Signs of Autism in children

অটিজ়ম অস্বাভাবিক নয়, কোন লক্ষণগুলি অটিস্টিকদের আলাদা করে বাকিদের থেকে, বুঝিয়ে বললেন মনোরোগ চিকিৎসকেরা

অটিজ়মের লক্ষণ ধরা পড়ে শৈশবেই। ব্যবহারে ছোট ছোট বদলকে নিছক দুষ্টুমি বা জেদ বলে এড়িয়ে যাবেন না। বাবা-মায়ের সচেতন পদক্ষেপ অটিস্টিক শিশুকেও ফেরাতে পারে জীবনের মূলস্রোতে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২৪ ১৯:১২
Share:

শিশুর মধ্যে কী কী লক্ষণ দেখা দেবে। ছবি: সংগৃহীত।

নিজের জগতে বিভোর থাকে তারা। কেউ অল্প কথা বলে, আবার কেউ কথা বলতে পছন্দই করে না। কারও সামাজিক যোগাযোগ একেবারেই নেই, বা কেউ তা করতে পারে না। কিন্তু অনেক সময়েই নিজের ভাবনায় অসাধারণ মেধার পরিচয় দেয় তারা। অনেকে আবার অসম্ভব অমনোযোগী, অস্থির মন। কথা বলার সমস্যা, নিজের ভাবনা প্রকাশ করার মতো সমস্যা যদি দেখা দিতে থাকে, তা হলেই তাকে অটিজ়মের প্রাথমিক লক্ষণ বলে থাকেন মনোরোগ চিকিৎসকেরা।

Advertisement

অটিজ়ম মনের এমন এক অবস্থা যা আর পাঁচজনের থেকে অটিস্টিক মানুষজনকে আলাদা করে। ‘অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজ়অর্ডার’ আছে যাদের, তাদের মনের অনেকগুলি স্তর থাকে। মনোরোগ চিকিৎসক শর্মিলা সরকারের মতে, “অটিজ়মের লক্ষণ শৈশব থেকেই প্রকাশ পেতে থাকে। একদম ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে তা বোঝা মুশকিল। কিন্তু দেখা যাবে, সে কখনওই চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করবে না। তার সামনে হয়তো আঙুল নাড়লেন অথবা কোনও এক দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন, দেখবেন সে হয়তো অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।” শিশু যখন বড় হতে থাকে, তখন অটিজ়মের লক্ষণ ধীরে ধীরে আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সেটা কী রকম? শর্মিলা বলছেন, মা-বাবারা যে বিষয়টি আগে খেয়াল করবেন তা হল শিশুর কথোপকথন পদ্ধতি। অটিস্টিক শিশু গুছিয়ে কথাই বলতে পারবে না। শব্দ সাজিয়ে বাক্য গঠন করতে তাদের সমস্যা হয়। কথা বলার সময় জিভ আড়ষ্ট হয়ে যাবে। জড়িয়ে যাবে কথা। আপনি যদি তার দিকে তাকিয়ে হাসেন, তা হলে সে হাসবে না। ‘সোশ্যাল স্মাইল’ যাকে বলে সেটা অটিস্টিক শিশুদের থাকে না। অর্থাৎ, কেউ হাসলে বা অভিবাদন জানালে, তার উত্তরই দিতে পারবে না তারা। হয়তো একদৃষ্টে কোনও এক দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকবে। এই সব লক্ষণ ধরা পড়ে শুরুতে।

Advertisement

অটিস্টিক শিশুদের ইচ্ছা হলে কথা বলবে, না হলে বলার চেষ্টাও করবে না। তাদের মধ্যে যারা অল্পবিস্তর কথা বলে, তারা ‘আমি’ বা ‘আমার’ মতো শব্দ ব্যবহার করে না। এই বিষয়ে মনোসমাজ কর্মী মোহিত রণদীপ বললেন, “একই শব্দ বার বার বলবে অটিস্টিক শিশু। হয়তো আপনি বললেন, ‘জল খাব’, সে-ও উত্তর দেবে ‘জল খাব’। একে বলা হয় ‘ইকোলেলিয়া’। অটিস্টিক শিশুদের মধ্যেই এমনটা দেখা যায়।”

নিজের জগৎ নিয়ে থাকবে তারা। বাড়ির একটা নির্দিষ্ট জায়গাকেই বেশি পছন্দ করবে। যে খেলনাটা তার পছন্দ হবে, সেটা নিয়েই থাকবে। অপরিচিত জায়গা, অপরিচিত মানুষজন পছন্দই করবে না। এমন অনেক অটিস্টিক শিশুকে দেখেছেন শর্মিলা যারা একা থাকতেই বেশি পছন্দ করে। মনোরোগ চিকিৎসকের কথায়, “খুব কম জিনিসের প্রতিই আগ্রহ থাকে অটিস্টিক শিশুদের। তবে যে জিনিসটি তাদের মনে ধরে, সেটা নিয়েই থাকার চেষ্টা করে। ধরুন, তার মায়ের মাথার চুল তার পছন্দ। দেখবেন, সারা ক্ষণ মায়ের চুল নিয়েই ঘাঁটাঘাঁটি করছে। সরাতে গেলেই চিৎকার করছে। আবার এমন কোনও পছন্দের খেলনা আছে যেটা কাছছাড়া করতেই চাইবে না কিছুতেই।”

