‘দেড় কোটি টাকার ডিনারসেট? তাতে কী হয়েছে! আমরা রাজপরিবারের।’ এই উত্তরই সাংবাদিকদের দিয়েছিলেন তিনি। যখন ২০১৩ সালের মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে মনোনয়ন দাখিল করেছিলেন যশোধরারাজে সিন্ধিয়া। সম্পত্তির হিসেব দিতে গিয়ে তিনি একটি ডিনারসেটের মূল্য দেখিয়েছিলেন ১ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা। স্বভাবতই সিন্ধিয়া-রাজকুমারির এই দাবি ঘিরে প্রশ্ন উঠেছিল।
২। গ্বালিয়রের শেষ রাজা জিবাজিরাও সিন্ধিয়া এবং রাজমাতা বিজয়ারাজে সিন্ধিয়ার ছোট মেয়ে যশোধরা বিস্তৃত ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন তাঁর দাবির। বলেছিলেন, তাঁদের শৈশবে বিশেষ বিশেষ দিনে খাওয়া হত সোনা রুপোর বাসনে। তাঁর বিয়েতে সিন্ধিয়া পরিবার থেকে দেওয়া হয়েছিল সোনার থালা এবং ছ’টি বাটি। এতে অবাক হওয়ার কিছু খুঁজে পাননি বিজেপি নেত্রী যশোধরা।
পারিবারিক ধারা অনুসরণ করেই তিনি ১৯৯৪ সালে যোগ দেন বিজেপিতে।১৯৯৮-তে প্রথম মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং জয়লাভ। ২০০৩-এও তিনি জয়ী হয়ে বিধায়ক নির্বাচিত হন। ২০০৫ থেকে ২০০৭ অবধি তিনি ছিলেন মধ্যপ্রেদেশের পর্যটন, ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ মন্ত্রী।
এর পর যশোধরা পা রাখেন কেন্দ্রে। ২০০৭ সালে তিনি উপনির্বাচনে গ্বালিয়র কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে লোকসভার সদস্য হন। ২০০৯ সালে আবার জয়ী হয়ে দ্বিতীয় দফায় সাংসদ হিসেবে শপথগ্রহণ করেন যশোধরা। ২০১৩ সালে ফের রাজ্য রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন। ২০১৩ সালে শিবপুরী কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন তিনি। পরের দফাতেও ২০১৮ সালে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেন ২৪ হাজারের বেশি ভোটে।
তবে দিদি বসুন্ধরারাজে সিন্ধিয়ার তুলনায় কিছুটা পরেই রাজনীতিতে পা রেখেছেন যশোধরা। তাঁর জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৯ জুন, লন্ডনে। প্রাথমিক পড়াশোনা মুম্বইয়ের দ্য ক্যাথিড্রাল অ্যান্ড জন ক্যানন স্কুলে। এর পর কোদাইকানালের প্রেজেন্টেশন কনভেন্ট স্কুল। তারপর গ্বালিয়রের সিন্ধিয়া কন্যা বিদ্যালয়। তাঁর মা রাজমাতা তথা প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ ও বিধায়ক প্রয়াত বিজয়ারাজে সিন্ধিয়া ছিলেন এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সিদ্ধার্থ ভনশালীকে বিয়ে করে ১৯৭৭ সালে আমেরিকার নিউ অর্লিন্স চলে যান যশোধরা। তাঁদের তিন সন্তান। দুই ছেলে অক্ষয় এবং অভিষেক এবং একমাত্র মেয়ে ত্রিশলা, তিন জনেই থাকেন নিউইয়র্কে। তবে সিদ্ধার্থ-যশোধরার দেড় দশকের বেশি পুরনো দাম্পত্য শেষ হয়ে যায় ১৯৯৪-এ। বিবাহবিচ্ছেদের পরে যশোধরা ফিরে আসেন ভারতে। তার পরই যোগ দেন সক্রিয় রাজনীতিতে।
যশোধরার মতো তাঁর দিদি, রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরারাজে সিন্ধিয়ার দাম্পত্যও ছিল স্বল্পস্থায়ী। ১৯৭২ সালে বসুন্ধরার বিয়ে হয় ঢোলপুরের রাজ পরিবারের মহারাজ রানা হেমন্ত সিংহের সঙ্গে। তবে বিয়ের এক বছর পরেই তাঁরা আলাদা থাকতে শুরু করেন। বর্তমানে বসুন্ধরার একমাত্র ছেলে দুষ্মন্ত সিংহ ঝালাওয়াড় কেন্দ্রের বিজেপি সাংসদ।
বসুন্ধরা-যশোধরার বড় দিদি তথা জিবাজিরাও-বিজয়ারাজের প্রথম সন্তান পদ্মাবতীরাজের বিয়ে হয়েছিল ত্রিপুরার শেষ ক্ষমতাসীন রাজা কিরীট দেববর্মনের সঙ্গে। ১৯৬৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে প্রয়াত হন পদ্মাবতী।
জিবাজিরাও-বিজয়ারাজের মেজো মেয়ে ঊষারাজে নেপালের রানা পরিবারের রাজবধূ। তাঁর বিয়ে হয়েছে দূর সম্পর্কের আত্মীয়, পশুপতি সামশের জং বাহাদুর রানার সঙ্গে। চার বোনের একমাত্র ভাই প্রয়াত মাধবরাও সিন্ধিয়া ছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাধবরাও বিভিন্ন সময়ে একাধিক মন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করেছেন। মাধবরাওয়ের ছেলে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া সম্প্রতি কংগ্রেস ছেড়ে যোগ দিলেন বিজেপিতে।
অন্যান্য রাজপরিবারের মতো সিন্ধিয়া বংশও ক্ষত বিক্ষত সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদে। গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পত্তি ঘিরে চরমে পৌঁছেছে দ্বন্দ্ব। বর্তমানে বিবাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ও তাঁর তিন পিসি। তবে সব বিবাদ সরিয়ে রেখে ভাইপোর দলবদলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বসুন্ধরা ও যশোধরা, দু’জনেই।
মধ্যপ্রদেশের শিবপুরীর বিধায়ক যশোধরারাজে সিন্ধিয়ার অস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে সংসদের নথিতে উল্লেখ করা আছে দিল্লির সিন্ধিয়া ভিলা এবং স্থায়ী আবাস গ্বালিয়রের জয় বিলাস প্রাসাদের রানি বিলাস মহল। তাঁর দাখিল করা সম্পত্তির হিসেবও তাক লাগিয়ে দেয়।
২০১৩ সালে যশোধরা যে হিসেব দিয়েছিলেন তাতে দেড় কোটির ডিনারসেট ছাড়াও উল্লেখ রয়েছে একটি হিরের আংটির কথা। যার তৎকালীন বাজারমূল্য ছিল সাড়ে ছ’লাখ টাকারও বেশি। ন’টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত আমানত ছিল সাড়ে তেরো লাখ টাকার বেশি।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাবদ ২০১৩-এ দেড় কোটি টাকারও বেশি হিসেব দিয়েছিলেন যশোধরা। এ ছাড়াও বিমার পলিসিস্বরূপ দেখিয়েছিলেন ১৪ লাখ টাকা। পাশাপাশি উত্তরাখণ্ড ও রাজস্থানে তাঁর প্রায় সাড়ে ৪৬ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি আছে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। তবে সেই মুহূর্তে তাঁর হাতে নগদ টাকা বলতে মজুত ছিল তেরো হাজারের সামান্য বেশি।
২০০৬ সালে বিতর্ক তৈরি হয় যশোধরারাজের মন্তব্যে। দলের কাছে তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁকে ‘শ্রীমন্ত’ বলে সম্বোধন করতে হবে। অর্থাৎ নামের সঙ্গে যুক্ত হবে ‘ইয়োর হাইনেস’ বা ‘ইয়োর ম্যাজেস্টি’ গোত্রীয় সম্মান। প্রথমে অসম্মতি থাকলেও পরে বিজেপি থেকে জানানো হয় যশোধরারাজে সিন্ধিয়াকে এ বার থেকে অফিশিয়ালি ‘শ্রীমন্ত’ বলে সম্বোধন করা হবে। দেশে রাজতন্ত্র অবলুপ্ত হওয়ার ৫৫ বছর ফিরে আসে রাজপারিবারের রীতি। (ছবি: আর্কাইভ ও সোশ্যাল মিডিয়া)