বাবরি মসজিদ। ফাইল চিত্র।
আটাশ বছর পরে ৯২ বছরের লালকৃষ্ণ আডবাণী আর ৮৬ বছরের মুরলীমনোহর জোশীকে শাস্তি দিয়ে কী লাভ? ফোনে চণ্ডীগড় থেকে প্রশ্ন তুললেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মনমোহন সিংহ লিবেরহান। তার পরে নিজেই জবাব দিলেন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তদন্তে গঠিত লিবেরহান কমিশনের প্রধান, “কোনও উদ্দেশ্যই পূরণ হবে না!”
১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছিল। আডবাণী, জোশী, উমা ভারতীর মতো নেতানেত্রীরা মসজিদ ভাঙার ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উস্কানিতে জড়িত ছিলেন কি না, বুধবার সেই রায় দিতে চলেছেন লখনউয়ের বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক সুরেন্দ্রকুমার যাদব।
বিচারকের নির্দেশ ছিল, অভিযুক্তদের সবাইকে রায় ঘোষণার সময়ে আদালতে হাজির থাকতে হবে। কিন্তু উমা কোভিড আক্রান্ত হয়ে হৃষীকেশের হাসপাতালে ভর্তি। আডবাণীর সচিব দীপক চোপড়া জানান, বয়সজনিত কারণে করোনা অতিমারির মধ্যে আডবাণী-জোশীরা আদালতে যাবেন না। আদালত ব্যবস্থা করলে ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে হাজিরা দেবেন।
বাবরি ধ্বংস মামলায় মোট ৪৯ জন অভিযুক্তের মধ্যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অশোক সিঙ্ঘল, শিবসেনার বাল ঠাকরে, অযোধ্যার পরমহংস রামচন্দ্র দাসের মতো ১৭ জন ইতিমধ্যে প্রয়াত। লিবেরহান বলেন, “বাকিদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুপথযাত্রী। তাঁদের শাস্তি দিয়ে কী উদ্দেশ্য পূরণ হবে! রায় কী হয়, তার জন্য অপেক্ষায় রয়েছি। কিন্তু এখন আর কাউকে সাজা দিয়ে কী লাভ!”
আরও পড়ুন: বাবরি-বিতর্কের ইতিহাস
অযোধ্যার রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ জমি বিবাদের অন্যতম মামলাকারী ইকবাল আনসারিরও মত, “এই মামলা তুলে দেওয়া উচিত। অভিযুক্তদের অনেকেই মারা গিয়েছেন। বাকিরা বৃদ্ধ। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে আর বিবাদ না বাড়ানোই ভাল।” কিন্তু আইনজীবীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সুপ্রিম কোর্ট রামমন্দিরের পক্ষে রায় দিলেও বাবরি ভাঙাকে ‘আইনের গুরুতর লঙ্ঘন’ বলেই আখ্যা দিয়েছিল।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার ১০ দিনের মাথাতেই অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি লিবেরহানকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এক সদস্যের সেই কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়ে ১৭ বছর পরে, ২০০৯ সালের ৩০ জুন। লিবেরহান তাঁর রিপোর্টে বলেছিলেন, ‘মসজিদে হামলা পূর্ব পরিকল্পিত ছিল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত নেতানেত্রীরা হামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন।’ বাবরি মসজিদ ধ্বংস তদন্তের চার্জশিটে সিবিআই-ও আডবাণী, জোশী, উমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে। কারণ, সে দিন তাঁরা মঞ্চ থেকে ‘এক ধাক্কা অউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো’ স্লোগান তুলে করসেবকদের উস্কানি দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: বাবরি মসজিদ নির্মাণ থেকে ধ্বংস, পাঁচ শতকের সালতামামি
বিশেষ সিবিআই আদালতের সামনে আডবাণী-জোশী দু’জনেই তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহেরও দাবি ছিল, তাঁরা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। অথচ উমা বলেছেন, বাবরি ভাঙার জন্য তিনি হাসি মুখে ফাঁসিকাঠে ঝুলতেও রাজি।
গত ২৮ বছরে তদন্ত, আইন, আদালত নিজের পথে চলেছে। আর অন্য দিকে রামমন্দির আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই বিজেপির রাজনৈতিক উত্থান হয়েছে। লালকৃষ্ণ আডবাণী দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। জোশী মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী হয়েছেন। উমা গেরুয়া বসনেই মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসেছেন। আবার নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহর জমানায় পালা বদলে আডবাণী-জোশী দলের মার্গদর্শকমণ্ডলীতে চলে গিয়েছেন। দল পরিচালনায় তাঁদের আর কোনও ভূমিকাই নেই। উমাও সম্প্রতি বিজেপির জাতীয় সহ-সভাপতির তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন।
রায়কে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়াতে পারে বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রাজ্যগুলিকে স্পর্শকাতর এলাকায় নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু রাজনীতিকদের অনেকেরই মত, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজের হাতে রামমন্দিরের শিলান্যাস করার পরে রামজন্মভূমি আন্দোলনও রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে।
আরও পড়ুন: এত দিনে বাবরি ধ্বংসের রায়! অক্ষমের উল্লাস ছাড়া আর কী?
বুধবার লখনউয়ের আদালত যদি আডবাণী-জোশীদের দোষী ঘোষণা করে শাস্তি দেয়, তা হলে তাঁদের যে এখনই জেলে যেতে হবে, এমন নয়। তাঁদের সামনে উচ্চ আদালতে যাওয়ার রাস্তা খোলা থাকবে। যার অর্থ, আরও দেরি। তবে কি সুপ্রিম কোর্ট আইন লঙ্ঘন বললেও তার বিচার হবে না? আডবাণীরা যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তার পরেও ‘জাস্টিস ডিলেড ইজ় জাস্টিস ডিনায়েড’ প্রবাদ সত্যি প্রমাণ করে রেহাই পেয়ে যাবেন? লিবেরহানের দার্শনিক উত্তর, “জোসেফ স্তালিনও তো কত নিপীড়ন চালিয়ে রেহাই পেয়ে গিয়েছিলেন।”