প্রণব মুখোপাধ্যায়কে গানে শ্রদ্ধা জানালেন বাবুল। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আজীবন কংগ্রেসি এক রাজনৈতিক বটবৃক্ষের প্রয়াণে শ্রদ্ধাঞ্জলি এক তরুণ বিজেপি নেতার।
বা দেশের একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্রপতির স্মৃতিচারণায় এক বাঙালি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর গান।
বা বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে পাঁচ দশক ধরে দিল্লি দাপানো এক বাঙালির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ বলিউড থেকে রাজনীতিতে ঢুকে মোদীর মন্ত্রিসভায় পৌঁছে যাওয়া এক বাঙালির।
ব্যাখ্যা নানা রকম হতে পারে। কিন্তু সদ্যপ্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্মরণে যে গান গাইলেন বাবুল সুপ্রিয়, সে গান রাজনীতির রঙের সীমানাই মুছে দিল। গানের সৌজন্যে বৃহস্পতিবার দিল্লিতে প্রণববাবুর শ্রাদ্ধবাসর জুড়ে জেগে রইল খাঁটি বাঙালিয়ানা।
সারা জীবন দিল্লিতেই রাজনীতি করেছেন। তুলনায় রাজ্য রাজনীতিতে বরং কম স্বচ্ছন্দ ছিলেন। কিন্তু বাঙালিয়ানাটা নিখাদ এবং অপরিবর্তিত থেকে গিয়েছিল আমৃত্যু। ইংরেজি বা হিন্দি উচ্চারণ হোক, খাদ্যাভ্যাস হোক বা গোন শোনা, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সব কিছুতেই খাঁটি বাঙালি ছিলেন প্রণববাবু। তাই উত্তরপাড়ার এক তরুণকে বলিউড ঘুরে দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছে যেতে দেখে বোধহয় খুশিই হয়েছিলেন তিনি। বাবুল যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন, তখন প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি। ২০১৫ সালে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রণববাবুই মন্ত্রিত্বের শপথবাক্য পাঠ করিয়েছিলেন বাবুলকে। আর শপথ শেষে একগাল হেসে হাত মিলিয়ে বলেছিলেন, ‘‘গানটা ছাড়ছ না তো? ওটা কিন্তু চালিয়ে যাবে।’’
বাবুলের গান বেশ প্রিয় ছিল প্রণববাবুর। আসানসোলের বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কথায়, ‘‘প্রণববাবু মারা যাওয়ার পরে যখন শ্রদ্ধা জানাতে গেলাম, তখন অভিজিৎদা (প্রণব-পুত্র) বললেন, তোমার গান বাবা খুব ভলবাসতেন। পেনড্রাইভে আলাদা করে তোমার গাওয়া গান রাখা ছিল বাবার শোনার জন্য।’’
তবে জঙ্গিপুরের প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ অভিজিত্ শুধু নয়, প্রণববাবু নিজেও একাধিক বার মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন বাবুলের কাছে। বাবুল তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতে ভিডিয়ো-সহ তাঁর শ্রদ্ধা জানালেন প্রণববাবুর শ্রাদ্ধের দিন।
প্রণববাবুর গ্রেটার কৈলাসের বাড়িতে তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে প্রয়াত নেতার যে ছবি রাখা হয়েছিল শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য, তার পাশের এলইডি স্ক্রিনে বাবুলের গানের ভিডিয়ো দেখানো হয়েছে। ভিডিয়োয় প্রণববাবুর জীবনের নানা স্মরণীয় মুহূর্তের টুকরো টুকরো কোলাজ। কোনও ছবিতে ইন্দিরার পাশে প্রণব, কোনওটায় রাজীবের সঙ্গে, কোথাও আরএসএস প্রধান মোহন ভগবতের পাশে, কখনও বা রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হাত থেকে ভারতরত্ন গ্রহণরত। সঙ্গে বাবুলের উদাত্ত কণ্ঠে ‘ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা, প্রভু তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে...’।
বাবুলের গাওয়া গান উচ্চ প্রশংসা পেয়েছে বিভিন্ন মহলে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও গানটি ভাল লেগেছে বলে বার্তা পৌঁছেছে বাবুলের কাছে।
বাবুল সুপ্রিয় গাওয়া গান:
কয়েক বছর আগের স্মৃতিচারণ করে বাবুল এদিন বললেন, ‘‘৩০ জানুয়ারি রাজঘাটে গাঁধীজির সমাধিতে একটা অনুষ্ঠান হয়। রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সবাই সেখানে থাকেন। গাঁধীজির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে ভজনও হয়। কিন্তু সে বছর প্রধানমন্ত্রী মোদীজি গানটা আমাকেই গাইতে বলেছিলেন।’’
রাজঘাটের ওই অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব থাকে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের হাতে। তৎকালীন নগরোন্নন মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আবদার শুনে। বাবুল তখন বেঙ্কাইয়ার মন্ত্রকেরই প্রতিমন্ত্রী। গাঁধীজির মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রথা ভেঙে হঠাৎ কোনও মন্ত্রীকে দিয়ে গান গাওয়ালে সমালোচনা হবে কি না, এ সব ভেবেই দোলাচলে ছিলেন বেঙ্কাইয়া। কিন্তু মোদী বেঙ্কাইয়াকে আশ্বস্ত করেন। বলেন, সমালোচনা হবে না। বরং ভাল বার্তা যাবে।
আরও পড়ুন: সোমবার থেকে কলকাতায় মেট্রো চালু, ইস্ট-ওয়েস্টে লাগবে না ই-পাস
গান যে গাইতে হবে, আগে থেকে জানতেন না সদ্য মন্ত্রী হওয়া বাবুল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আবদার। অতএব গাইতেই হয়েছিল। এই রবীন্দ্রসঙ্গীতই সে দিন ধরেছিলেন গায়ক। শুনে খুশি হন রাষ্ট্রপতি প্রণববাবু। বাবুলের কথায়, ‘‘প্রণববাবু সে দিন বার বার বলেছিলেন, সবচেয়ে উপযুক্ত গান (মোস্ট অ্যাপ্রোপ্রিয়েট সং)। পাশে বসা প্রধানমন্ত্রীকে তিনি প্রথম কয়েকটি লাইনের মানেও বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।’’
আরও পড়ুন: করোনা-আক্রান্ত কলকাতার নগরপাল অনুজ শর্মা
বিষয়টি জানতেন অভিজিত্। তাই পিতৃস্মৃতিতে বাবুলকে সেই গানটিই গাইতে অনুরোধ করেন তিনি। বাবুলের কথায়, ‘‘আজ প্রণববাবুর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ছিল। তাই বুধবারের মধ্যে গান রেকর্ডিং এবং ভিডিয়ো তৈরির কাজ শেষ করে ফেলেছিলাম। আজ আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ করলাম।’’
প্রণব-স্মৃতিতে তৈরি গানটির ভিডিয়ো টুইটও করেন বাবুল। সেটি রিটুইট করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। লিখেছেন, ‘প্রণবদা’র স্মৃতিতে বাবুলের এই গান গোটা জাতির আবেগকে প্রকাশ করছে।