Noise Pollution

দুমদাম বাজির আওয়াজে কতটা ক্ষতি হয় কানের? প্রভাব পড়ে মনেও, শব্দকে জব্দ করার উপায় জেনে নিন

৮০ ডেসিবেলের শব্দ ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বেশি শুনলে কানের ক্ষতি হবেই। আর যদি এত মাত্রার শব্দ দিনের পর দিন শোনা হয়, তা হলে কানের স্নায়ু মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:৩২
Share:

তীব্র আওয়াজে কেন মাথা ঘোরে, বিরক্তি লাগে, বাঁচার উপায় বললেন চিকিৎসকেরা। প্রতীকী ছবি।

সকালে ঘুম থেকে উঠে কানে একটানা ঝিঁঝিঁর মতো শব্দ শুনতে পেতেন মানিক দত্ত। পেশায় ব্যবসায়ী। সাদা-কালো টিভিতে হঠাৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে একটানা যে তীব্র আওয়াজ হত, তার সঙ্গে যেন অনেকটা মিল রয়েছে এমন আওয়াজের। মানিকবাবু একা নন, আবাসনের আরও কয়েক জন মধ্যবয়সী ও প্রবীণ মানুষজনেরও একই সমস্যা হয়েছিল। এই ঘটনা গত বছরের। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করানোর পরে জানা যায়, আবাসনের চারপাশে লাগাতার শব্দবাজির তীব্র শব্দে এমন সমস্যা হয়েছিল কয়েক জনের। যদিও তা চিকিৎসার পরে সেরে যায়।

Advertisement

কালীপুজো ও দীপাবলির পরে অনেক রোগীই কানে শোনার সমস্যা নিয়ে আসেন, এমনটাই বললেন পিজি-র ইএনটি বিভাগের অধ্যাপক ও চিকিৎসক অরুণাভ সেনগুপ্ত। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, “৮০ ডেসিবেলের শব্দ ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বেশি শুনলে কানের ক্ষতি হবেই। আর যদি এত মাত্রার শব্দ দিনের পর দিন শোনা হয় তা হলে কানের স্নায়ু মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এক বার কানের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা ঠিক হওয়া প্রায় অসম্ভব।”

চিকিৎসক জানাচ্ছেন, কালীপুজোর পরে এমন অনেক রোগীই আসেন যাঁদের কানের পর্দা ফেটে গিয়েছে শব্দবাজির কারণে। স্থায়ী বধিরতার শিকার হয়েও আসেন অনেকে। কানের সহ্যসীমার বেশি শব্দে ঘুম কমে যায়, মাথা ব্যথা করে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, স্মরণশক্তি ও মনোযোগ কমে যায়। কানের কাছে খুব জোরে শব্দবাজি ফাটলে ‘ব্লাস্ট ইনজুরি’ হতে পারে। কানের ভিতরে যে ছোট-ছোট হাড় রয়েছে, তারও ক্ষতি করে শব্দবাজি। তখন কানে একটানা ভোঁ-ভোঁ শব্দ শোনা যায়। এর পাশাপাশি, মানসিক সমস্যাও হতে পারে। শব্দবাজি যে কেবল কানের ক্ষতি করে তা নয়, তীব্র আওয়াজ যদি একটানা কেউ শুনতে থাকেন, তা হলে বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরার মতো সমস্যাও হতে পারে।

Advertisement

আইনের এত কড়াকড়ি সত্ত্বেও শব্দবাজি নিষিদ্ধ হল কই! এমনিতেও সারাদিন যানবাহনের আওয়াজ, মাইকের আওয়াজ, পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা লাউড স্পিকারের তীব্র শব্দে কান-মাথা ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম হয়। তার উপরে শব্দবাজির দুমদাম শব্দে কান-মাথার যন্ত্রণা আরও বাড়ে। অনেকেরই এই শব্দে প্রচণ্ড বিরক্তিবোধ হয়, মাথা যন্ত্রণাও শুরু হয়। আর যাঁদের মাইগ্রেনের সমস্যা আছে, তাঁদের তো কষ্ট আরও বেশি।

শব্দবাজি আদতে দু’ভাবে কানের ক্ষতি করে থাকে। প্রথমত, শ্রবণযন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দ্বিতীয়ত, শব্দবাজির ধোঁয়া থেকে নাক ও গলা জ্বালা হতে পারে। এ ছাড়া, শ্বাসকষ্টের ব্যাপার তো রয়েছেই। এই বিষয়ে নীল রতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ইএনটি এবং হেড-নেক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক-অধ্যাপক প্রণবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “কানের সূক্ষ্ম কোষ নষ্ট হয়ে যায় শব্দবাজির তীব্র আওয়াজে। প্রচণ্ড কম্পাঙ্কের শব্দকে কানের কোষগুলি ইলেকট্রিকাল ইমপালসে বদলে দেয়। তখন কানের কোষগুলি হয় আচমকাই কাজ করা কমিয়ে দেয়, না হলে একেবারেই বন্ধ করে দেয়। এর নানা রকম প্রভাব পড়ে শরীরে।”

