ট্যাঙ্ক আছে, কলও আছে, তবে জল আসেনি, দক্ষিণ তেলঙ্গানায়। ছবি: উজ্জ্বল চক্রবর্তী।
উত্তরে উন্নয়ন দাঁড়িয়ে। আর দক্ষিণে, ভাগের মা গঙ্গা পায় না।
সাত দিন ধরে ভোটের তেলঙ্গানায় গোটা তিরিশেক বিধানসভা কেন্দ্র ঘোরার ছবিটা এই দু’টি ছোট্ট বাক্যে পুরে ফেলা যায়।
হায়দরাবাদকে বাদ রেখে তার উত্তর-দক্ষিণের জেলাগুলির মধ্যে উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভাজন ভীষণই স্পষ্ট। এবং বেশ দৃষ্টিকটূও বটে। খোঁজ করতে করতে বোঝা গেল, উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণের এই বিভাজনের কারণ যতটা ভৌগোলিক, তার চেয়ে একটু বেশি রাজনৈতিকও। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, তেলঙ্গানা আন্দোলনের সময় কে চন্দ্রশেখর রাও (কেসিআর)-এর একচ্ছত্র নেতৃত্ব মানতে না চাওয়ার মাসুল গুনতে হচ্ছে নতুন রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলকে।
(আজকের তারিখে গুরুত্বপূর্ণ কী কী ঘটেছিল অতীতে, তারই কয়েক ঝলক দেখতে ক্লিক করুন— ফিরে দেখা এই দিন।)
নিজামের শহর পেরিয়ে উত্তরের দিকে রওনা হতেই প্রথমে পড়ে মেডচল জেলা। তার পর একে একে আসে সিদ্দিপেট, সিরসিল্লা, করিমনগর, নিজামাবাদ। মূল যে রাজ্য সড়ক এই জেলাগুলোকে চিরে এগিয়ে গিয়েছে, সেটি চার লেনের। ওই রাস্তা থেকে ডায়ে-বাঁয়ে যে কোনও দিকে ঢুকে পড়লেই একের পর এক বিধানসভা এলাকার নির্মল সব গ্রাম। রাস্তাঘাট একেবারে ‘মাখনের মতো’। বুলেভার্ডে রয়েছে রকমারি গাছপালা, বাহারি স্ট্রিট লাইট। রয়েছে গাছ পরিচর্যা করার লোকও।
প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে ট্যাপ ওয়াটারের বন্দোবস্ত। বেশ কিছু ক্ষণ অন্তর জলের ট্যাঙ্ক। মাটির নীচে নিকাশি ব্যবস্থা। কোথাও আবার গ্রামেরই ভিতরে সারি দিয়ে তৈরি করে রাখা বাড়ি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন আধুনিক সব আবাসন। গৃহহীনদের মধ্যে বিলি করা হবে এগুলো। তৈরি হচ্ছে বড় বড় কংক্রিট বাঁধানো খাল, যা দিয়ে জলাধার থেকে জল সরাসরি পৌঁছে যাবে চাষের খেতে। বর্ষার মরসুম ছাড়া অন্য সময় চাষের কাজে সুবিধা হবে।
কয়েকটি জায়গায় গ্রাম কে গ্রাম উজাড় করে তৈরি হচ্ছে সেই সব জলাধার। আর এ সব খোলা চোখে দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যতই উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সিদ্দিপেটের বাসিন্দা মাস্তান পরশুরাম বললেন, ‘‘গত চার বছরে যা কাজ হয়েছে, এখানকার মানুষজন খুবই খুশি। আমরা আবার কেসিআরকেই মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চাই। সেই কবে থেকে উনি আমাদের সঙ্গে আছেন।’’
আরও পড়ুন: মোদীর আমলে কিছুই হয়নি, দায়িত্ব নিয়েই একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন আজহার
উত্তরে উন্নয়নের এই ছবি দেখেই ক্ষোভ দানা বাঁধছে দক্ষিণে।
হায়দরাবাদ থেকে দক্ষিণের দিকে গেলে প্রথমে পড়ে ওরাঙ্গল। তার পর মেহবুবনগর, নলগোন্ডা এবং নগরকুর্নুল। এই জেলাগুলোতে পৌঁছনোর জন্য ৪৪ নম্বর জাতীয় সড়ক রয়েছে। কিন্তু, সেই সড়ক থেকে ডায়ে-বাঁয়ে নামলেই বেশির ভাগ জায়গাতেই ভাঙা রাস্তা। মেহবুবনগর জেলাসদরে দাঁড়িয়ে মহম্মদ আবদুর রউফ বললেন, ‘‘ব্যবসার কাজে গোটা রাজ্যেই ঘুরে বেড়াতে হয়। ও পাশের মতো রাস্তা তো দূরের কথা, আমাদের গ্রামেগঞ্জের পথে শেষ কবে পিচ পড়েছে, সেটাই মনে করতে পারি না।’’
আরও পড়ুন: ‘হিন্দু-মুসলমান একই ব্যবসা করি, এমন হবে কোনও দিন ভাবতে পারিনি’
জলের পাইপ দক্ষিণের অনেক গ্রামেই পৌঁছেছে। কিন্তু, জল যায়নি এখনও। নিকাশি, চাষের জন্য খাল বা জলাধার, গৃহহীন প্রকল্পের বাড়ি— কিছুই চোখে পড়ে না এই সব জেলা ঘুরলে। মেহবুবনগরের উট্টাকুট্টা গ্রামের বাসিন্দা কৃষ্ণা রাও পাহাড়ের পাথর ভেঙে কাটাই করে বিক্রি করেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার বাড়িটা ভেঙেচুরে পড়েছে। স্কুলের মাঠে তাঁবু ফেলে থাকি। সরকারের কাছে বাড়ি চাইলাম। এখনও মেলেনি।’’
উত্তর তেলঙ্গানা জুড়ে এমন ছবি হামেশাই চোখে পড়ে।
দৃশ্যগত ভাবে উত্তরের সিরসিল্লার মতো নয়া জেলা সদরের সঙ্গে দক্ষিণের বহু পুরনো জেলা সদর মেহবুবনগরের কোনও তুলনাই চলে না। ঠিক যেমন করে নিজামাবাদের সঙ্গে তুলনা চলে না নলগোন্ডার। সিদ্দিপেটও অনেকটা এগিয়ে নগরকুর্নুলের থেকে।
এই অসম উন্নয়নের পিছনে দুই অঞ্চলের ভৌগোলিক ফারাক অবশ্যই একটা কারণ। দক্ষিণে পাহাড়ি এলাকার ঘনত্ব বেশি। গড় বৃষ্টিপাত বেশ কিছুটা কম। নদীর জলের সুবিধাও একটু বেশি ভোগ করে উত্তর তেলঙ্গানা। পাশাপাশি দক্ষিণের তুলনায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর উত্তরে একটু বেশিই।
আরও পড়ুন: দলিত না ব্রাহ্মণ, আর্য না অনার্য, নাকি বনবাসী! মহাসঙ্কটে বজরঙ্গবলী
এমনিতে গোটা তেলঙ্গানা রাজ্যই দাক্ষিণাত্য মালভূমির মধ্যে পড়ে। ভৌগোলিক ভাবে এর উত্তরে রয়েছে গোদাবরী নদী। সেই নদীকে আরও ব্যবহারযোগ্য করতে সেখানকার জল তুলে জলাধারে ভরে তা খেতে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার। প্রকল্পের নাম কালেশ্বরম। ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পে একাধিক বিপুল বিপুল জলাধার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। তৈরি হচ্ছে খালও। উত্তরের এই প্রকল্প এত দ্রুততার সঙ্গে হচ্ছে যে, দক্ষিণের মানুষ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। মেহবুবনগরের গুড়িবান্দা গ্রামের চাষি বি মল্লেশ বললেন, ‘‘দক্ষিণেও তো পালামুরু লিফ্ট ইরিগেশন প্রোজেক্ট অনেক বছর ধরে রয়েছে। কই সেই প্রকল্পের উন্নতি তো চোখে দেখতে পাচ্ছি না! আলোচনা শুধুই কালেশ্বরম নিয়ে।’’
যদিও কালেশ্বরম প্রকল্পের মূল মস্তিষ্ক রাজ্যের বিদায়ী কৃষিমন্ত্রী হরিশ রাওয়ের যুক্তি অন্য। তিনি বলছেন, কালেশ্বরমের ক্ষেত্রে জল নেওয়া হবে গোদাবরী থেকে। ওই নদীতে ব্যবহারযোগ্য জল অনেক বেশি। তাই কাজের সুবিধা হচ্ছে। কিন্তু, পালামুরুর ক্ষেত্রে অসুবিধা অন্য জায়গায়। কৃষ্ণা এবং তুঙ্গভদ্রা থেকে রাজ্য খুব সামান্য জল ব্যবহার করতে পারে। তাই ওই প্রকল্পের গতি একটু শ্লথ।
