প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
বছর চারেক আগের কথা। প্রযুক্তি সংস্থা গুগলের মুখে শোনা গিয়েছিল দু’টি শব্দ— ‘কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি’। তারা দাবি করেছিল, এর শ্রেষ্ঠত্ব, এর অকল্পনীয় গতি, আজকের দিনে ব্যবহৃত প্রযুক্তির তুলনায় হাজার হাজার গুণ বেশি। সিলিকন ভ্যালির অন্যতম নামজাদা সংস্থার এ হেন ঘোষণায় চমকে গিয়েছিল বিশ্ব। ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, কোয়ান্টাম কম্পিউটার যে কাজ করতে পারে, তা বর্তমানে ব্যবহৃত সুপার কম্পিউটারগুলির কাছে কল্পনাতীত। এ হেন কোয়ান্টাম প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় পা রেখেছে ভারতও। এ দেশে এই বিষয়ক গবেষণা শুরু হয়েছে বহু আগেই। তবে এ বারে কোয়ান্টাম গবেষণায় ৬০০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, এ যাবৎ কাল বিজ্ঞান গবেষণায় এত বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ মনে পড়ে না।
কোয়ান্টাম প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করছে ভারতের একাধিক প্রতিষ্ঠান, যেমন বেঙ্গালুরুর আরআরআই, জেএনসিএএসআর, আইআইএসসি, পুণের আইআইএসইআর, মুম্বইয়ের টিআইএফআর। কলকাতার ‘এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সস’ (এসএনবিএনসিবিএস) যুক্ত রয়েছে এই কোয়ান্টাম অভিযানে। ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের অধীনস্থ এই সংস্থার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, গবেষণার স্তম্ভ মূলত চারটি— ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটারস অ্যান্ড সিমুলেটরস’, ‘কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন’, ‘কোয়ান্টাম সেন্সিং অ্যান্ড মেটেরোলজি’ এবং ‘কোয়ান্টাম মেটেরিয়ালস অ্যান্ড ডিভাইসেস’। ২০২৩-২৪ থেকে ২০৩০-৩১, এই আট বছরে ‘ন্যাশনাল কোয়ান্টাম মিশন’-এর লক্ষ্য মাঝারি মাপের কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি (৫০-১০০০ কিউবিট)।
কৃত্রিম উপগ্রহের উপর নির্ভর করে ২০০০ কিলোমিটারের মধ্যে নিরাপদ কোয়ান্টাম যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন। এ ছাড়াও, ‘মাল্টি-নোড কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক’, ‘কোয়ান্টাম মেমোরিস’-এর মতো বিষয়ও রয়েছে। বিজ্ঞানীদের কথায়, ‘‘এই মুহূর্তে জটিল এই বিষয়টি সম্পর্কে জনমানসে স্পষ্ট ধারণা তৈরি না হলেও, ৩০ বছর পরে টের পাওয়া যাবে প্রযুক্তির বিপ্লব।’’
এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টারের ডিরেক্টর তথা বিজ্ঞানী তনুশ্রী সাহা দাশগুপ্তের কথায়, ‘‘গোটা বিশ্ব জুড়ে কোয়ান্টাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ চলছে। এই মহাযজ্ঞ একাধিক শাখার বিশেষজ্ঞের অবদান ছাড়া সম্ভব নয়। উদাহরণ হিসেবে, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে মায়োরনা ফেরমিয়নের (যে কণা নিজেই নিজের প্রতিকণা) ব্যবহার হতে হলে বুঝতে হবে টোপোলজিক্যাল সুপারকন্ডাক্টর, কোয়ান্টাম স্পিন তরলের মতো বিষয়গুলিকে, তাদের উপাদানগত বৈশিষ্ট্যকে। এ বিষয়ে পরীক্ষাবিদ, তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী, গণনামূলক পদার্থবিদদের একযোগে কাজ করতে হবে। আমাদের প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে সকলকে স্বাগত জানাচ্ছে।’’ বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই)-র কাজের ক্ষেত্রে বিপুল বদল আনবে কোয়ান্টাম যন্ত্র। আজকের কম্পিউটারগুলি তখন খেলনা মনে হবে। ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে, সুপার কম্পিউটার যে কাজ ১০ হাজার বছরেও করতে পারেনি, সেটাই কোয়ান্টাম কম্পিউটার করে ফেলেছে মাত্র ৩ মিনিট ২০ সেকেন্ডে। মাইক্রোসফ্ট থেকে ইন্টেল, আইবিএম, গুগল, কোয়ান্টাম-দৌড়ে রয়েছে প্রযুক্তি-ক্ষেত্রের তাবড় সব নাম। লক্ষ লক্ষ ডলার বিনিয়োগ করছে আমেরিকা, ইউরোপ, চিন।
কোয়ান্টাম হল যে কোনও ঘটমান বিষয়ের ক্ষুদ্রতম পরিমাণ। যেমন আলোর সবচেয়ে ছোট কণা ফোটন। এমন সাব-অ্যাটোমিক পার্টিকলই প্রযুক্তি-ক্ষেত্রে হইচই ফেলে দিয়েছে। প্রচলিত কম্পিউটারে যে কোনও হিসেবনিকেশ হয় ‘বিট’ একক দিয়ে। প্রতিটি বিটে রয়েছে হয় একটি ১ বা একটি ০। দশকের পর দশক ধরে এমনই চলে আসছে। কোয়ান্টাম তত্ত্বে একটি বস্তু যখন একেবারে ছোট অবস্থায় কিংবা মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডায় রয়েছে, তখন একই সঙ্গে দু’টি আলাদা বস্তুর মতো আচরণ করতে পারে। বস্তুর এই অদ্ভুত আচরণকে অনুসরণ করেই বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছে ‘কোয়ান্টাম বিট’ বা ‘কিউবিট’। এতে ১ ও ০, দু’টিই একসঙ্গে থাকতে পারে। অর্থাৎ ২ কিউবিটে একসঙ্গে ৪টি অঙ্ক। ঠিক এই পথেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রচলিত কম্পিউটারের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী, দ্রুত গতিসম্পন্ন।
তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার যেমন অনেক জটিল সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে পারে, তেমনই বিজ্ঞানী পিটার শোর দেখিয়েছিলেন যে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সহায়তায় ক্লাসিক্যাল সিকিয়োরিটি সিস্টেমকে সহজেই ভেঙে ফেলা যায়। এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টারের বিজ্ঞানী মানিক বণিক বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম আবার নিজেই সমাধান নিয়ে আসে। বিজ্ঞানী চার্লস এইচ বেনেট এবং গিলস ব্রাসাড ১৯৮৪ সালে কোয়ান্টাম জগতের নিয়মকে কাজে লাগিয়ে কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি প্রোটোকল আবিষ্কার করেন। এটি নিরাপদে তথ্য আদানপ্রদানের পথ খুলে দেয়। সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটাই শক্তিশালী যে কোয়ান্টাম কম্পিউটারও ভাঙতে পারবে না।’’
বিজ্ঞানীদের দাবি, এই প্রযুক্তির ব্যবহারে শক্তির অপচয় অনেক কম হবে। ওষুধ তৈরি সহজ হয়ে যাবে। এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল, রুট ম্যাপিং আরও শক্তিশালী হবে। ওষুধ তৈরি থেকে জেনেটিক সিকোয়েন্সিং, বিভিন্ন গবেষণার জটিল থেকে জটিলতম অঙ্কের উত্তর মিলবে নিমেষে। এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টারের বিজ্ঞানী অঞ্জন বর্মন বলেন, ‘‘সেমিকন্ডাকটর কোয়ান্টম ডটে ইলেকট্রনের স্পিন ১/২ ডিগ্রি অব ফ্রিডমকে আবদ্ধ করে স্পিন কিউবিট তৈরি করা সম্ভব। অন্য দিকে চৌম্বকীয় পদার্থের একটি উত্তেজিত অবস্থা, যাকে স্পিন ওয়েভ বা ম্যাগনন বলা হয়, তার বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট-এর উপর ভিত্তি করে কিউবিট ও কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা সম্ভব। এই দুই প্রযুক্তির উপর বিদেশে বহু কাজ চলছে। ভারতেও কাজ শুরু হয়েছে।’’