BJP

President Election 2022: বাংলায় চন্দনা বাউড়ি থেকে রাইসিনায় দ্রৌপদী মুর্মু, বিজেপির প্রার্থী বাছাইয়ে প্রান্তিক রাজনীতি

দলিত সম্প্রদায়ের রামনাথ কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতি করেছে বিজেপি। এ বার দেশের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি বানানোর উদ্যোগ। এর পিছনেও রাজনীতির অঙ্ক।

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২২ ১৮:১৫
Share:

দ্রৌপদী ও চন্দনায় অনেক মিল। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

চন্দনা বাউড়ি। বাঁকুড়ার সংরক্ষিত শালতোড়া আসন থেকে গত বিধানসভা ভোটে জিতে বিধায়ক হয়েছেন। প্রার্থী করার পর তাঁকে এক প্রান্তিক পরিবারের গৃহবধূ হিসাবেই তুলে ধরেছিল বিজেপি। ভোটের প্রচারে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চন্দনাকে ‘গোটা বাংলার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

Advertisement

তার এক বছরের কিছু সময় পরে বিজেপির রাজনীতিতে ফিরে এল ‘প্রান্তিক’ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলার রাজনীতি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ঝাড়খন্ডের প্রাক্তন রাজ্যপাল দ্রৌপদী মুর্মুর নাম প্রার্থী হিসাবে ঘোষণার সময় বিজেপি সভাপতি জেপি নড্ডা জানিয়েছিলেন, ২০ জনের নাম এলেও বিজেপির সংসদীয় বোর্ড ঠিক করেছিল, রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বাছা হবে পূর্ব ভারত থেকে এবং তিনি হবেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মহিলা।

‘সাঁওতাল’ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দ্রৌপদীর জাতিগত পরিচয় উল্লেখ না করলেও প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর টুইটে ‘প্রান্তিক’ শব্দটির উল্লেখ করেছেন। মোদী লিখেছেন, দ্রৌপদী প্রান্তিক ও গরিব মানুষের জন্য অনেক কাজ করেছেন। ঠাহর করলে বোঝা যায়, বাংলার চন্দনা এবং ওড়িশার দ্রৌপদীর মধ্যে তিনটি মিল— মহিলা, গরিব এবং পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি।

Advertisement

দলিত রামনাথ কোবিন্দের পর একজন আদিবাসীকে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে বসানোর এই সিদ্ধান্তকে অনেকে বলছেন, বিজেপির ‘মাস্টারস্ট্রোক’। যার মাধ্যমে বিজেপি বার্তা দিতে চেয়েছে, তারা দেশের প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে আছে। তারা প্রান্তিক মানুষদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে চায়। বিরোধী শিবির যেখানে শরদ পওয়ার, ফারুক আবদুল্লা এবং গোপালকৃষ্ণ গাঁধীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লড়তে রাজি করাতে না পেরে যশবন্ত সিন্‌হাকে বেছে নিয়েছে, সেখানে জাদুকরের টুপি থেকে খরগোশ বার করার মতো দ্রৌপদীকে এনে দাঁড় করিয়েছে বিজেপি। বিরোধী শিবিরে যেখানে প্রতিষ্ঠিত, পরিচিত এবং উচ্চবর্গীয় রাজনীতিকদের রাষ্ট্রপতি করার দিকে ঝুঁকেছে, সেখানে বিজেপি দেখাতে চেয়েছে, তারা প্রান্তিক মানুষের পাশে রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, আদিবাসীরাই ভারতের মূল বাসিন্দা। সেই অর্থে এই প্রথম কোনও মূলবাসীকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য বেছে নিয়েছে বিজেপি।

চন্দনাকে ‘গোটা বাংলার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী । ফাইল চিত্র

বিজেপি নেতারা মনে করছেন, পিছিয়ে থাকা শ্রেণির মানুষের কথা বললে আখেরে লাভ। ভোটারদের শতাংশের হিসেবেও তাঁরা হেলাফেলার নয়। ২০১৯ সালের ‘লোকনীতি-সিএসডিএস’-এর সমীক্ষা বলছে, ভারতে গড়ে ভোট পড়ে ৬২ শতাংশ। সেখানে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ৭২ শতাংশ মানুষ ভোট দেন।

সেই সমীক্ষাই বলছে, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ওবিসি ভোট পেয়েছিল ২২ শতাংশ। আঞ্চলিক দলগুলি পেয়েছিল ৪২ শতাংশ। আর ১০ বছর পরে ২০১৯ সালে বিজেপির দখলে আসে ৪৪ শতাংশ ওবিসি ভোট। আঞ্চলিক দলের প্রাপ্তি কমে হয় ২৭ শতাংশ।

