এই সময় শিশুদের জ্বর হলে গড়িমসি না করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রতীকী ছবি।
কোভিডের সংক্রমণ কমায় সবাই যখন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন বলে ভাবতে শুরু করেছেন, তখনই ডেঙ্গির ভাইরাস দাঁত-নখ বার করে ঘরে ঘরে হানা দিতে শুরু করেছে। হেমন্তেও ডেঙ্গির মশককুলের বাড়বাড়ন্ত চলছে। রোজই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। কলকাতা ও সংলগ্ন জেলাগুলিতে ডেঙ্গি জ্বরের দাপট নিয়ে অধিকাংশই চিন্তিত। বিশেষ করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে শিশুদের অভিভাবকদের মধ্যে।
ডেঙ্গি জ্বরের প্রবণতা ভীষণ ভাবে বেড়ে গিয়েছে। অন্যান্য বছর এই সময়টায় সাধারণ জ্বর হলেও ডেঙ্গির প্রকোপ কিছুটা কমতে থাকে। কিন্তু এ বারের পরিস্থিতিতে শিশুদের জ্বর হলে গড়িমসি না করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের নির্দেশে রক্ত পরীক্ষা করা জরুরি বলে সতর্ক করছেন ‘ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ’-এর চিকিৎসক জয়দীপ চৌধুরী। চিকিৎসকের বক্তব্য, শিশুদের জ্বরে বয়স ও ওজন অনুযায়ী প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনও ওষুধ বিশেষ করে আইব্রুফেন দেওয়া অনুচিত। কারণ, ডেঙ্গি হলে আইব্রুফেন হেমারেজের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। জ্বর যদি বেশি হয়, তখন মাথায় জলপট্টি দিতে হবে এবং ঈষদুষ্ণ জলে গা-হাত-পা স্পঞ্জ করিয়ে দেওয়া দরকার।
জ্বর যদি বেশি হয়, তখন মাথায় জলপট্টি দিতে হবে এবং ঈষদুষ্ণ জলে গা-হাত-পা স্পঞ্জ করিয়ে দেওয়া দরকার। প্রতীকী ছবি।
জয়দীপ জানালেন, যদি দেখা যায় যে শিশুদের সর্দিকাশি নেই, এ দিকে জ্বর ও গা-হাত-পা ব্যথা আছে, সে ক্ষেত্রে ডেঙ্গির কথা ভাবতেই হবে। বিশেষত পাড়ায় যদি কেউ ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তা হলে শিশু থেকে প্রবীণ, সকলকেই সাবধানে হতে হবে। কারণ এর মানে হল, বাড়ির ৫০ থেকে ১০০ মিটারের মধ্যেই ডেঙ্গির ভাইরাসবাহী এডিস ইজিপ্টা মশার ঘোরাফেরা চলছে। অত্যন্ত অল্প জলে স্ত্রী এডিস ডিম পাড়ে। এডিস মশার আর এক বৈশিষ্ট্য হল, এরা ঘন জনবসতি অঞ্চলে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে চেষ্টা করে। তাই বাড়িতে বা বাড়ির আশপাশে জল জমতে দেওয়া চলবে না, এ কথা সকলে জানলেও মানেন ক’জন! আর এই কারণেই ডেঙ্গির বাড়বাড়ন্ত। সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা আর বিকেল ৪টে থেকে সন্ধ্যা ৭টা এডিস ইজিপ্টাই সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। শিশুদের বাড়ির পাশাপাশি, স্কুলেও সচেতন থাকা জরুরি। স্কুলে লম্বা হাতার জামা ও ফুল প্যান্ট পরিয়ে পাঠানো উচিত বলে শিশুরোগ চিকিৎসক শান্তনু রায়ের পরামর্শ। মশা কামড়ানোর পর ডেঙ্গির ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করার পর কয়েক দিন ‘ইনকিউবেশন পিরিয়ড’-এ থাকে। এর পর জ্বর-সহ অন্যান্য উপসর্গ দেখা যায়। ডেঙ্গির উপসর্গকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। প্রথম পর্যায় হল ‘সিম্পল ফেজ়’।
শিশুদের যাতে ডিহাইড্রেশন না হয়, সে দিকে নজর রাখা দরকার। শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল ও জলীয় খাবার দিতে হবে। প্রতীকী ছবি।
এ সময়ে জ্বর, সর্দি, পেটে ব্যথা দিয়ে রোগের সূত্রপাত। এই অবস্থায় রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গির জীবাণু পাওয়া গেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এই সময়ে শিশুদের যাতে ডিহাইড্রেশন না হয়, সে দিকে নজর রাখা দরকার বললেন মনে করেন জয়দীপ। এই সময়ে শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল ও জলীয় খাবার দিতে হবে। আর নিয়ম করে রক্তের প্লেটলেটের সংখ্যা পরীক্ষা করাতে হবে। তবে যদি বমি হয়, তা হলে শিশুকে ভর্তি করার দরকার হতে পারে। শান্তনু জানালেন যে, যদি জ্বরের মধ্যে শিশুদের প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায় (দিনে ৭/৮ বারের কম প্রস্রাব হয়) তা হলে ঝুঁকি না নিয়ে বাচ্চাকে হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। কারণে এ বারে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত শিশুদেরও অবস্থা জটিল হয়ে উঠছে। দুই চিকিৎসকের পরামর্শ ডেঙ্গি আক্রান্ত বাচ্চার প্লেটলেট কাউন্টের সঙ্গে সঙ্গে পিসিভি বা প্যাকড সেল ভলিউম টেস্ট করিয়ে নেওয়াও জরুরি। এর সঙ্গে যদি শিশুটি জানায় যে, বুকে বা পেটে ব্যথা করছে, তা হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানো দরকার। শান্তনু জানালেন যে, ডেঙ্গিতে বুক-পেটে জল জমে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকে। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালে রেখে সঠিক চিকিৎসার সাহায্যে রোগের সঙ্গে লড়াই করা যায়। সিম্পল ফেজ়ের পর অনেক সময়ে ডেঙ্গি আক্রান্ত শিশুদের কারও কারও ক্রিটিকাল ফেজ় দেখা দিতে পারে। তাদেরই বুকে-পেটে জল জমে ও প্লেটলেট কাউন্ট কমে যায়। এ ছাড়া বমি হলে ডিহাইড্রেশন হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তাই শিশুদের জ্বর হলে ডেঙ্গি পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চললে অনেক জটিল অবস্থা প্রতিরোধ করা যায়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্রিটিকাল ফেজ়ের পরিবর্তে রিকভারি ফেজ় চলে আসে ও বাচ্চা সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু জ্বর হলে কোনও অবস্থাতেই নিজেরা চিকিৎসা করা ঠিক নয়। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি বলে মনে করাচ্ছেন চিকিৎসকরা।