আরও পড়ুন: ভক্তিতেই হোক বা ভয়ে, তেলঙ্গানার গজওয়েল জুড়ে শুধুই কেসিআর
উত্তরের তিনটি বিধানসভা কেন্দ্র— গজওয়েল, সিদ্দিপেট এবং সিরসিল্লার বিধায়ক যথাক্রমে কেসিআর, হরিশ রাও এবং কে টি রামারাও (কেটিআর)। প্রথম জন রাজ্যের বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী। দ্বিতীয় জন তাঁরই ভাগ্নে এবং রাজ্যের বিদায়ী কৃষি মন্ত্রী। আর তৃতীয় জন মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে তথা রাজ্যের বিদায়ী আইটি মন্ত্রী। কাজেই ওই তিন কেন্দ্রে যে উন্নয়নের বন্যা বইবে, তাতে আর আশ্চর্যের কি! রবি চাঁদ নামে শাসক দলের এক কর্মী বললেন, ‘‘নিজের কেন্দ্রের জন্য বিধায়করা কাজ করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এতে অন্যায় কোথায়?’’
তেলঙ্গানা আন্দোলনের সময় কেসিআর।—ফাইল চিত্র।
পাশাপাশি সিরসিল্লা থেকে আর একটু এগিয়ে উত্তরের দিকে গেলে করিমনগর কেন্দ্র। সেখান থেকে একটা সময় কেসিআর জিতে সংসদে গিয়েছিলেন। আবার পাশের জেলার নিজামাবাদ কেন্দ্রের বর্তমান সাংসদ কবিতা দেবী সম্পর্কে কেসিআরের মেয়ে। সেখানেও উন্নয়নের চিত্রটা বহিরঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে। নলগোন্ডা জেলা সদরে বসে এস নারায়ণ রেড্ডি বাবা-ছেলে-মেয়ে ও ভাগ্নের এই রাজনৈতিক সমীকরণের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্কটা তুলে ধরে বললেন, ‘‘আসলে সবটাই ভোটের রাজনীতি। নিজেদের কেন্দ্রগুলোতে জয় নিশ্চিত করতে সেখানে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন ওঁরা।’’
উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন সংক্রান্ত ভিন্ন ব্যাখ্যা শোনা গেল রাজনৈতিক বিশ্লেষক পি রাঘবেন্দ্র রেড্ডির মুখে। তিনি জানালেন, এই বিভাজনের সূত্রপাত আসলে তেলঙ্গানা আন্দোলনের সময় থেকেই। কেসিআরের বাড়ি এবং তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ড উত্তরের জেলাগুলির সঙ্গেই ছিল। সেখানকার মানুষজন তাঁর আন্দোলনের পুরোভাগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেহবুবনগর থেকে কেসিআর এক বার ভোটে লড়েছিলেন, যদিও সেই সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ ছিল। রাঘবের কথায়, ‘‘সেই সময় দক্ষিণের নেতারা কেসিআরকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। তাঁরা চাইতেন, এস জয়পাল রেড্ডি বা ডি অরুণার মতো কেউ তাঁদের মধ্যে থেকে আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠুক। দক্ষিণের এই ইচ্ছের কথা কেসিআর জানতেন। তাই মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তিনি দক্ষিণের প্রতি অতটা উদারহস্ত নন।’’
উন্নয়নের ক্ষেত্রে উত্তর, দক্ষিণের এই বিস্তর ব্যবধান নিয়েই প্রথম বিধানসভা ভোটে যাচ্ছে তেলঙ্গানা। রাজ্যের মোট বিধানসভা আসনের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই উত্তরে। এটাই বোধহয় বড় ভরসা কেসিআরের।
(ভোটের খবর, জোটের খবর, নোটের খবর, লুটের খবর- দেশে যা ঘটছে তার সেরা বাছাই পেতে নজর রাখুন আমাদেরদেশবিভাগে।)