এই প্রেক্ষিতে বিজেপির দ্রৌপদী-সিদ্ধান্ত যে চমকপ্রদ, একান্ত আলোচনায় তা স্বীকার করে নিচ্ছেন বিরোধী শিবিরের নেতারাও। তেমনই একজনের বক্তব্য, ‘‘এমনিতে রাষ্ট্রপতি ভোটে বিজেপির ৪৯ শতাংশের কিছু বেশি ভোট রয়েছে। দ্রৌপদী মুর্মুকে প্রার্থী করায় বিজেপি ৫৫ থেকে ৫৭ শতাংশ ভোট পেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’’

ঘটনাচক্রে, প্রধানমন্ত্রী মোদীও ‘নিম্নবর্গীয়’ অংশের মানুষ। তাঁর পরিবারও গুজরাতের ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের। যারা সরকারি হিসাবে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি)। মূলত তেল উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হতেন ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের মানুষেরা। বাংলার জাতিগত ভাগে ‘তেলি’ বলা যেতে পারে। সমাজ কী ভাবে সেটা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু মোদী নিজেকে ‘নীচু জাত’ বলে একাধিক বার উল্লেখ করেছেন। নিজেকে ‘চা-ওয়ালা’ বলার পিছনেও মাটির সঙ্গে নিজের যোগ, গরিবের প্রতিনিধিত্ব করার কথাই বোঝাতে চেয়েছেন তিনি।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসকে আক্রমণ করতে মোদী বলেছিলেন, ‘‘আমাকে যত খুশি গালি দাও। দরকারে ফাঁসিকাঠে ঝোলাও। কিন্তু আমার মতো নিচু জাতের কাউকে অপমান কোরো না। আমার স্বপ্ন একটাই। এক ভারত, সেরা ভারত।” তখন প্রিয়ঙ্কা গাঁধি বঢরা ‘নীচ রাজনীতি’ চলছে বলে বিজেপিকে আক্রমণ করেন। তার জবাবে মোদী টুইট করেন, ‘সমাজের নিচু তলা থেকে এসেছি বলেই আমার রাজনীতি ওঁদের চোখে নীচ রাজনীতি বলে মনে হবে। নিচু জাতির মানুষের কতটা ত্যাগ, বলিদান ও চেষ্টায় দেশ আজ এই উচ্চতায় পৌঁছেছে, সেটা বোধহয় কিছু মানুষের নজরেই আসে না।’

একদা দলের সর্বভারতীয় সভাপতি পদে বসানো হয়েছিল দলিত সম্প্রদায়ের বঙ্গারু লক্ষ্মণকে। পরে আর সেটা হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেই রাজনীতি আবার নিয়ে এসেছেন মোদীরা। অটলবিহারী বাজপেয়ী জমানায় বিজেপিই রাষ্ট্রপতি করেছিল এপিজে আবদুল কালামকে। তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের হলেও তাঁর অন্যতম বড় পরিচয় ছিল ‘বিজ্ঞানী’। এর পর অমিত শাহর সভাপতিত্বের সময় বিজেপি রাষ্ট্রপতি করেছিল রামনাথ কোবিন্দকে। তখনও প্রচারের মূল সুর ছিল— ‘দলিত রাষ্ট্রপতি’। এর আগে অবশ্য কংগ্রেস জমানায় দলিত ভারতের প্রতিনিধি কে আর নারায়ণন ১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। এ বার আরও এক ধাপ এগিয়ে তা হয়েছে ‘প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি’।

বিজেপির অনেক নেতাই দাবি করেন, ভারতীয় রাজনীতিতে ‘সব কা সাথ’ স্লোগান মোদী নিয়ে এলেও নীতিটি আসলে আরএসএসের। ফাইল চিত্র

দ্রৌপদী মুর্মুকে প্রার্থী করার পরে বিজেপি নেতাদের প্রতিক্রিয়ায় সেই রাজনীতি স্পষ্ট। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ যেমন টুইট করেছেন, ‘ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন রাজ্যপাল, দ্রৌপদী মুর্মুজিকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য এনডিএ প্রার্থী করায় আন্তরিক অভিনন্দন। আদিবাসী সমাজ থেকে আসা মুর্মুজিকে বেছে নেওয়া নতুন ভারতের সব কা সাথ-সব কা বিকাশ প্রতিশ্রুতির একটি শক্তিশালী প্রমাণ।’

বিজেপির অনেক নেতাই দাবি করেন, ভারতীয় রাজনীতিতে ‘সব কা সাথ’ স্লোগান মোদী নিয়ে এলেও নীতিটি আসলে আরএসএসের। সঙ্ঘকর্তারাও বরাবর সমাজের সব শ্রেণিকে এগিয়ে আনার কথা বলে এসেছেন। হিন্দুত্বের বৃহত্তর সংজ্ঞা তৈরি করে ‘সব ভারতীয়ই হিন্দু’ বলতে শোনা গিয়েছে সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবতকে। আদিবাসী ও পিছিয়ে থাকা শ্রেণিকে সংগঠিত করতে ‘বনবাসী’, ‘জনজাতি’ নাম দিয়ে বিভিন্ন সংগঠনেরও জন্ম দিয়েছে আরএসএস। এখন সেই সঙ্ঘ-নীতিকেই বাস্তবায়িত করতে চাইছে বিজেপি। জোটের ‘বাধ্যবাধকতা’র জন্য অটলবিহারী বাজপেয়ী বা লালকৃষ্ণ আডবাণীরা যা বলতে বা করতে পারেননি, মোদীদের পক্ষে তা করা সহজ। কারণ, জোট শরিকদের খুশি রাখার বাধ্যবাধকতা এখন অনেক কম।

বস্তুত, লোকসভার ৫৪৩ সদস্যের মধ্যে ৮০, রাজ্যসভার ২৪৫ সদস্যের মধ্যে ৩১ জন সদস্য যে রাজ্য থেকে আসেন, সেখানকার জাতপাতের অঙ্ক মিলিয়েই মোদী পাশ করেছেন ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে। যোগী মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন এবং ক্ষমতায় ফিরেছেন সেই অঙ্কের হিসাবেই। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি জোটে উচ্চবর্ণের বিধায়ক ১১৭ জন। আর পিছড়েবর্গ ও তফশিলি জাতি, উপজাতি মিলিয়ে বিধায়ক ১৫৫ জন। এমন অঙ্ক গোটা দেশেই।

বিজেপির কাছে লোকসভা নির্বাচনের লড়াইয়েরও অঙ্গ দ্রৌপদীকে প্রার্থী করা। ভোটের অঙ্ক ভাল বোঝেন অমিত শাহরা। ফাইল চিত্র।

নয়ের দশকের গোড়া থেকেই ‘উচ্চবর্ণের দল’ তকমা মোছার চেষ্টা শুরু হয় বিজেপিতে। সব শ্রেণির মানুষকে দলের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়ে আসার কাজটা পরিকল্পিত ভাবেই শুরু করে বিজেপি। আর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন নিজেকে ‘নীচু জাত’ বলে দাবি করেন, তখন সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির সমর্থন পাওয়া সহজ হয়ে যায় বলেই মনে করেন বিজেপির কৌশলী নেতারা। তার উদাহরণ বাংলাতেও রয়েছে। এ যাবত বাংলায় বিজেপির সবচেয়ে ভাল ফল হয়েছিল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। সেখানে দেখা গিয়েছিল, রাজ্যের সংরক্ষিত আসনগুলি জয়ের ক্ষেত্রে শাসক তৃণমূলের থেকে অনেকটাই এগিয়েছিল বিজেপি। আবার অসংরক্ষিত মালদহ-উত্তর আসন থেকে বিজেপির টিকিটে জয়ী হন আদিবাসী সম্প্রদায়ের খগেন মুর্মু। আদিবাসী নেতা কুনার হেমব্রম সাংসদ হন ঝাড়গ্রাম থেকে। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি আশানুরূপ ফল করতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু বুধারি টুডু, দুর্গা মুর্মু, কমলাকান্ত হাঁসদারা বিধায়ক হয়েছেন।

বিজেপি যাকে ‘সব কা সাথ’ বলছে, সেটাই এক সময়ে ‘জাতপাতের রাজনীতি’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ভারতে এই রাজনীতির সবচেয়ে বড় ভূমি উত্তরপ্রদেশে সেই অঙ্ক মেলাতে পেরেই বিজেপি এখন দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী দল।

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নানা পরীক্ষার মুখে বিজেপি। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তো আছেই, সেই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে কর্মসংস্থানের প্রশ্নে পথ সহজ নয় মোদীদের। সেই পরীক্ষায় পাশ করতে আদিবাসী অঙ্ক কষছে বিজেপি।

রাজনীতির সেই দ্যূতক্রীড়ার আসরেই দ্রৌপদীর আবির্ভাব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement