অদূর এবং সুদূর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই দ্রৌপদীর মনোনয়ন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
রাষ্ট্রপতি পদে দ্রৌপদী মুর্মুর জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। প্রয়োজনীয় সংখ্যার কাছাকাছি সাংসদ এবং বিধায়ক বিজেপির ছিলই। এর পরেও এনডিএ-র শরিক দলের পাশাপাশি কয়েকটি বিরোধী দলের সমর্থনের আশ্বাসও মিলে গিয়েছে। তা হতেই পরবর্তী কর্মসূচির পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে বিজেপি।
বিজেপির লক্ষ্য— ‘প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি’ হিসাবে দ্রৌপদীকে তুলে ধরা। তাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরে দেশের আদিবাসীপ্রধান এলাকাগুলিতে দ্রৌপদীর ছবি নিয়ে প্রচারের ভাবনা রয়েছে গেরুয়া শিবিরের। বিজেপি সূত্রের খবর, হায়দরাবাদে সদ্যসমাপ্ত জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে সেই প্রস্তাব দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এর পরে দল ঠিক করেছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন মিটে গেলে রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির তফসিলি মোর্চা দেশের শীর্ষ সাংবিধানিক পদে দ্রৌপদীর উত্তরণ নিয়ে প্রচারে নামবে।
বিরোধী জোটের ‘উচ্চবর্ণের’ প্রার্থী যশবন্ত সিন্হাকে হারানোর থেকেও বিজেপির প্রচারে বেশি গুরুত্ব পাবে এটা বলা যে, ভারতের কোনও ‘মূলবাসী’ মানুষকে প্রথম বার রাষ্ট্রপতি ভবনে পাঠানোর উদ্যোগ তাদেরই। সেই কৃতিত্বেরও দাবিদার তারাই।
আদিবাসী মন ও ভোট জয়ই লক্ষ্য নড্ডা, মোদী, শাহদের। ফাইল চিত্র।
বস্তুত, অনেক অঙ্ক কষেই বিজেপি দ্রৌপদীকে প্রার্থী করেছে। তার জন্যই এই প্রচার পরিকল্পনা। সেই অঙ্ক যেমন অদূর ভবিষ্যতের কথা ভেবে, তেমনই সুদূর ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেও। বিজেপি যে গোটা দেশে ক্ষমতা বিস্তারের স্বপ্ন দেখছে, তা হায়দরাবাদেই স্পষ্ট করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। দাবি করেছেন, আগামী তিন-চার দশক ভারতে ‘বিজেপি রাজ’ চলবে। শুধু মুখে বলাই নয়, দলের রাজনৈতিক প্রস্তাবেও এই কথার উল্লেখ করা হয়েছে। সেই দীর্ঘমেয়াদি অঙ্কের যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের অঙ্ক মেলানোর অন্যতম ‘অবলম্বন’ হতে চলেছেন দ্রৌপদী।
সব রাজ্য মিলিয়ে দেশে মোট বিধানসভা আসনের সংখ্যা ৪,১২০। এর মধ্যে আদিবাসী সম্প্রদায় ভোটে ভাগ্য নির্ধারণ করে— এমন তফসিলি উপজাতির জন্য সংরক্ষিত ৫৫৬ আসন। আর এমন লোকসভা আসনের সংখ্যা ৪৭। সুতরাং, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ভারতে স্থায়ী ক্ষমতা বিস্তারের জন্য সেই ভোট অস্বীকার করা যাবে না। আবার যদি উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে তাকানো যায়, তবে সেখানে আদিবাসী সম্প্রদায়ই মূল শক্তি। ভারতে মোট জনসংখ্যার ৮.৬ শতাংশ আদিবাসী হলেও মিজোরামে সেটা ৯৪.৪ শতাংশ। নাগাল্যান্ড, মেঘালয়ে ৮৬ শতাংশের বেশি। ৬০ আসনের অরুণাচল প্রদেশ বিধানসভায় ৫৯টিই তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। আবার বড় রাজ্য ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশায় তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা যথাক্রমে ২৯, ৪৭, ২৮ এবং ৩৩। রাজস্থানে ২৫, গুজরাতে ২৭।
আরও রাজ্যে শক্তি বাড়িয়ে আগামী তিন-চার দশকের জন্য ভারতে বিজেপি রাজ কায়েম করতে চায় গেরুয়া শিবির। ফাইল চিত্র
এখানেই লুকিয়ে বিজেপির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অঙ্ক। আবার অদূর ভবিষ্যতেও সাফল্য পেতে দ্রৌপদী-সিদ্ধান্ত তুরুপের তাস হতে পারে। চলতি বছরেই গুজরাতে বিধানসভা নির্বাচন। ২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী ওই রাজ্যে ১৪ শতাংশের মতো আদিবাসীর বাস। মোদী-শাহের রাজ্যে গত বিধানসভা নির্বাচনে ১৬টি আসন কমেছিল বিজেপির। সবটাই যায় কংগ্রেসের ঝুলিতে। ২৭টি তফসিলি উপজাতি আসনের মধ্যে ১৫টিতে জেতে কংগ্রেস।
২০২৩ সালে ভোট রয়েছে ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে। ওই চার রাজ্য মিলিয়ে আদিবাসীপ্রধান ১২৮ আসনের মধ্যে ৮৬টি রয়েছে কংগ্রেসের দখলে। আবার ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কর্ণাটক মিলিয়ে তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসনসংখ্যা ৯৭। যার মধ্যে মাত্র চারটি আছে বিজেপির দখলে।
উপরের তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, দ্রৌপদীকে রাষ্ট্রপতি করে আদিবাসী সমাজের কাছে দলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চায় বিজেপি। দলের প্রাক্তন সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তের মতে, দ্রৌপদী মুর্মু আসলে প্রতীক। তিনি বলেন, ‘‘আমরা যখন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি পালন করতে চলেছি, তখন নরেন্দ্র মোদী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা গভীর ভাবে প্রতীকী। দ্রৌপদী একাধারে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ এবং মহিলা।’’ এর মধ্যে কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই বিজেপির? স্বপন সরাসরি তা মানতে চান না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিজেপির এখনকার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটাই বদলে গিয়েছে। এখন থেকে ১৫ বছর আগে বিজেপি মানে ছিল হিন্দিভাষী উচ্চ ও মধ্যবর্ণের এবং শহুরে মানুষের দল। এখন আকাশ-পাতাল তফাত।’’
মূলবাসী দ্রৌপদী বিজেপির শক্তি বাড়ানোর অবলম্বন। ফাইল চিত্র
স্বপনের বক্তব্য, ‘‘বিজেপি এখন সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। সংগঠনেও সামাজিক বিন্যাস বদলে গিয়েছে। উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিত্ব তো বরাবরই ছিল। এখন সেই সঙ্গে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, দলিত, আদিবাসী সম্প্রদায়ও যুক্ত হয়েছে। এখন দক্ষিণ ভারতে ক্ষমতা বিস্তার করতে চাইছে দল। ‘গরিব কল্যাণ’ স্লোগানে জোর দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। অমিত শাহ বলছেন, আগামী ৩০-৪০ বছর বিজেপি দেশের সর্বপ্রথম দল হয়ে উঠবে। এই সব কিছুর প্রেক্ষিতেই দ্রৌপদী মুর্মুর মনোনয়নকে দেখতে হবে।’’
বিজেপির এই দীর্ঘমেয়াদি আশাবাদকে অবশ্য গুরুত্ব দিতে চাইছেন না বাংলার শাসকদল তৃণমূলের সাংসদ সৌগত রায়। প্রবীণ সাংসদের বক্তব্য, ‘‘দ্রৌপদী মুর্মু একজন ব্যক্তি। নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পরে তো আর তাঁকে নিয়ে প্রচার হবে না। রাষ্ট্রপতি ভবনে রবার স্ট্যাম্প হয়ে বসে যাবেন। ফলে দীর্ঘমেয়াদি কোনও লাভের প্রশ্ন নেই।’’ একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘রামনাথ কোবিন্দ রাষ্ট্রপতি হওয়ায় দলিতদের কী উপকার হয়েছে? এ বারও কোনও লাভের লাভ হবে না। রাষ্ট্রপতির নাম নিয়ে তো প্রচার করা যায় না। রাষ্ট্রপতি ভবনে বিচ্ছিন্ন হয়েই থেকে যাবেন দ্রৌপদী।’’
তবে সৌগতের মতো বিজেপির পরিকল্পনাকে একেবারে উড়িয়ে দিতে রাজি নন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। বিজেপি দীর্ঘমেয়াদি লাভ পাবে কি না, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী না করলেও তিনি বলেন, ‘‘বিজেপি ভোটের সুবিধা পেলেও আদিবাসী সমাজের কোনও লাভের লাভ হবে না।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘বিজেপি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হোক বা দলের সভাপতি হোক, নানা রকম রাজনৈতিক হিসাব কষেই কাজ করে। যখন প্রথম দক্ষিণের দিকে পা বাড়িয়েছিল, তখন বঙ্গারু লক্ষ্মণ, জনা কৃষ্ণমূর্তিকে নিয়ে এসেছিল সভাপতি হিসাবে। পরে আর তাঁদের দেখা যায়নি।’’
সেলিমের কথায়, ‘‘সবটাই আসলে পিছন থেকে আরএসএস করে। ওদের একটা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং আছে। সারাক্ষণ রাজবংশী, তফসিলি, নেপালি, গোর্খা, হিন্দু, মুসলমান করছে। এখন ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ডে ক্ষমতা চায়। দ্রৌপদী মুর্মু ওড়িশার মানুষ। সেখানে মন্ত্রীও ছিলেন আর ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন রাজ্যপাল। কিন্তু এতে মানুষের লাভ হয় কি?’’
প্রসঙ্গত, জাতীয় স্তরে বিজেপির সে ভাবে কোনও আদিবাসী মুখ নেই। রাষ্ট্রপতি দলের মুখ হতে পারবেন না ঠিকই। তবে বিজেপির যে পরিকল্পনা, তাতে দ্রৌপদীকে রাষ্ট্রপতি করার ‘কৃতিত্ব এবং উদ্যোগ’ নিয়ে দেশব্যাপী প্রচার চলবে। সেটা নির্বাচনের আগে যেমন চলছে, তেমনই পরেও হবে। আদিবাসী মন জয়ের সঙ্গে ভোট জয়ই হবে লক্ষ্য। সেই কারণেই রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালরা মনে করছেন, রামনাম জপ-করা গেরুয়া শিবিরের নতুন আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে ‘দ্রৌপদী-ভজনা’।