অত্যাধিক
রাত ১টা। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর পরে ওয়েব সিরিজ় দেখেন রাহুল। বাড়ি, অফিসের কাজ সামলে স্ত্রী শ্রমণার নজর সমাজমাধ্যমে। মেয়ে, একাদশ শ্রেণির লাবণ্য ভিডিয়ো দেখে পড়াশোনা করে। ঘুম সবারই মেরেকেটে চার ঘণ্টা।
এই দৃশ্য এখন প্রায় প্রতিটি ঘরে। ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র জানাচ্ছে, কোভিড শুরুর সময় থেকে ৫১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ও ৬৭ শতাংশ শিশু-কিশোরের মধ্যে ‘স্ক্রিন টাইম’ বেড়েছে। আর সেটা বেড়েছে প্রায় ৫০-৭০ গুণ! পাল্লা দিয়ে কমেছে ঘুম। কোভিডের প্রকোপ কমলেও, স্ক্রিনে নজর কমছে না কেন, তা চলতি বছর ১৭ মার্চ ‘বিশ্ব ঘুম দিবস’-এর আগে ভাবাচ্ছে সংশ্লিষ্ট নানা পক্ষকে।
সমস্যা যে গুরুতর, তা বোঝাচ্ছেন ইএনটি স্লিপ অ্যাপনিয়া সার্জন এবং ‘ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটি’-র সদস্য উত্তম আগরওয়াল। তিনি জানাচ্ছেন, লকডাউন-পরবর্তী সময়ে আমরা অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফিরেছি। কিন্তু দিনান্তের অবসরে সঙ্গী হচ্ছে ল্যাপটপ বা মুঠোফোন। আর তা করতে গিয়ে ঘুম বিষয়টিই আমাদের কাছে যেন অনেকটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। এই প্রবণতার নামই হল ‘রিভেঞ্জ স্লিপ প্রোক্রাস্টিনেশন’।
বস্তুত, ঘুম ও স্ক্রিনে নজরের মধ্যে একটি বিপরীত সম্পর্ক রয়েছে। চিকিৎসক সুবীরকুমার মণ্ডল জানাচ্ছেন, গ্যাজেটের স্ক্রিন থেকে বেরোনো নীলচে আলো ঘুমের হরমোনের (মেলাটোনিন) কাজকর্মে প্রভাব ফেলে। ফলে, স্বাভাবিক সময়ের থেকে বেশ দেরিতে ঘুম আসে। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে দৈনন্দিন কাজে ভুল, খিটখিটে হওয়া, ভুলে যাওয়া, মাথা ধরার মতো নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে জানাচ্ছেন ঘুম-রোগ বিশেষজ্ঞ ও ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটির সদস্য সৌরভ দাস। সৌরভের সংযোজন, ‘‘সমস্যাটা দীর্ঘদিন চললে মানসিক রোগও দেখা দিতে পারে।” বাড়তে পারে ওজন, হৃদ্রোগ, ডায়াবিটিসের আশঙ্কা। যার প্রভাব পড়তে পারে কর্মক্ষমতায়।
ঘুম সংক্রান্ত নানা সমস্যার শিকার হচ্ছে স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা, পর্যবেক্ষণ নাক-কান-গলার চিকিৎসক দীপঙ্কর দত্তের। তিনি এ-ও জানাচ্ছেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে বেশ কিছুটা বেড়েছে ঘুমের সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা। এনসিইআরটি-র একটি সমীক্ষাতেও দেখা গিয়েছে, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ৮১ শতাংশ পড়ুয়া ঘুমের অভাবে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপে ভুগছে।
পাশাপাশি, চিকিৎসক উত্তমেরও পর্যবেক্ষণ, ৬৫ বছর ও তার বেশি বয়সিরা অনেক সময়েই দিনে বার বার অল্প করে ঘুমিয়ে থাকেন। রাতে তাঁদের স্বাভাবিক ভাবেই কম ঘুম হয়। এর সঙ্গে যদি স্ক্রিনে নজর বাড়ে, তা হলে এই ‘কম ঘুম’ কার্যত ‘বিনিদ্র রজনীতে’ পরিণত হতে পারে। তা হচ্ছেও অনেক সময়ে। চিকিৎসকদের একাংশই জানাচ্ছেন, অনেক সময় বয়স্ক রোগীদের রাতে বই পড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা বই পড়ছেন স্ক্রিনেই! কারণ, সুবীরবাবুর মতে, তাঁরা এ ক্ষেত্রে পড়ার হরফ ছোট-বড় করা বা পছন্দ মতো আলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন।
অর্থাৎ, এই স্ক্রিনে পড়া বা স্ক্রিনে নজরের সঙ্গে একটি ‘সুবিধা’র ধারণা রয়েছে। এই সূত্রটি নিয়েই ভাবছেন সমাজবিজ্ঞানী অভিজিৎ মিত্র। তাঁর মতে, ‘স্ক্রিন’ মানুষের সম্পর্ক, পারিবারিক বন্ধনের মাঝে চলে আসছে, ঘুমের ক্ষতি করছে, এটা ঠিক। কিন্তু নতুন যোগাযোগ ও পুরনোসম্পর্ককে মজবুত করতেও সাহায্য করে এটি। পড়াশোনা থেকে বাজার করা, সবই এখন অনেকটাই ‘স্ক্রিন’-নির্ভর। ফলে ‘নিজের মতো’ করে সময় কাটানোর জন্য গ্যাজেটের জুড়ি মেলা ভার।
তা হলে উপায়? চিকিৎসকেদের পরামর্শ, দিনভর একটি নির্দিষ্ট রুটিন মেনে চলতে হবে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে কমাতে হবে গ্যাজেটের ব্যবহার। তা না হলেই বিপদ।