ, ভারতের সামরিক কর্তাদের বক্তব্য, সামগ্রিক সেনা পশ্চাদপসরণ এবং প্রত্যাহার নিয়ে কথা শুরু হওয়া জরুরি। সূত্রের দাবি, “চিন এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ভারতের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রত্যেকটি প্রস্তাবের জবাব এসেছে নেতিবাচক ঢংয়ে। এ বিষয়ে বেজিংয়ের বক্তব্য বারবার বদলাচ্ছে। আমরা এ-ও বুঝতে পারিনি যে, ভারতের কোনও প্রস্তাবকে বেজিং আদৌ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে কি না।”
অথচ ভারত এবং চিন নভেম্বরে ডব্লিউএমসিসি পর্যায়ের বৈঠকে স্থির করে, চতুর্দশ রাউন্ডের সামরিক আলোচনা যত দ্রুত সম্ভব আয়োজন করা হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার পরে প্রায় দু’মাস কেটে গেলেও, এখনও কোনও দিনক্ষণ স্থির করা যায়নি। শেষ সামরিক বৈঠকের পরে ভারতের পক্ষ থেকে জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, সঙ্কটমোচনের জন্য ভারত বেশ কিছু গঠনমূলক প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু চিন তাতে সম্মত নয়। আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনও প্রস্তাবও তাদের পক্ষ থেকে আসেনি।
আলোচনাকে ক্রমশ মন্থর করে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর নিজেদের বিপুল পরিকাঠামো তৈরি র এই চিনা কৌশল ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক মনে করছে, আলোচনার মাধ্যমে স্থায়ী নিষ্পত্তির দিকে মন নেই বেজিংয়ের। বরং বিষয়টিকে জিইয়ে রেখে কৌশলগত লাভ আদায় করাই তাদের লক্ষ্য।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্র বলছে, চুমার থেকে দেপসাং পর্যন্ত একাধিক সংঘর্ষ বিন্দু রয়েছে। কয়েক বছর আগে দেপাসং এলাকায় পিএলএ ভারতীয় সেনার টহলদারি বন্ধ করতে চেয়েছিল। ২০১৩ সালে এই দেপসাংয়েই সংঘাত হয়েছে এবং অচলাবস্থা চলেছে দু’দেশের সেনার। স্যাটেলাইট চিত্রেও স্পষ্ট, চিন এই বিভিন্ন সংঘর্ষ-বিন্দুগুলিতে নিজেদের সেনা এবং পরিকাঠামো সংহত করছে। প্যাংগং লেকে নতুন সেতু তৈরি যার একটি উদাহরণ মাত্র।
রণকৌশল বিশেষজ্ঞদের মতে, অচলাবস্থা কাটার কোনও আশু সঙ্কেত নেই। বরং শীতের পরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা ফের অগ্নিগর্ভ হওয়ার ইঙ্গিতই মিলছে।