নির্মাণের সাড়ে চার শতক পরে ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে উঠে বাবরি মসজিদ।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জিতে তখন দিল্লির মসনদের দখল নিয়েছেন জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর। তবে আর্যাবর্তে বিস্তীর্ণ অংশ তখনও তাঁর নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বস্ত সেনাপতি মির বাকিকে অওধ আর রোহিলাখণ্ডে সেনা অভিযানের দায়িত্ব দিলেন প্রথম মুঘল সম্রাট। ১৫২৭ সালে অওধ দখল করলেন বাকি। পরের বছর তাঁর মনিবের নামে সরযূ নদী পাড়ে বানালেন তিন গম্বুজওয়ালা এক মসজিদ। সাড়ে চার শতক পরে যা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে উঠল।
অভিযোগ, হনুমানগড়ির পাশের ওই জমি ‘রামলালার জন্মস্থান’ বলে চিহ্নিত ছিল। সেখানে থাকা রামলালার মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের (এএসআই) রিপোর্টে মসজিদের তলায় দশম শতকে অ-ইসলামিক স্থাপত্যের কথা বলা হলেও মন্দিরের অস্তিত্ব স্পষ্ট ভাবে স্বীকার করা হয়নি। হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, মুঘল আমলে একাধিক বার ওই জমি উদ্ধারের চেষ্টা হয়েছিল। যদিও সেই দাবির সমর্থনে ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণও মেলেনি।
উনবিংশ শতকের ব্রিটিশ নথিতে অবশ্য অযোধ্যায় ওই বিতর্কিত জমিতে দুই সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণ সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। ১৮৫৭ সালের শেষ পর্বে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের পরে বিতর্কিত জমিকে দু’টি অংশে ভাগ করে লোহার বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয় ব্রিটিশ সরকার। ভিতরের অংশ মুসলিমদের এবং বাইরের অংশ হিন্দুদের ধর্মাচরণের জন্য নির্ধারিত হয়। ১৮৭৭-এ বিতর্কিত জমির অন্দরে অবস্থিত ‘রাম চবুতরা’-য় হিন্দু পুণ্যার্থীদের প্রবেশের জন্য তৈরি হয় পৃথক পথ। উত্তর দিকে সীতা কি রসুই হয়ে।
১৮৭৭-এ বিতর্কিত জমির অন্দরে অবস্থিত ‘রাম চবুতরা’-য় হিন্দু পুণ্যার্থীদের প্রবেশের জন্য তৈরি হয় পৃথক পথ।
১৮৮৫-র জানুয়ারিতে অযোধ্যার জমি বিতর্ক গড়ায় আদালতে। রামলালার প্রধান পূজারি মহন্ত রঘুবীর দাস মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য ফৈজাবাদ আদালতে আবেদন জানান। ওই বছরের ডিসেম্বরে রঘুবীরের আর্জি খারিজ করেন ফৈজাবাদ আদালতের সাব-জজ হরিকিষণ পণ্ডিত। এরপর জেলা আদালতের দ্বারস্থ হলেন রঘুবীর।১৮৮৬ সালের মার্চে ফৈজাবাদের জেলা বিচারক এফ ই এ চ্যামিয়ের তাঁর রায়ে বলেন, ‘হিন্দুদের জমির উপর মসজিদ গড়া দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু ঘটনাটি ঘটেছে ৩৫৬ বছর আগে। তাই নতুন করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে।’
ফৈজাবাদ জেলা আদালতের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে রঘুবীর অওধের বিচারবিভাগীর কমিশনার ডব্লুই ইয়ংয়ের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু সেই আবেদন খারিজ হয়ে যায়। ১৯৩৪ সালের মার্চে গো-হত্যার অভিযোগ কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হিংসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বাবরি মসজিদের কাঠামো। সে সময় মসজিদ মেরামতির জন্য হিন্দুদের থেকে জরিমানা আদায় করে ব্রিটিশ প্রশাসন।
আরও পড়ুন: শেষ গম্বুজটাও ভেঙে পড়তে দেখলাম ৪টে ৪৯ মিনিটে
এরই মধ্যে বিতর্কিত জমি ও মসজিদের মালিকানা নিয়ে শিয়া এবং সুন্নিদের মতবিরোধ গড়ায় আদালতে। ১৯৪৬ সালে ফৈজাবাদ জেলা আদালতের বিচারক এস এ এহসান রায় দেন, ‘সম্রাট বাবর সুন্নি ছিলেন। তাই জমি সুন্নিদের প্রাপ্য’। যদিও মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মির বাকি ছিলেন শিয়া।
স্বাধীনতার পরে নতুন মাত্রা পায় বাবরি সঙ্ঘাত। ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বরের গভীর রাতে মসজিদের মূল গম্বুজের নীচে রামলালার মূর্তি স্থাপন করা হয়। মন্দির-পন্থীদের দাবি, রামলালা প্রকট হয়েছেন। পরের দিন ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা পুলিশ স্টেশনের অফিসার ইন-চার্জ পণ্ডিত রামদেও দুবে ওই ঘটনায় একটি এফআইআর দায়ের করেন অভিরাম দাস, রামসকল দাস, সুদর্শন দাস-সহ প্রায় ৬০ জনের বিরুদ্ধে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৭ (দাঙ্গা), ৪৪৮ (অবৈধ প্রবেশ), ২৯৫ (উপাসনাস্থলের অসম্মান) ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
সে সময় অযোধ্যা থানার কনস্টেবল মাতাপ্রসাদ তাঁর বয়ানে জানান, ৫০-৬০ জন লোক তালা ভেঙে ঢুকে মূল গম্বুজের নীচে সীতা-রামের ছবি ও রামলালার মূর্তি বসায়। ১৯৮১ সালে, তিন দশক পর ৩ ডিসেম্বর খুব ভোরে অভিরাম এবং আরও অনেকে মসজিদে ঢুকে পুজোর চেষ্টা করেছিলেন। মুসলিমদের তরফে ওই ঘটনা নিয়ে ফৈজাবাদ আদালতে মামলা দায়ের করেন স্থানীয় বাসিন্দা হাসিম আনসারি। বিতর্কিত জমির গেটে পড়ে তালা।
১৯৪৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিতর্কিত কাঠামো-সহ জমির রিসিভার নিযুক্ত হন স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রিয় দত্ত রাম। ফৈজাবাদের অ্যাডিশনাল সিটি ম্যাজিস্ট্রেট মার্কণ্ডেয় সিংহ এ সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশ জারি করলেন। ওই ঘটনার দু’সপ্তাহ পরেই বিতর্কিত কাঠামোয় অধিষ্ঠিত রামলালার তরফে মামলা দায়ের হয় ফৈজাবাদ আদালতে। আবেদনকারী গোপাল সিংহ বিশারদ নিজেকে রামলালার প্রতিনিধি হিসেবে দাবি জমির মালিকানা চান।
মসজিদ ঘিরে রেখেছিল পুলিশ।
এর পরেই খুলে যায় ‘প্যান্ডোরার বাক্স’। জমির মালিকানা চেয়ে একের পর এক মামলা দায়ের শুরু হয়। ১৯৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর রাম জন্মভূমি ন্যাসের তরফে মহন্ত রামচন্দ্র দাস জমির মালিকানা চেয়ে ফৈজাবাদ আদালতের দ্বারস্থ হন। ১৯৫৯-এর ১৭ ডিসেম্বর রামলালার সেবাইত হিসেবে জমির অধিকার চেয়ে ফৈজাবাদ আদালতে মামলা করে নির্মোহী আখড়া। ১৯৬১ সালে ১৮ ডিসেম্বর বিতর্কিত কাঠামোকে ‘মসজিদ’ হিসেবে ঘোষণার দাবিতে মামলা দায়ের করে উত্তরপ্রদেশ সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড। মূল গম্বুজ থেকে রামলালার মূর্তি সরিয়ে সেখানে ফের নমাজের অনুমতিও চাওয়া হয়।
