চরিত্র হিসেবে বাদী-বিবাদীর লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলেন রাম।
অনুষ্টুপ ছন্দে লেখা প্রায় পঞ্চাশ হাজার শ্লোক সম্বলিত আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন মহাকাব্যের নায়ক রামলালা বিরাজমান দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে বিতর্কিত জমির অধিকার পেলেন। নিজেই একজন মামলাকারী হিসাবে নির্মোহী আখড়ার সেবায়েতদের পাশাপাশি হারিয়ে দিলেন সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে। আজ সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে অন্যদের দাবি খারিজ করে বিতর্কিত জমি দেওয়া হল রামলালা বিরাজমানকেই।
সংবিধান বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, হিন্দু দেবতাদের ‘জুরিস্টিক পার্সন’ বা আইনের চোখে ব্যক্তি হয়ে ওঠার সূত্রপাত ব্রিটিশ জমানায়, ‘ইংলিশ কমন ল’ থেকে। প্রবীণ আইনজীবী আদীশ চন্দ্র আগরওয়াল বলেন, ‘‘আইনের চোখে ব্যক্তি হিসেবে দেবতার সব রকম আইনি অধিকার রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, তিনিও মামলা করতে পারেন। তবে তাঁর সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার নেই। তা শুধু দেশের নাগরিকদের জন্য।’’
বিশেষজ্ঞদের কেউ বলছেন, কোনও ধর্মের দেবতা সম্পর্কেই কোনও ‘পাথুরে প্রমাণ’ কেউ হাজির করতে পারেন না। নব্য ইতিহাসবিদরা তাই ইদানীং সাহিত্যের মধ্যেও ইতিহাসকে আবিষ্কার করছেন। রামও এক ঐতিহাসিক চরিত্রে পরিণত। দেবতা হিসেবে তিনি আইনি বৈধতা পেয়েছেন। আবার রাজনীতিরও প্রতীক হয়ে উঠেছেন। আবার হিন্দু আইনে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, দেবতা নিজে কিছু করতে পারবেন না, তাঁর অভিভাবক দরকার। আইনে তাই যে কোনও হিন্দু দেবতাই নাবালক। সেবায়েত তাঁর অভিভাবক।
দিল্লির জাকির হুসেন (সান্ধ্য) কলেজ বাংলা বিভাগের প্রধান মুন্সি মহম্মদ ইউনুস বলছেন, ‘‘এটা মানুষের সমষ্টিগত বিশ্বাসের প্রশ্ন। সেই বিশ্বাস থেকে মিথ তৈরি হয়েছে এবং তা থেকে ইতিহাস। রাম ইতিহাসের চরিত্র হয়ে উঠেছেন এবং সেই সূত্রে মন্দির একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। গত পঁচিশ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে একে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে রাজনীতি। রাম যার মুখ্য চরিত্র। ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়। তার পাথুরে প্রমাণ হাজির করা সম্ভব নয়।’’
তবে, দেবতার আইনসিদ্ধ হওয়ার মধ্যে একটি ঘোর অনাধ্যাত্মিক কারণও রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। তা হল, দেবতাকে আইনসিদ্ধ করে, তার নামে সম্পত্তি লিখে দিয়ে দেবোত্তর সম্পত্তির সঙ্গে জনসেবামূলক দফা জুড়ে কর ফাঁকি দেওয়া। এ ভাবে দেবতার সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ এবং তা বংশানুক্রমে চালিয়ে যাওয়ার নামে ট্রাস্টের দলিল তৈরির রেওয়াজও রয়েছে অনেক জায়গাতেই। দেবতাকে হাজির করা যায় না বলে সেবায়েতদের উপরেই সেই সম্পত্তি দেখভালের আইনি অধিকার বর্তায়।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক পার্থ দত্তের বক্তব্য, ‘‘ব্রিটিশ রাজের সময় থেকে সরকার মন্দির-মসজিদের মতো স্থাবর সম্পত্তির উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আনতে কর আদায় ব্যবস্থা চালু করে। এই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের জায়গা থেকেই দেবস্থানের অছি পরিষদে সরকারি প্রতিনিধি রাখা শুরু হয়। সেই সংক্রান্ত কোনও মামলা মোকদ্দমা তৈরি হওয়ায় দেবতাকে আইনি দরবারে টানা শুরু হয়। ঔপনেবিশক এই প্রথা হিন্দু আইনেও বলবৎ আছে এবং কালক্রমে তা পুষ্ট হয়েছে।"