কানের কাছে দু’-এক বার চকোলেট বোমা ফাটলে যে কেউ বধির হয়ে যাবেন, তা নয়। তবে তীব্র শব্দ যদি রোজ শুনতে থাকেন বা একটানা অনেক ক্ষণ ধরে তা হলে তার প্রভাব পড়বে। সেটা কী রকম? প্রণবাশিসবাবু জানাচ্ছেন, দু’রকম প্রভাব পড়েছে।

১) ‘টেম্পোরারি থ্রেশহোল্ড শিফ্‌ট’ অর্থাৎ, কম সময়ের জন্য কানে শুনতে না পাওয়া অথবা কান ভোঁ-ভোঁ করা। আচমকা তীব্র শব্দে বাজি ফাটলে অথবা জোরালো শব্দ শুনলে কিছু ক্ষণের জন্য মনে হতে পারে কানে কম শুনছেন। এই সমস্যা এক দিনেই ঠিক হয়ে যেতে পারে।

২) ‘পার্মানেন্ট থ্রেশহোল্ড শিফ্‌ট’ যাতে পাকাপাকি ভাবে কানের ক্ষতি হয়। বধিরতা চিরস্থায়ী হয়ে যেতে পারে। দীপাবলির পরে এমন সমস্যা নিয়েও অনেকে আসেন।

তীব্র শব্দে যে বিরক্তি আসে অথবা শরীরে কষ্ট হয়, তারও কারণ আছে। চিকিৎসকের ব্যাখ্যা, যাঁদের রেললাইনের ধারে বাড়ি অথবা পেশাগত ভাবে এমন জায়গায় দিনভর থাকেন, যেখানে তীব্র শব্দ বা একটানা কোলাহল শুনতে হয়। এতে অজান্তেই শ্রবণশক্তির ক্ষতি হতে থাকে। তা ছাড়া, আজকাল সারা ক্ষণ কানে হেডফোন বা ইয়ারফোন গুঁজে থাকার অভ্যাস আছে অনেকেরই। উচ্চস্বরে কানে আওয়াজ নিতে নিতে কখন যে কান ও মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়, তা বুঝতেই পারেন না তাঁরা। এর উপর হঠাৎ করেই শব্দবাজির তীব্র আওয়াজ কানে গেলে তখন নানাবিধ সমস্যা শুরু হয়। কানে কম শোনা, মাথা যন্ত্রণা, বুক ধড়ফড় করা এমনকি মানসিক সমস্যাও হতে পারে।

শব্দকে জব্দ করার উপায় কী?

১) অরুণাভ বাবুর কথায়, সচেতন ভাবেই শব্দবাজি না ফাটানোই উচিত। কলকাতায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কোনও সরু রাস্তায় বা গলির মধ্যে ক্রমাগত শব্দবাজি ফাটানো হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ওই শব্দতরঙ্গ আশপাশের বাড়ির দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে সজোরে কানের উপর এসে পড়ে। তাতে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও বয়স্কদের।

২) প্রণবাশিস বাবুর পরামর্শ, শব্দবাজি যদি ফাটাতেই হয়, তা হলে ফাঁকা জায়গায় বা যেখানে জনবসতি নেই তেমন জায়গায় গিয়ে ফাটানো উচিত।

৩) বাড়িতে শিশু বা বয়স্করা থাকলে দরজা-জানলা ভাল করে বন্ধ রাখলে ভাল হয়, যাতে তীব্র আওয়াজ ভিতরে না আসে। প্রয়োজনে ইয়ার প্লাগ লাগিয়ে নিন কানে।

৪) প্রণবাশিস বাবু বলছেন, ইয়ারফোন বা হেডফোনের ব্যবহার কমান। উচ্চস্বরে শব্দ এমনিতেই কানের ক্ষতি করছে। তাই হঠাৎ কোনও জোরালো শব্দ শুনলে তা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করতে পারে কানের।

৫) আপনি যে এলাকায় রয়েছেন সেখানে যাতে শব্দবাজির দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যায়, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করুন। প্রয়োজে প্রশাসনের সাহায্য নিন। কোনও কিছুই সম্ভব না হলে শব্দবাজি যেখানে ফাটছে সে জায়গা থেকে দূরে থাকারই চেষ্টা করুন।

৬) শব্দবাজি কেবল মানুষের জন্য পশুপাখিদের উপরেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। তাই শব্দবাজি কেনা বা ফাটানো থেকে বিরত থাকুন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement