শুটের ফাঁকে টিম 'রাণী রাসমণী'। নিজস্ব চিত্র।
আশঙ্কা ‘সত্যি’ হল। টেলিপাড়াতেও থাবা করোনার। স্টুডিয়োপাড়ায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে,মেকআপ আর্টিস্ট, অভিনেতা সহ ১৪ জন (ফেডারেশনের মতে ৬ জন) সংক্রমিত। সরকারি সতর্কতা অবলম্বনে ফাঁকি নেই, মত অভিনেতা থেকে মেকআপ আর্টিস্টদের। তা হলে বজ্র আঁটুনি কী ভাবেফস্কা গেরোহল? নাকি ব্যক্তিগত স্তরে সতর্কতার অভাব এমন পরিস্থিতি তৈরি করল?
ইন্ডাস্ট্রিতে কি জোড়াতাপ্পি দিয়ে কাজ শুরু হয়েছে?
সংক্রমণের ভয়ে গোটা জুন মাস কাজ করেননি অভিনেতা দেবযানী চট্টোপাধ্যায়। প্রযোজকদের সরাসরি জানিয়ে একটি মাস ধারাবাহিক ‘ত্রিনয়নী’-তে অনুপস্থিত ছিলেন। জুলাই থেকে নতুন মেগা ‘যমুনা ঢাকি’ দিয়ে আবার ফ্লোরে ফিরেছেন। তার আগে শুনেছিলেন, চূড়ান্ত সতর্কতা মানা হচ্ছে সর্বত্র। ফলে, আশ্বস্ত দেবযানী।
কিন্তু এক মাসের মধ্যেই তাঁর ভয় ‘বাস্তব’ হয়ে দাঁড়াল। কোনও রাখঢাক না রেখেই দেবযানী একাধিক কারণ সামনে আনলেন, ‘‘প্রযোজকেরা সতর্কতা মানছেন না, এ কথা বলব না। কিন্তু টলিপাড়ায় অর্থ এবং পরিকাঠামোর যথেষ্ট অভাব। তার মধ্যে থেকে যতটা স্যানিটাইজেশন করা যায়, প্রোডিউসারেরা স্টুডিয়োর আনাচেকানাচে সেটা করছেন। কিন্তু হেয়ার ড্রেসার বা টেকনিশিয়ান পিপিই কিট পড়ছেন? না, বা পরতে পারছেন না তাঁদের কাজের ধরনের জন্য। এ দিকে আমরা মাস্ক পরে শট দিতে পারছি না।’’ দেবযানীর কথায়:‘‘পরিচালক যদি ‘সাজেশনস প্রেফারেন্স’ শট দিতে বলেন সেটাও আমরা দিতে বাধ্য। ফলে, আমাদের প্রচুর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। বহু টেকনিশিয়ান প্রোডাকশনের গাড়িতে আসছেন না। তাঁরা হাত স্যানিটাইজড করে কাজ করলেও সংক্রমণ তাঁদের থেকে ছড়াচ্ছে না, এই গ্যারান্টি কে দেবেন?’’
যে ইউনিটে সংক্রমণ ধরা পড়ছে সেই ইউনিটের বাকিদের কোভিড টেস্ট হচ্ছে? পাল্টা প্রশ্ন অভিনেত্রীর। উত্তরটাও দিয়েছেন তিনি,‘‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হচ্ছে না। যেটা আশু প্রয়োজন।’’ এ জন্য কী পদক্ষেপ করা উচিত? দেবযানী বলছেন, ‘‘সবার আগে সমস্ত সংগঠনের উচিত বসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে ভীষণ জোড়াতাপ্পি দিয়ে কাজটা শুরু হয়েছে। কাজটা তো শুরু করে দেওয়া হোক...এই ভাবনা নিয়ে। এখন কোনও আর্টিস্ট বা কলাকুশলীর করোনা পজিটিভ হলে ‘এনওসি’ দিইয়ে নিয়ে অন্যদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। নায়ক-নায়িকার হলে তখন এই পদক্ষেপ কাজে আসবে তো? তখন কী হবে?’’
শ্যামা-নিখিল জুটি
এবার ব্যক্তিগত স্তরে সতর্ক হতে হবে
দেবযানী চট্টোপাধ্যায়ের মতের একদম ভিন্ন সুর শোনা গেল অভিনেতা, প্রযোজক ভরত কলের গলায়। ভরত কিন্তু পিপিই কিট, কোভিড টেস্ট, প্রোডাকশনের গাড়ির বিষয়ে অন্য কথা বললেন।
কী যুক্তি তাঁর? ভরতের কথায়: ‘‘ডাক্তারবাবুরা পর্যন্ত বলছেন, কোভিড রোগীর সংস্পর্শে না আসতে হলে পিপিই কিটের কোনও দরকার নেই। ফলে, পিপিই কিট না পরলেই রোগ ছড়াচ্ছে, এমনটা ভাবা বোধহয় ঠিক নয়।’’ তাঁর যুক্তি, একজন অভিনেতার থেকে আর এক অভিনেতার সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কিন্তু টেকনিশিয়ানদের থেকে অভিনেতার সংক্রমণ ছড়াবে না। কারণ, টেকনিশিয়ানরা সব সময়েই মাস্ক, ফেসশিল্ড পরে থাকছেন। বারবার হাত স্যানিটাইজড করছেন।
তাহলে রোগ ছড়াচ্ছে কী করে? প্রযোজক-অভিনেতার দাবি, ‘‘ব্যক্তিগত স্তর থেকে হতেই পারে। ফ্লোর যে ভাবে স্যানিটাইজড করা হচ্ছে তাতে সংক্রমণ হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রত্যেকেই তো বাজারে, দোকানে বা আশপাশের বাড়িতে যাচ্ছেন। তার থেকে যে তাঁর শরীরে সংক্রমণ আসছে না, কে বলতে পারে? বাড়িতে বসেও কিন্তু কোভিড হচ্ছে। নিসপাল সিংহ রানের পরিবারকেই দেখুন।’’
ভরতের দাবি, যে ইউনিটে সংক্রমণ ছড়িয়েছে তার প্রত্যেক সদস্যের কোভিড টেস্ট কি সম্ভব? তাহলে তো দু’দিন অন্তর টেস্ট করতে হয়! কারণ, আজ ধরা না পড়লেও কাল পড়তেই পারে। অর্থের দিকটিও তো মাথায় রাখতে হবে।
প্রোডাকশনের গাড়িতে যাতায়াতের প্রসঙ্গে ভরতের পাল্টা যুক্তি, ‘‘একজন বেহালায় থাকেন। একজন সোনারপুর। একজন দমদম। এঁদের কী করে বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে আসবে? হয় এঁদের একটা নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত প্রাইভেট গাড়িতে আসতে হবে। নয়তো পুরোটাই। প্রযোজকের পক্ষে কখনওই সম্ভব নয়সবাইকে বাড়ি থেকে আনা নেওয়ার জন্যদিনে ১০-১২টি গাড়ি তৈরি রাখা। তাছাড়া, যাঁরা প্রাইভেট গাড়িতে আসছেন তাঁদের কিন্তু জোনে ঢোকার আগে পুরোটা স্যানিটাইজড স্প্রে করা হচ্ছে। ফলে, জীবাণু থাকার আশঙ্কা অনেকটাই কম।’’
এতর পরেও কোভিড ছড়াচ্ছেই। সমাধান কী? অভিনেতার অভিজ্ঞতা বলছে, সময় এসেছে ব্যক্তিগত স্তরে সতর্ক হওয়ার। প্রত্যেকে পরিচ্ছন্ন থাকুন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান, কাজ হলেই বাড়ি ফিরে যান, ভিড় করবেন না কোথাও, মাস্ক ছাড়া বাইরে বেরোবেন না। দরকার ছাড়া রাস্তায় এখন না-ই বা বেরোলেন সবাই। তাহলে হয়তো এড়ানো সম্ভব অনেকটাই।
তবে একটি ব্যাপারে দেবযানীর সঙ্গে ভরতসহমত, কাজ বন্ধ করা সংক্রমণ ঠেকানোর ইতিবাচক পদক্ষেপ নয়।
কেন শুটিং স্পটকে দায়ী করা হচ্ছে সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য?
টেকনিশিয়ান, অভিনেতারা বাজার,শপিং মলে যাচ্ছেন না?
আনন্দবাজার ডিজিটালকে এক সাক্ষাৎকারে অভিনেত্রী সৌমিলি বিশ্বাস জানিয়েছিলেন, সংক্রমণের ভয়ে তিনি এখনই কাজ শুরু করবেন না। সেই সময় ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়, ভরত কল, সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়-সহ নবীন এবং প্রবীণ ব্রিগেড স্বতঃস্ফূর্ত রায় দিয়েছিলেন শুটিংয়ের পক্ষে।
তা হলে কি সৌমিলি বা আর যাঁরা কাজে রাজি হননি তাঁরাই ঠিক?‘বাবা লোকনাথ’ ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘অন্যদের কথা বলতে পারি না, তবে আমার সিরিয়ালের ক্ষেত্রে স্পর্শজনিত কোনও অভিনয়ের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম বা মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদের ক্ষেত্রে বাবা লোকনাথ ম্যানিকুইন ব্যবহার করছেন। টেলিকাস্টে সেটা লেখাও হচ্ছে। তাই আমার মতে, ইন্ডাস্ট্রিতে সংক্রমণ ছড়িয়েছে সম্ভবত অন্য ভাবে।’’
কী সেই নেপথ্য কারণ? অভিনেতা সরাসরি আঙুল তুললেন একদম ভিন্ন দিকে, ‘‘যাঁরা এখানে কাজ করছেন তাঁরা কি শুধুই শুটিং জোনে আসছেন আর বাড়ি যাচ্ছেন! আর কোথাও যাচ্ছেন না? এর উত্তর কে দেবে? কেন শুটিং স্পটকে দায়ী করা হচ্ছে সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য? টেকনিশিয়ানরা কি দোকান-বাজার যান না? অভিনেতারা কি শপিং মলে একদিনের জন্যও যাননি? কারও বাড়ি যাননি, আড্ডা মারেননি, হতে পারে?’’
ভাস্বরের বক্তব্য, ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়োয় ‘বাবা লোকনাথ’-এর শুট চলছে নিয়মিত। এখনও তো সংক্রমণ ছড়াল না!ইন্দ্রপুরী, ইন্ডিভান স্টুডিয়োতেও কিন্তু সংক্রমণের খবর নেই। অর্থাৎ, এর জন্য শুধুই স্টুডিয়োপাড়া দায়ী এমন অভিযোগ তোলা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। যাঁরা সংক্রমিত তাঁরা সবাই দাসানি স্টুডিয়ো ২-এ কাজ করছিলেন। হতে পারে, তার আশপাশে সংক্রমণ ছড়িয়েছে বেশি।
শুটের ফাঁকে
নিজে বাঁচলে বাকিরাও বাঁচবেন...
আরও ভয়াবহ অবস্থা অভিনেত্রী দেবলীনা দত্তের। টেলিপাড়ায় সংক্রমণ। সংক্রমণ ছড়িয়েছে তাঁর পাশের বাড়িতেও। এমন সাঁড়াশি চাপে পড়ে ভয় পাচ্ছেন অভিনেত্রী? দেবলীনার উত্তর: ‘‘ভয় পেয়ে আর লাভ নেই। এখন একটাই পথ, নিজে বাঁচলে অন্যরাও বাঁচবে। যার জন্য নিজেকে সবার আগে রোগমুক্ত রাখতে হবে।’’ তিনি বললেন,‘‘এই মুহূর্তে টেলি ফিল্মের কাজ আছে আমার হাতে। ডেলি সোপের নেই। থাকলে আমার ইউনিটের কেউ আক্রান্ত হলে আমি নিজেকে আগে টেস্ট করাবো। কোভিড মুক্ত থাকলে কাজ করতে আসব। না থাকলে ১৪ দিন বাড়ি থাকব। সুস্থ হব। তারপর আবার কাজের জায়গায়। কিন্তু কাজ বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষপাতী আমি একেবারেই নই।’’
ইউনিটের সোয়াব টেস্টের ব্যবস্থা শুরু হবে
সরকারি নির্দেশিকা মেনে চলার পরেও ১৪ জন আক্রান্ত কী ভাবে? এই প্রশ্ন ফেডারেশনের সম্পাদক স্বরূপ বিশ্বাসকে করা হলে তিনিও ছাড় দিয়েছেন টেলিপাড়াকে। পাল্টা যুক্তি তাঁর, ‘‘বাড়িতে থেকে কোভিড হচ্ছে না? অভিনেতা বা টেকনিশিয়ানের বাড়ির লোক বাজার-দোকান করছেন না? সেখান থেকেও তো সংক্রমণ হতে পারে! আপনারা ১৪ জন বলছেন, কিন্তুনাম বলছেন ৪ জনের। একজন মেকআপ আর্টিস্ট আর তিন জন অভিনেতার। এর মধ্যে মেকআপ আর্টিস্ট সুস্থ হয়ে গিয়েছেন।’’
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম বা মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদের ক্ষেত্রে বাবা লোকনাথ ম্যানিকুইন ব্যবহার করছেন
ফেডারেশনের কাছে তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা কত? স্বরূপের দাবি, মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬। দু’জন টেকনিশিয়ান, চার জন অভিনেতা।এই সংখ্যা ভবিষ্যতে যাতে সত্যি সত্যিই চোদ্দো না ছোঁয় তার জন্য কী পরিকল্পনা নিচ্ছে ফেডারেশন? স্বরূপের কথায়:‘‘যা নির্দেশিকা ছিল সেগুলো যাতে আরও কড়া ভাবে পালন করা হয় সে দিকে আমরা নজর দিচ্ছি। সঙ্গে ফ্রি-তে তিনটি করে মাস্ক, স্যানিটাইজার, হেলমেট, শিল্ড দেওয়া হচ্ছে সবাইকে। গতকালের আলোচনায় স্থির হয়েছে, প্রত্যেক ফ্লোরে গিয়ে আমরা ছোট্ট করে মিটিং করে সবাইকে অনুরোধ করব, নিজের পাশাপাশি সুস্থ রাখুন বাড়ির লোকেদেরও। বাড়িতেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। যাতে কোনও ভাবে কেউ সংক্রমণের বাহক না হন। এ ছাড়া, যাঁরা আক্রান্ত সেই ইউনিটের সোয়াব টেস্টের ব্যবস্থা শুরু হবে সম্ভবত সোমবার থেকে, বিনামূল্যে।
যাঁরা প্রাইভেট গাড়িতে যেতে বাধ্য হন তাঁদের সুরক্ষার জন্য প্রোডাকশনের গাড়ির ব্যবস্থা করবেন? ‘‘এটা সম্ভব নয়,’’ অকপটস্বরূপ। বললেন, এটা চাপ হয়ে যাবে প্রযোজকের উপর। তাঁকে তো ‘করতে হবে’ বলে চাপিয়ে দিয়ে মেরে ফেলা যায় না! আর্টিস্ট, প্রযোজক সবার জন্যফেডারেশন। তাই প্রযোজককে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, পিক আপ বা বাড়িতে ছাড়ার আগে গাড়ি স্যানিটাইজড করে নিতে হবে। পাঁচ মিনিট অন্তর হাত ধোওয়ার জন্য ব্রেক দিতে হবে। যাঁরা মোটরবাইক, মোপেড বা সাইকেলে আসবেন তাঁদেরও গাড়ি যাতে স্যানিটাইজড করা হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।যাঁরা বাসে যাতায়াত করেন, তাঁদের কথাও ভাবছে ফেডারেশন, আশ্বাস সম্পাদকের।