করোলিতে বাড়ছে হিংসা।
প্রবল আক্রোশে তেড়ে আসছিল উন্মত্ত কিছু মানুষ। প্রাণরক্ষায় বছর আটচল্লিশের স্বামীহারা এক মহিলার দোকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন জনা পনেরো মানুষ। শেষ পর্যন্ত তাঁদের সন্ধান পেলেও সংখ্যালঘু মানুষগুলোকে বাঁচাতে ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন অকুতোভয় একা মহিলাই। তার জেরেই রক্ষা পেল এতগুলো প্রাণ।
রাজস্থানের করৌলীর গোষ্ঠী সংঘর্ষের তিক্ত ঘটনাতেও ঘুরেফিরে উঠে আসছে মধুলিকা সিংহ নামে ওই মহিলার নাম। স্বামীর মৃত্যুর পরে দুই সন্তানকে নিয়ে জীবনের লড়াই চালাচ্ছেন তিনি। গত পাঁচ বছর ধরে পোশাকের ব্যবসা তাঁর।
ঘটনার দিন তাঁর দোকানের সামনে দিয়েই এগিয়েছিল মিছিল। পুলিশ জানিয়েছে, লাউডস্পিকারে সংবেদশীল স্লোগানে মুখরিত ছিল মিছিলটি। সেই মিছিল সংখ্যালঘু অঞ্চলে প্রবেশের পরেই গন্ডগোলের সূত্রপাত। শুরু হয় পাথর হামলা।
মধুলিকা জানিয়েছেন, মানুষের চিৎকারের আওয়াজ কানে এসেছিল। দ্রুত আশপাশের দোকানপাট বন্ধ হতে থাকে। কী হয়েছে, আঁচ করতেই দোকানের বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। সেই সময়েই তিনি দেখেন, রাস্তায় কিছু মানুষ ছুটোছুটি শুরু করেছেন। কিছু দোকানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মধুলিকা জানান, আশপাশের দোকান বন্ধের সময়েই শুনেছিলেন গোষ্ঠী সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রাণ বাঁচাতে তাঁর দোকানে ঢুকে পড়েন কিছু মানুষ। দ্রুত দরজা বন্ধ করে দেন ওই মহিলা। সঙ্গে ভিতরে থাকা মানুষগুলোকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার বার্তাও দেন। মধুলিকার কথায়, ‘‘ওদের বাঁচিয়েছিলাম কারণ, সব কিছুর ঊর্ধ্বে মানবিকতা।’’
তাঁর দোকান যে কমপ্লেক্সটিতে, তারই শীর্ষতলে মধুলিকার ঘর। সেখানেই ওই ১৫ জনকে আশ্রয় দেন তিনি। মধুলিকা জানান, ভয়ে-আতঙ্কে থরথর করে
কাঁপছিলেন ওই মানুষগুলো। ঠিক করতে পারছিলেন না, সেখানেই থাকবেন, না কি বেরিয়ে পড়বেন। ইতিমধ্যেই সেখানে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে উন্মত্ত কিছু মানুষ। সেই সময়েই রুখে দাঁড়ান মধুলিকা।
তাঁর দৌলতে যে ১৫ জন প্রাণে বেঁচেছিলেন, তাঁদের মধ্যেই ছিলেন মহম্মদ তালিব এবং দানিশ। তাঁরা জানান, শুধু আশ্রয় নয়, তীব্র উদ্বেগের মুহূর্তে চা-জলও খাইয়েছেন মধুলিকা।
তালিবদের কথায়, ‘‘ওই উন্মত্ত লোকগুলোর হাতে ছিল লাঠি। কয়েক জন দোকানে দোকানে লুটপাটও শুরু করে। কিন্তু মধুলিকা দিদি আমাদের বাঁচিয়েছেন।’’
মধুলিকার ভাই সঞ্জয় সে দিন তাঁর মেয়েকে নিতে এসেছিলেন। তিনিও ঘটনার সাক্ষী। সঞ্জয় বলেন, ‘‘ওদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সংখ্যালঘু। পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত ওদের যেতে দেওয়া হয়নি।’’
মধুলিকার কমপ্লেক্সেই দোকান মিথিলেশ সোনির। তিনি জানান, মধুলিকার পাশে তাঁরা কয়েক জনও ছিলেন। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, আশ্রয় না পেলে ওই সংখ্যালঘু মানুষগুলো ভয়ঙ্কর বিপদে পড়তে পারেন। প্রাণ সংশয়েরও আশঙ্কা করছিলেন। তাই ওদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
করৌলী সদর বাজার মার্কেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান রাজেন্দ্র শর্মা জানিয়েছেন, বহু বছর ধরেই এই বাজারে ভিন্ সম্প্রদায়ের মানুষেরা মিলেমিশে দোকান চালাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা চাই না, এমন পরিস্থিতি তৈরি হোক, যার ফলে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি হোক। আমরা শান্তি চাই।’’
গোষ্ঠী সংঘর্ষে সামনে আসতেই চাপান-উতোর শুরু হয়েছে বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে। দুই দলই একে অপরকে দায়ী করেছে এই ঘটনায়। তবে উত্তেজনা প্রশমিত হতেই মধুলিকাদের কাহিনী
ঘিরে শুরু হয়েছে চর্চা। করোলীর ঘটনায় এর আগে এক পুলিশকর্মীর সাহসিকতাও নজর কেড়েছিল। অনেকের মতে, হিংসা, ঘৃণার অভিজ্ঞতার মাঝেও এমন মানুষদের ব্যতিক্রমী চরিত্রই প্রেরণা জোগায় ‘বেঁধে বেঁধে’ থাকার।