১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে জমির মালিকানা সংক্রান্ত চারটি মামলার একত্রে শুনানির সিদ্ধান্ত নেয় ফৈজাবাদ দেওয়ানি আদালত। ১৯৯০ সালে ইলাহাবাদ হাইকোর্টে গিয়ে জমির দাবি প্রত্যাহার করে নেয় ন্যাস।
রামমন্দির নিয়ে নতুন করে অশান্তির সূচনা প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর জমানায়। ১৯৮৬-র ২৫ জানুয়ারি ভক্তদের রামলালার দর্শনের অনুমতি দেওয়ার জন্য ফৈজাবাদ আদালতে আর্জি জানান আইনজীবী উমেশচন্দ পাণ্ডে। ১ ফেব্রুয়ারি ফৈজাবাদের জেলা বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট কে এন পাণ্ডে রামলালা দর্শনের জন্য ভক্তদের সুযোগ দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। হিন্দু পুণ্যার্থীদের জন্য খোলা হয় বিতর্কিত জমির প্রবেশপথের তালা।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হয় মুসলিম সমাজে। ১৯৮৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, দিল্লির জামা মসজিদের ইমাম বুখারি এবং সৈয়দ সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি। বিতর্কিত জমিতে মসজিদের দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতিও শুরু হয়।
অযোধ্যায় গাঁইতি-শাবল জড়ো করেন করসেবকেরা।
এরই মধ্যে ১৯৮৯ সালের ১ জুলাই বিতর্কিত জমিতে রামলালার মন্দির স্থাপনের আবেদন জানিয়ে ফের একটি মামলা দায়ের হয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সহ-সভাপতি দেবকীনন্দন আগরওয়ালের আবেদনে সাড়া দিয়ে ইলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনউ বেঞ্চে শুনানির সিদ্ধান্ত হয়। এর দু’সপ্তাহের মধ্যে বিতর্কিত জমির অধিকার সংক্রান্ত সমস্ত মামলা স্থানান্তরিত হল ইলাহাবাদ হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চে। ওই বছরের ১৪ অগস্ট বিতর্কিত জমিতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেয় ইলাহাবাদ হাইকোর্ট।
১৯৮৯-সালের নভেম্বরে বিতর্কিত এলাকার বাইরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শিলান্যাস অনুষ্ঠান হয়। সেখান থেকেই রামমন্দির আন্দোলনের ‘মুখ’ হিসেবে আবির্ভাব লালকৃষ্ণ আডবাণীর। ১৯৯০-এর ২৫ সেপ্টেম্বর গুজরাতের সোমনাথ মন্দির থেকে অযোধ্যার উদ্দেশে রামরথ যাত্রা শুরু করেন আডবাণী। তাঁর ঘোষণা, ৩০ অক্টোবর অযোধ্যা পৌঁছে করসেবার মাধ্যমে রামমন্দির নির্মাণের সূচনা করবেন। কিন্তু ২৩ অক্টোবর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ সমস্তিপুরে রথ আটকে আডবাণীকে গ্রেফতার করেন।
অযোধ্যায় জমায়েত রামভক্তেরা অবশ্য ৩০ অক্টোবর বিতর্কিত জমিতে করসেবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ যাদবের নির্দেশে সেই চেষ্টা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকারের হিসেবে পুলিশের গুলিতে ১৬ জন করসেবকের মৃত্যু হয়।
মসজিদে ঢুকছেন করসেবকরা।
১৯৯১ সালের জুনে পতন নয় মুলায়ম সরকারের। বিজেপি নেতা কল্যাণ সিংহ বিধানসভা ভোটে জিতে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে ৭ অক্টোবর অযোধ্যায় বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমি অধিগ্রহণ করলেন। শুরু হয় সেখানে পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের আশ্রয়স্থল গড়ার উদ্যোগ। কিন্তু এর তিন দিনের মাথাতেই হাসিম আনসারির আবেদনের প্রেক্ষিতে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট নির্দেশ দিল, বিতর্কিত জমিতে কোনও নির্মাণ চলবে না।
লখনউয়ে বিজেপি সরকার গঠনের পরেই অযোধ্যায় করসেবার জন্য নতুন করে তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। ১৯৯২ সালের ২৭ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা জমা দিয়ে করসেবার অনুমতি দেওয়ার আবেদন জানায় কল্যাণ সরকার। বাবরি মসজিদের নিরাপত্তার আশ্বাসও দেওয়া হয়। বিতর্কিত এলাকার বাইরে করসেবার অনুমতি দেয় শীর্ষ আদালত। ৬ ডিসেম্বরের করসেবার উপর নজরদারির জন্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু প্রশাসনের আশ্বাসে ফল মেলেনি। করসেবক ও রামভক্তেরা ঢুকে গুঁড়িয়ে দেন বাবরি মসজিদ। উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন ও পুলিশ মসজিদ রক্ষায় কোনও তৎপরতা দেখায়নি বলে অভিযোগ ওঠে।
মসজিদের গম্বুজের মাথায় করসেবক ও রামভক্তরা।
সেদিনই উত্তরপ্রদেশে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে নরসিংহ রাও সরকার। বাবরি ধ্বংসের বিরুদ্ধে দু’টি পৃথক এফআইআর দায়ের হয়। প্রথমটি ললিতপুরে, মসজিদ ভাঙায় অংশ নেওয়া অজ্ঞাতপরিচয় করসেবকদের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়টি রায়বরেলীতে, ঘটনার দিন রামকথাকুঞ্জের মঞ্চ থেকে প্ররোচনামূলক বক্তৃতার অভিযোগ সঙ্ঘ পরিবারের আট নেতার বিরুদ্ধে— লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশী, অশোক সিঙ্ঘল, গিরিরাজ কিশোর, উমা ভারতী, সাধ্বী ঋতম্বরা, বিনয় কাটিয়ার এবং বিষ্ণু হরি ডালমিয়া।
বাবরি ধ্বংসের বিরুদ্ধে দু’টি পৃথক এফআইআর দায়ের হয়। প্রথমটি ললিতপুরে, মসজিদ ভাঙায় অংশ নেওয়া অজ্ঞাতপরিচয় করসেবকদের বিরুদ্ধে।
১৯৯২-এর ১৬ ডিসেম্বর বাবরি ধ্বংসের ঘটনার তদন্তের জন্য কমিশন গড়ে প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাওয়ের সরকার। নেতৃত্বে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এস লিবারহান। ১৯৯৩ সালের ৩ এপ্রিল সংসদে আইন পাশ করিয়ে বিতর্কিত জমির দখল নেয় কেন্দ্র। অগস্টে বাবরি ধ্বংস মামলার তদন্তের ভার পায় সিবিআই।
১৯৯৩ সালের ৫ অক্টোবর প্রাথমিক আট অভিযুক্ত-সহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে সিবিআই চার্জশিট পেশ করে। বাবরি ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ, শিবসেনা প্রধান বালাসাহেব ঠাকরে, ন্যাসের মহন্ত নৃত্যগোপাল দাসের বিরুদ্ধে। ১৯৯৬-এর জানুয়ারিতে সাপ্লিমেন্টরি চার্জশিটে আরও ন’জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর কয়েক বছর পরে সিবিআই আদালত চার্জ গঠন করার সিদ্ধান্ত নিলে সেই নির্দেশকে ইলাহাবাদ হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ জানান আডবাণী, জোশীরা।
এরই মধ্যে চলে জমির মালিকানা মামলাও। মসজিদস্থলে আদৌ কোনও মন্দির ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-কে ২০০৩ সালের মার্চে নির্দেশ দেয় ইলাহাবাদ হাইকোর্ট। খনন করে দেখার পর এএসআই আদালতকে রিপোর্ট দেয় মসজিদস্থলের নীচে দশম অ-ইসলামি ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এএসআই-এর রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
ওই বছর সেপ্টেম্বরে রায়বরেলীর বিশেষ সিবিআই আদালত বাবরি ধ্বংস মামলা থেকে আডবাণীকে রেহাই দেয়। কিন্তু ২০০৫ সালে সিবিআই আদালতের নির্দেশ খারিজ করে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট জানায়, আডবাণীর বিরুদ্ধে বিচার চলবে। ২০০৯-এর জুলাইয়ে লিবারহান কমিশন রিপোর্ট পেশ করে। ৯০০ পাতার রিপোর্টে ষড়যন্ত্রের কথা বলা হলেও কার্যত সেই অভিযোগ থেকে ক্লিনচিট দেওয়া হয় আডবাণী, জোশীকে।
২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনউ বেঞ্চ অযোধ্যায় বিতর্কিত জমিকে তিন ভাগে ভাগ করার রায় দেয়। নির্মোহী আখড়া, রামলালা বিরাজমান এবং সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের মধ্যে সমান ভাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০১১-এর ৯ মে জমি ভাগ নিয়ে লখনউ বেঞ্চের সেই রায়ে স্থগিতাদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
২০১২-র মার্চে বাবরি ধ্বংস সংক্রান্ত সবগুলি মামলার শুনানি একসঙ্গে করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন সিবিআইয়ের। তিন বছর শুনানির পরে বাবরি ধ্বংসের মামলা নিয়ে আডবাণীদের বক্তব্য জানতে চেয়ে নোটিস দেয় সু্প্রিম কোর্ট। এরপর ২০১৭-র ১৯ এপ্রিল আডবাণী, জোশী, উমা ভারতীদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মামলা ফের শুরু করার নির্দেশ শীর্ষ আদালতের। পাশাপাশি, বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষ এবং রোহিন্টন নরিম্যানের বেঞ্চ জানায়, সিবিআই আদালতকে দু’বছরে মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে।
২০১৭ সালের ৩০ মে লখনউয়ের বিশেষ সিবিআই আদালতে আডবাণী, জোশী, উমা-সহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়। কারণ, মোট ৪৯ জন অভিযুক্তের মধ্যে ১৭ জনের ততদিনে মৃত্যু হয়েছে। এরপর ২০১৯-এর ২০ জুলাই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ষড়যন্ত্র মামলায় আগামী ন’মাসের মধ্যে রায় দেওয়ার জন্য সিবিআই আদালতকে নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
আরও পড়ুন: এত দিনে বাবরি ধ্বংসের রায়! অক্ষমের উল্লাস ছাড়া আর কী?
তবে শেষ পর্যন্ত বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলার আর তাৎপর্য রয়েছে কি না, তা নিয়েই এখন প্রশ্ন। কারণ, ২০১৯-এর ৯ নভেম্বর অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির নির্মাণের রায় দেয় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ। চলতি বছরের ৫ অগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতে করোনা আবহের মধ্যেই সেখানে ভূমিপূজন আর শিলান্যাসও হয়ে গিয়েছে। ৯ নভেম্বর শীর্ষ আদালতের রায়ের পরেই মোক্ষম প্রশ্নটা তুলেছিলেন, কট্টরপন্থী এমআইএম সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়েইসি— ‘‘আজ জানলাম বাবরি মসজিদটাই ছিল বেআইনি। তা হলে মসজিদ ধ্বংস কী করে অপরাধ হতে পারে?’’