আজও ‘লেট’। জীবনের শেষ যাত্রাতেও বরাবরের মতো লেট আমি। বিলেতফেরত ছোকরা ডাক্তার। শেষ অবধি চেষ্টা করে গেল যদি আমাকে বাঁচানো যায়। আর যমদূত তো সেই সকাল থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। যমে-ডাক্তারে টানাটানিতে আমারই বেফালতু কতকটা সময় নষ্ট হয়ে গেল। শেষমেশ পড়ন্ত বিকেলে বৈতরণীর তীরে পৌঁছে দেখি, গরুগুলো গোয়ালে ফিরে গিয়েছে, আজ আর পার হওয়ার কোনও আশা নেই। কাল সকালের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। গত্যন্তর না দেখে এক বুড়ো মাঝিকে অনেক হাতে-পায়ে ধরে আর একশো টাকার একটা কড়কড়ে নোট দিয়ে রাজি করালুম। মৃত্যুর পরে অন্তত কেন এ সব দুর্নীতিকে আর উৎসাহিত না করাই বাঞ্ছনীয় বোঝাতে বোঝাতে দাঁড় টানছিলেন মাঝি। ও পারে গিয়ে দেখি আমাদের জন্যে যে চার্টার্ড বাসটা রাখা ছিল, সেটাও চলে গিয়েছে। তার পর যে কত কাঠখড় পুড়িয়ে যমপুরীতে পৌঁছুলাম কী বলব! রাস্তা জুড়ে ঢাউস দুটো দ্বার। খুবই পুরনো আর বিতিকিচ্ছিরি নকশা। সামনে একটা কাঠের চেয়ারে বিশাল বপু এক ব্যক্তি যাত্রাপার্টির মতো ঝলমলে পোশাক পরে বসে আছেন। মাথায় শিরস্ত্রাণ। হাতে মোটা লম্বা লাঠিজাতীয় কিছু হবে। নজরে আসতেই বললেন, ‘‘এখানেও ‘লেট’? স্কুলে ‘লেট’, অফিসে ‘লেট’, এমনকি প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে যেতে— সেখানেও ‘লেট’। তা বলে যমপুরীতেও ‘লেট’?’’
আমি কাঁচুমাচু মুখ করে বললাম, ‘‘সরি স্যর!’’
তার পর সব দোষ ডাক্তারের ঘাড়ে দিতে যাচ্ছিলুম আর কি।
তিনি বললেন, ‘‘থাক, আর অজুহাত দিয়ে কাজ নেই। আমাকে নিষ্কৃতি দাও। দাঁড়াও। আগে দেখে নিই তোমার জন্য কী বরাদ্দ? স্বর্গ না নরক?’’
—তাই তো বটে! দরজা তো দুটো দেখছি। কিন্তু, আমি তো জানিই না কোথায় ঢুকব।
—তোমার জানার কথাও নয়। রোসো। চিতু, চিতু, এই চিত্রগুপ্ত?
হাঁক শুনে পড়িমরি করে যে শুঁটকো মতো লোকটা এসে দাঁড়ালেন, বুঝলাম তিনিই চিত্রগুপ্ত।
বিশালাকায় লোকটি জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এ কোথায় যাবে, চিতু? স্বর্গ না নরক?’’
—আজ্ঞে?
—কী আজ্ঞে আজ্ঞে করছ? বলছি, পাপ বেশি না পুণ্য বেশি? সেই অনুযায়ী তো ঠিক হবে, কোথায় পাঠানো হবে, না কি?
—আজ্ঞে, তখন থেকে সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না। ব্যাটার পাপ-পুণ্য, কী বলব, একদম সমান সমান। হিসেবটা তাই বার বার মিলিয়ে দেখছিলাম। ভুলচুক হয়নি তো!
—হ্যাঃ! তা কী করে হবে? তবে তোমার যা ওই লড়ঝড়ে পুরনো দাঁড়িপাল্লা। দেখো, ওটা ঠিক মতো কাজ করছে কি না।
—না স্যর। গত মাসেই তো নতুন ‘ইলেকট্রনিক স্কেল’ না কী কেনা হল। সেটা দিয়েই মেপে দেখেছি। একদম ভগ্নাংশের পর অবধি মিলে যাচ্ছে।
—তা হলে?
—বলছিলাম স্যর, একটা কাজ করলে হয় না?
—কী কাজ?
—ওকে ওর বরাদ্দ সময়ের অর্ধেক নরকে আর অর্ধেক স্বর্গে রাখলে কেমন হয়?
—মূর্খ! মানুষের এই স্বর্গ বা নরকবাস কত দিনের জন্য বরাদ্দ হয় জানো?
—আজ্ঞে জানি হুজুর।
অনন্তকালের জন্য যাকে বলে কি না ‘ফর ইনফাইনাইট টাইম’।
—তা হলে দাঁড়াল কী? অসীমকে দুই দিয়ে ভাগ করলেও সেটা অসীমই থাকে। তার মানে স্বর্গে অসীম সময়ের জন্য থেকে আবার একই ব্যক্তির পক্ষে নরকে অসীম সময় কাটানো কি সম্ভব? তুমি বরং অন্য কিছু ভাবো। আমি মিউ মিউ করে বললাম, ‘‘আমি কি একটা প্রস্তাব দিতে পারি?’’
ঘাড় ঘুরিয়ে ভদ্রলোক এমন ভাবে তাকালেন যে আমার নিজের উপর ভারী রাগ হতে লাগল। কেন বাপু? পরশু রাতে যখন পল্টুর সঙ্গে বসে যখন মদ খাচ্ছিলাম, একটা পেগ বেশি মেরে দিলেই হত। সামান্য হলেও পাপের দিকে কাঁটাটা ঝুঁকে যেত। অথবা, কাল ট্রাফিক সিগনালে, বুড়ি ভিখারিনিকে দশ টাকার একটা ছেঁড়া নোটের বদলে কড়কড়ে সবুজ রঙের পঞ্চাশ টাকার নোটটা দিলেই হত। ল্যাটা চুকে যেত। ও দিকে পুণ্যিটা একটু বেশি হত। আর এত ঝক্কি পোয়াতে হত না।
এ বার তিনি মুখ খুললেন। বললেন, ‘‘বলো, তোমার প্রস্তাবটা শুনে দেখি।’’
আমি বললাম, ‘‘টস করুন না। টসে যা ফল হবে, আমি সেটাই মেনে নেব।’’
শুনে চিত্রগুপ্ত যেন হাতে চাঁদ পেয়েছেন এমন মুখ করে বললেন, ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ভাল। আমি দেখেছি। মর্ত্যে কোনও কোনও খেলার আগে, একটা ধাতব মুদ্রা উপরে ছুড়ে দেওয়া হয়। ওটাকেই ‘টস’ বলে। ভদ্রলোকের বোধহয় তাড়া ছিল। বললেন, ‘‘যাও, চট করে একটা মুদ্রা নিয়ে এসো দেখি।’’
বলতে না বলতে, চিত্রগুপ্ত সাহেব শূন্য থেকে একটা কয়েন এনে ওঁর হাতে দিলেন।
ভদ্রলোক কয়েনটি হাতে নিয়ে উলটে-পালটে দেখলেন, তার পর ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের উপর রেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘বলো, মস্তক না লাঙ্গুল?’’
আমি বললাম, ‘‘আমার কোনও পছন্দ নেই। আপনিই যা হয় একটা বেছে নিন।’’
এ বার তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘‘তা বললে কি হয় বাছা! যা হোক কিছু তো আমি তোমায় দিতে পারি না। আমি একদেশদর্শীও নই, খেয়ালিও নই। সব কিছুর একটা ব্যাখ্যা থাকতে হবে তো!’’
শুনে চিত্রগুপ্ত দুম করে বলে বসল, ‘‘আমি বলছি, স্যর। মস্তক— স্বর্গ, লাঙ্গুল— নরক। কি, ঠিক আছে?’’ বলে আমার দিকে চাইলেন।
আমি মুচকি হেসে ঘাড় নাড়লাম।
লোকটা টস করতে গিয়েও কী ভেবে থেমে গেলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এ ব্যবস্থায় তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?’’
—নাহ, আপত্তি থাকবে কেন? এ তো উত্তম ব্যবস্থা।
—তা হলে, হাসলে কেন?
—না না। এমনিই হাসলাম।
—এমনি এমনি তো আর কেউ হাসে না। বলে ফেলো তো বাপু। বিষয়টা কী? আমার কাছে কিছুই লুকিয়ে রাখতে নেই।
—সত্যি বলছি, তেমন কিছু না। আমার যে হেতু পাপ-পুণ্য সমান সমান, তাই আমার কাছে স্বর্গ কিংবা নরক— দুটোই সমান পছন্দের। আমি ভাবছি আপনার কথা।
—বলো কী হে বালক? তুমি আমার কথা ভাবছ? কী ভাবছ বলো তো?
—আজ্ঞে অপরাধ নেবেন না তো, স্যর?
—না নেবো না, বলো।
—বলছি আপনি তো সর্বশক্তিমান। আর মহাবিশ্বের সব কিছুই আপনি সৃষ্টি করেছেন। সে তো আর এমনি এমনি করেননি। নিশ্চয়ই সৃষ্টির পিছনে এক মহান উদ্দেশ্য আছে।
—হ্যাঁ, আছে।
—আর তাই, মহাবিশ্বে ঘটে চলা সমস্ত ঘটনাপ্রবাহই আপনি নির্ধারণ করে রেখেছেন, বিশ্বসংসার আদতে নিয়ন্ত্রণবাদী। আর, সব কিছুরই এই যে পরিণতি নির্ধারণ তারও তো একটা সুসংবদ্ধ নিয়মকানুন আছে। তাই কি না?
—ঠিক!
—তা হলে এই যে এখন টসের মাধ্যমে আপনি আমার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে চলেছেন, এতে আপনারই নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকছে না যে। তার কারণ টসের ফল সম্ভাবনানির্ভর। অর্থাৎ, যা খুশি বা র্যান্ডম। প্রকৃতিতে অবশ্য এর অনেক উদাহরণ আছে। যেমন তেজষ্ক্রিয়তাতে কোনও পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ক্ষয় হবে আর কে অক্ষয় থাকবে, কিংবা কোনও মাধ্যমের উপর আপতিত ফোটন, সেটি প্রতিসরিত হবে না প্রতিফলিত হবে— এ সব নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে না। থাকে কেবল সম্ভাবনা।
—তো!
—আপনার অস্তিত্বের ধারণাটাই যে ধাক্কা খাচ্ছে স্যর।
উনি আর কথা বাড়ালেন না। বিষয়টা বোধহয় বুঝতে পেরেছেন। কী অদ্ভুত ব্যাপার। এর পর থেকে উনি ধীরে ধীরে ফিকে হতে লাগলেন। ফিকে হতে হতে এক সময় সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেলেন। কোথায় সেই স্বর্গ-নরকের দ্বার। কোথায় আর বাকি সব! আমার সামনে, পিছনে, ডাইনে, বাঁয়ে এখন ধূ ধূ প্রান্তর। অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। আমি এগিয়ে চলছি। চলছি তো চলছি। খেয়াল করিনি কখন আমার দু’চোখ জলে ভরে গিয়েছে।