উত্তমকুমার
উত্তমকুমার আমার ভাল কাকু। এই শ্রাবণ মাস এলে, রাতে বৃষ্টি পড়লেই বুকটা হু হু করে ওঠে। ভাল কাকুর ওই চলে যাওয়ার ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়। মহানায়কের জেঠতুতো দাদার মেয়ে। উত্তম পরবর্তী প্রজন্মের প্রথম সন্তান। ওঁর ছেলে গৌতমের থেকে আমি বছর তিনেকের বড়। বিশাল বড় যৌথ পরিবারের আমিই প্রথম সন্তান। সাধারণত, সবাই বাড়ির প্রথম সন্তান ছেলে চায়। কাকু কিন্তু কন্যা সন্তান ভীষণ ভালবাসতেন। এত আদরের ছিলাম যে কোনও দিন আমার নাম ধরে ডাকেননি। সব সময় ‘মাঈ’ অর্থাৎ ‘মা’ বলে ডাকতেন। ওঁর কোলে-পিঠে চড়েই আমার বড় হওয়া। কত আবদার করেছি কাকুর কাছে!
উত্তমকুমার মহানায়ক। উত্তমকুমার তারকা। ওঁর মতো কেউ হাসতেই পারে না! ঘাড় বেঁকিয়ে চোরা চাউনিও ছুঁড়তে পারে না। শুনতে শুনতে বড় হয়ে ওঠা। কিন্তু আমরা তো সে সবে অভ্যস্ত নই। ভারত সেরা অভিনেতাকে বাড়িতে সবাই আটপৌরে ভাবেই দেখেছি। যেমন, ওঁর সব কাজে পরিবারের সবার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ছিল। কাকু চাইতেন, লক্ষ্মীপুজো থেকে ছোট-বড় সব অনুষ্ঠানে বাড়ির সবাই তাঁর পাশে থাকবেন। আনন্দ করবেন। কোমর বেঁধে কাজও করবেন।
লক্ষ্মীপুজো কথাই আগে বলি। মহানায়ক প্রচণ্ড ধুমধাম করে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন বাড়িতে প্রতিমা এনে পুজো করতেন। কেন করতেন, কেউ জানে না। মায়ের কাছে শুনেছিলাম, কাকুর দেবী দর্শন হয়েছিল। পুজোর কিছু আগে ছাদে একটি ছোট্ট বাচ্চা মেয়েকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখেছিলেন। বাড়িতে তখন মেয়ে বলতে এক মাত্র আমি। কাকু তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে গিয়ে বললেন, ‘‘বৌদি মাঈ ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে। পড়ে যাবে। ওকে দেখো।’’ মা বললেন, "মাঈ তো ঘুমোচ্ছে! "
শুনে কাকু অবাক।
মহানায়ক
পুজোর দু’দিন আগে থেকে রোজ একটি লক্ষ্মী প্যাঁচা কাকুর বাড়িতে আসতে আরম্ভ করল। দেখতে দেখতে কাকুর নাম, যশ, অর্থ বেড়ে চার গুণ। সেই থেকে তাঁর বাড়িতে ঘটা করে লক্ষ্মী পুজো শুরু। কাকুর এই পুজো দিয়েই আমাদের বাড়িতে পুজো শুরু। নিজেদের বাড়িতে পুজোর যেন আলাদা আনন্দ। বাড়িতে তৈরি মিষ্টি দিয়ে মায়ের পুজো হবে, এই ইচ্ছে থেকে কাকু ভিয়েন বসাতেন। সেখানে গরম গরম পান্তুয়া তৈরি হত। কাকু ডেকে ডেকে সেই পান্তুয়া খাওয়াবেন সবাইকে। এই অনুভূতিগুলো বলে বোঝানোর নয়।
লক্ষ্মীপুজোর রাতে ছোটদের বড় প্রাপ্তি উত্তম কুমারের ছবি দেখতে পাওয়া। বড় স্ক্রিন টানিয়ে ভাল কাকু সবাইকে ওঁর অভিনীত দুটো ছবি দেখাতেন। তখন প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখার অনুমতি পেতাম না। কারণ, আমরা ছোট। ওই দিন কারওর, কোনও ব্যাপারে নিষেধ নেই। সব থেকে মজার কথা, ছবি দেখতে দেখতে বাড়ির বড়োরাই ভুলে যেতেন উত্তম কুমার তাঁদের পরিজন। জনপ্রিয় দৃশ্য বা গান শুরু হলে তাঁরাই ‘গুরু গুরু’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেন। বিষয়টি কিন্তু দারুণ উপভোগ করতেন ভাল কাকু। হেসে ফেলতেন পরিবারে লোকজনদের অবস্থা দেখে।
পুজোর পরের দিন কাকু সবাইকে মাছ খাওয়াতেন। ওই দিন রুপোলি পর্দার সব তারকা জড়ো হতেন মহানায়কের বাড়িতে। আমরা তো তাদের আনাগোনা দেখেই বড় হয়েছি। পুজোর পরের দিন ছাড়াও গৌতমের জন্মদিনে মেয়ে মুনমুনকে নিয়ে কাকুর বাড়িতে সুচিত্রা সেন আসতেন। মুনমুনও তখন অনেক ছোট।
ব্যতিক্রম সুপ্রিয়া চৌধুরী। পালা-পার্বণে সবার আসা-যাওয়া ছিল। ওঁকে কোনও দিন বাড়িতে আসতে দেখিনি। যে দিন গৌতম চলে গেল এক মাত্র সে দিন তিনি কাকুর বাড়িতে পা রেখেছিলেন।
একটা ঘটনা মনে আছে, স্থানীয় লুনার ক্লাবের ২৫ বছরে মাঠজুড়ে বিশাল প্যান্ডেল। সেখানে কাকু মধ্যমণি। যাত্রা, নাটক, জলসা, সিনেমা, গুণীজন সংবর্ধনা-- ১০ দিন ধরে সব অনুষ্ঠান হয়েছিল কাকুর পরিচালনায়।
আমি তখন সাত কি আট। মাথায় একটাই চিন্তা, প্রথম সারিতে বসে সবাইকে দেখতে হবে। বাকিদের সঙ্গে আমিও উৎসাহ নিয়ে সময়ের আগেই পৌঁছে গিয়েছি। প্রথম সারিতেও বসেছি। সংবর্ধনা নিতে মঞ্চে উঠেছেন ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, কমল মিত্র, বিকাশ রায়। তার আগে গৌরী কাকিমা সবাইকে আপ্যায়ন জানিয়েছেন গোল্ড ফ্লেক সিগারেট দিয়ে। কাকুর সামনে ধরতেই চোখ দিয়ে নিষেধ করলেন তিনি। অর্থাৎ, তাঁর চারপাশে গুরুজন। তিনি এখন নেবেন না। ব্যাপারটা এক মাত্র খেয়াল করেছিলেন ছবি বিশ্বাস। মঞ্চে উঠে ভাল কাকুকে নিয়ে বেশ কিছু কথা বলার পরেই সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনাটাও জানালেন। বললেন, এই কারণেই উত্তম নায়ক নয়। 'মহানায়ক'।
১৯৬৪ সালে আমার বিয়ে হয়। কাকু তখন ময়রা স্ট্রিটে। সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে থাকতেন। তার পরেও বিয়ের তারিখ উদযাপন করতেন ভবানীপুরের বাড়িতে। অত বড় ব্যক্তিত্ব। চাইলেই সব সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে যেতে পারতেন। ভাল কাকু কিন্তু তা করেননি। বড় হওয়ার পর এ সব যত বুঝেছি, ভাল কাকুকে নিয়ে আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়েছে।
আমার বিয়েতে থাকতে পারেননি ভাল কাকু। মুম্বইতে তিনি তখন ‘ছোটি সি মুলাকাত’ ছবি নিয়ে ব্যস্ত। তবে বৌভাতে এসেছিলেন। সে এক কাণ্ড!ভাল কাকু যখন এসেছেন তখন সবাই ছাদে খেতে বসে গিয়েছেন। উত্তমকুমার এসেছেন.... শুনেই দৌড়ে ছাদে থেকে নীচে নেমে এসেছিলেন আমন্ত্রিতরা। দেখার পালা মিটতেই সবাই যেন ঘোরে! কে, কোন পাতে খেতে বসেছিলেন বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। সবাই আনমনা ভাবে যেখানে জায়গা পেয়েছেন বসে খাচ্ছেন। মহানায়কের এমনই জাদু!
সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে উত্তম কুমার
আমার শ্বশুরমশাই জয়পুরের লোক। মহারানি গায়ত্রী দেবীর স্বামী অর্থাৎ জয়পুরের মহারাজার আপ্ত সহায়ক ছিলেন খুড়শ্বশুর। পরিবারে কোনও অনুষ্ঠান হলে জয়পুরের রাজা-রানির আমন্ত্রণ বাঁধা। আমার শ্বশুরমশাই পরে বলেছিলেন, সারা জীবনে দু’জন সুপুরুষ দেখলাম। এক জন, জয়পুরের মহারাজ। দ্বিতীয় জন, মহানায়ক উত্তমকুমার। শ্বশুরবাড়িতে ভাল কাকুর প্রশংসা শুনে সে দিন গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল।
বিয়ের পর নিয়ম মেনে ভাল কাকু দামি শাড়ি, মিষ্টি দিয়ে আমায় পাঠাতেন। আমিও অপেক্ষা করে থাকতাম। আসলে পরিবারকে ভীষণ ভালবাসতেন ভাল কাকু। সবার প্রতি সমান কর্তব্য। বড়দের প্রচণ্ড সম্মান করতেন। খুঁটিনাটি সব বিষয় তাঁর মাথায় থাকত। গৌতমের বৌভাতে দুপুরে নতুন বৌ বড়দের পাতে ভাত দেবে। সব দাদা, ভাই, বৌদি, দিদিদের নিয়ে খেতে বসেছেন উত্তমকুমার। সবাই বৌকে বলেছেন, ভাল কাকুকে আগে ভাত দিতে। কাকু সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে উঠেছেন। বৌমাকে বলেছেন, ‘‘আগে বড়দের দাও। আমায় শেষে দেবে।’’ কাকুকে আমরা কোনও দিন তারকা হিসেবে দেখিনি। বাড়িতে কাকু বরাবর মাটির কাছাকাছি। আজ বড্ড আফসোস হয়, আরেকটু যদি সময় কাটাতাম কাকুর সঙ্গে! অনেক কিছু আরও দেখতে পেতাম। জানতে পারতাম।
কত বার কাকুর নিউ আলিপুরের নতুন বাড়িতে গিয়েছি। বিশাল বাড়ির একটি ঘর কাচে মোড়া! ঝাড় লণ্ঠন দিয়ে সাজানো। কাকুর বাড়ি সাজানোর শখও অন্যদের থেকে আলাদা ছিল। মনে পড়ছে, আমার ভাইয়ের পৈতের সময় কাকুর আবদার, ‘‘আমি পরিবেশন করব’’। শুনেই আমার আর এক কাকু বলেছিলেন, ‘‘রক্ষে কর ভাই। আমার জিনিস সব শেষ হয়ে যাবে। তুমি যেটাই দেবে সেটাই লোকেরা বলবে চার বার করে দাও। যাতে তুমি ওঁদের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে থাক। তুমি খাওয়ার সময় উপস্থিত থেকো। ভুলেও পরিবেশনের দায়িত্ব নিও না।’’
উত্তম কুমারকে নিয়ে পাগলামি শুধুই কি মেয়েরা করতেন? তা কিন্তু নয়।
উত্তমকুমারকে নিয়ে পাগলামি শুধুই কি মেয়েরা করতেন? তা কিন্তু নয়। পুরুষেরাও সমান পাগল ছিলেন তাঁর জন্য। এক বার আমার ভাইয়ের মাসির এক দেওর বাড়িতে এসেছেন। তিনি উত্তরপাড়ায় থাকতেন। ভাল কাকুর সঙ্গে তাঁর আমাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে কাঁধে ধাক্কা লেগেছে। ব্যাস, তিনি নিজের কাঁধ চেপে ধরে বলে উঠলেন, ‘‘এ ভাবেই কাঁধ চেপে আমি বাড়ি ফিরব। তার পর খাটে গড়াগড়ি খাব। তা হলেই মনে হবে উত্তমকুমার আমার পাশে শুয়ে আছেন!’’
আরও একটি ঘটনা বলি। আমার মাসির বাড়ি দক্ষিণেশ্বরে। সেখানে তাঁর প্রতিবেশি এক যুবতী কাকুর অন্ধ ভক্ত ছিলেন। আমরা যেমন রোজ সন্ধেবেলায় ঠাকুরের আরতি করি তাঁর আরাধ্য দেবতা ছিলেন উত্তমকুমার। বাড়িতে কাকুর বিশাল বাঁধানো ছবি। তিনি তার সামনে রোজ জল-বাতাসা রাখতেন। ধূপ জ্বালিয়ে আরতি করতেন! এমন উত্তম-পুজোও আমি নিজের চোখে দেখেছি।
সেই ভাল কাকু ২৪ জুলাই আর ‘নেই’! রাতে খবর পেলেও যেতে পারিনি। দিনের আলো ফুটতেই কাকুর কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমার ভাল কাকু উঠে দেখলেনও না। যেন অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। নাকে ওষুধ মাখানো তুলো গোঁজা। কাকু নিথর। যে মানুষ সারাক্ষণ হইহই করতেন তাঁর স্তব্ধতা মেনে নিতে সে দিন খুব কষ্ট হয়েছিল।