খুব জোরালো আলো, উচ্চস্বরে কথাবার্তা, জোরালো আওয়াজ নিতে পারে না অটিস্টিক শিশুরা। যেখানে খুব কোলাহল, সেখান থেকে তারা সরে আসার চেষ্টা করবে। বাড়িতে যদি জোরে গান চালিয়ে দেন, দেখবেন তারা কানে হাত চাপা দিচ্ছে। অথবা তুমূল চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। তীব্র আলো বা শব্দ তাদের যন্ত্রণা দেয়।

অটিস্টিক বাচ্চাদের আচার-আচরণেও কিছু সুস্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ পায়। একে বলা হয় ‘বিহেভেরিয়াল সিম্পটম’। বেশি মানুষজন তারা কখনওই পছন্দ করবে না। মনোসমাজ কর্মী মোহিত রণদীপের ব্যাখ্যা, পরিবেশের পরিবর্তন তারা মানিয়ে নিতে পারে না। যদি চেনা-পরিচিত গণ্ডি থেকে তাদের বাইরে নিয়ে যান, তা হলে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করতে পারে। চেনা মানুষজনের বাইরে অন্য কারও স্পর্শ পেলেও তাদের সমস্যা হয়। মোহিতের কথায়, “নির্দিষ্ট কিছু রং পছন্দ করবে অটিস্টিক শিশু। দেখবেন, সেই রঙের জামাই পরতে চাইছে। চারদিকে তাদের দৃষ্টি থাকে না। একটা নির্দিষ্ট দিকেই ফোকাস করে থাকে। হয়তো পাখা ঘুরছে, সে দিকেই ঠায় তাকিয়ে থাকবে। বাইরে থেকে কোনও আলো ঢুকছে ঘরে, সেটাই দেখতে থাকবে। তখন আপনি ডাকলেও সাড়া দেবে না।” হঠাৎ করে হেসে ওঠা, লাফিয়ে ওঠা, একা একা হাসা এ সব লক্ষণও দেখা যায় অটিস্টিক শিশুদের।

অটিজ়মের কোনও চিকিৎসা পদ্ধতি এখনও অবধি নেই। মোহিত বলছেন, কোনও শিশুর মধ্যে অটিজ়মের লক্ষণ প্রকাশ পেলে নির্দিষ্ট কিছু থেরাপি করা হয়, যাতে তাদের কথা বলার সমস্যা কিছুটা হলেও ঠিক হয়। অটিস্টিক শিশুদের পড়াশোনা করানো, তাদের মধ্যে সামাজিক বোধ তৈরি করার জন্যও নির্দিষ্ট কিছু থেরাপি আছে। যেমন— ‘অকুপেশনাল থেরাপি’, ‘স্পিচ থেরাপি’, ‘স্পেশাল এডুকেটর লার্নিং থেরাপি’।

এখন দুই বা আড়াই বছর বয়স থেকেই শিশুদের স্কুলে পাঠান বাবা-মায়েরা। অটিজ়মের লক্ষণ থাকলে সেখানেও শিক্ষক বা শিক্ষিকারা তা ধরতে পারেন। বাকি বাচ্চাদের থেকে তাদের আলাদা করতে পারেন। প্রতিটি শ্রেণিতেই কিছু পড়ুয়া থাকে, যারা বাকিদের সঙ্গে পেরে ওঠে না পড়াশোনায়। আমরা ফাঁকিবাজ বা সে রকম কিছু উপমা দিয়ে তাদের চিরকালের জন্য পিছনে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। কিন্তু আর একটু মনোযোগ দিলে, তারাও হয়তো এগিয়ে আসতে পারবে বলেই মনে করেন শর্মিলা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলছেন, অটিস্টিক শিশুদের সকলেই যে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চায় তা নয়। কাউন্সেলিং করাতে করাতে তাদের মধ্যেও সমাজবোধ তৈরি হয়। অনেকেরই উন্নত স্মৃতিশক্তি, প্রখর দৃষ্টি ও যে কোনও জটিল বিষয় সহজে বুঝে যাওয়ার ক্ষমতা থাকে। অস্বাভাবিক বলে তাদের আলাদা করে দিলেই মুশকিল। অটিস্টিক শিশুদের একটু বিশেষ ধরনের যত্ন প্রয়োজন। ‘স্পেশ্যাল এডুকেশন’ দরকার। সে নিয়ে সমাজে সর্বস্তরে সচেতনতা বাড়ানো খুব দরকার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement