Independent Films

হল না পেলে মুক্তি আটকে যাবে ছবির? বিকল্প পথ দেখাচ্ছেন স্বাধীন পরিচালকরা

আটঘাট জানা না থাকলে ছবি বানিয়ে অনেক সময়ে ফাঁপরে পড়েন নবীন নির্মাতারা। ধাক্কা খেয়ে ছবি বানানো ছেড়ে দেন অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী। তাঁদের বিকল্প পথ দেখাচ্ছেন অভিজ্ঞ পরিচালকরা।

Advertisement

তিয়াস বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২২ ১৮:৪১
Share:

স্বাধীন ছবি মুক্তি দিতে গিয়ে হিমসিম খাওয়া নবীন পরিচালকদের পথ দেখাচ্ছেন অভিজ্ঞ পরিচালকরা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

২৫ নভেম্বর, ২০২২ সাল। বাংলার স্বাধীন চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দিনটি হয়তো মনে রেখে দেবেন অনেকেই। এই প্রথম বাংলা ছবি মুক্তি পেতে চলেছে দক্ষিণ কলকাতার এক ক্যাফেতে। শুধুমাত্র নজরুল তীর্থ ছাড়া কোনও প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির অনুমতি পায়নি পরিচালক সৌরিশ দে-র স্বল্প বাজেটের স্বাধীন ছবি ‘জুতো’। তাই বলে লোকে দেখবে না, তা কি হয়! উদ্যোগ নেন অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ক্যাফে ওহানা ফিল্ম ক্লাব’ ছবিটিকে সাদর আমন্ত্রণ জানায়। এ পর্যন্ত সেই ক্লাবে ছোট দৈর্ঘ্যের ছবিরই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতেন ‘ভটভটি’-র পরিচালক তথাগত ও তাঁর বন্ধুরা। পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি মুক্তির পরিকল্পনা এখনই ছিল না। কিন্তু জানালেন, ‘জুতো’-র দুর্দশা দেখে পরবর্তী পরিকল্পনা এগিয়ে আনতে হয়। এতে দারুণ খুশি সৌরিশও। ‘দোস্তজী’, ‘ঝিল্লি’, ‘নিতান্তই সহজ সরল’-এর গরিমার সফরে তাঁর প্রথম কাজ দিনের আলো দেখবে, ভাবেনইনি।

Advertisement

আগামী দিনে ছোট কিংবা বড় স্বাধীন ছবির ভবিষ্যৎ কি হতে চলেছে এই ক্যাফে রিলিজ়? না কি বাঁচিয়ে রাখা যাবে প্রেক্ষাগৃহে ছবি মুক্তির স্বপ্নও? আনন্দবাজার অনলাইন প্রশ্ন রেখেছিল শহরের ভুক্তভোগী পরিচালকদের কাছে।

‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ ছবির শুটিংয়ে ঋত্বিক। ছবি: সংগৃহীত।

‘বাকিটা ব্যক্তিগত’-র পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য বরাবরই নিজের তালে চলেছেন। স্বাধীন ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন জেলায় জেলায়। জাতীয় পুরস্কার পাওয়া ছবির জন্যেও প্রেক্ষাগৃহ মেলেনি। রাস্তায় পর্দা টাঙিয়ে ছবি দেখিয়েছেন মানুষকে। জানালেন, শুধু চেয়েছিলেন সবাই দেখুন। তবে হ্যাঁ, লোকবল ছিল তাঁর। যেটি এখনকার স্বাধীন চলচ্চিত্রকারদের জন্যও জরুরি মনে করছেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “হল রিলিজ়ের কথা ভেবে ছবি করলে আর স্বাধীন চলচ্চিত্রকার হিসাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। সেই সিস্টেমের মধ্যেই ঢুকে পড়তে হবে। অল্টারনেটিভ ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম দরকার। যেমন মূলধারার ছবির রয়েছে। তবেই স্বাধীন ছবি বানিয়ে হল রিলিজ়ের স্বপ্নপূরণ সম্ভব। না হলে ওই ৪-৫ দিন রেখে ছবিটা তুলে নেবে।” তার পরই কথায় কথায় চলচ্চিত্র উৎসবে মনোনীত সত্রবিত পালের ছবি ‘নিতান্তই সহজ সরল’-এর কথা তোলেন পরিচালক। তাঁর আক্ষেপ, “চমৎকার ছবি। অমিত (সাহা) অভিনয় করেছেন। সেই ছবি হল পেল না এখনও অবধি।”

‘নিতান্তই সহজ সরল’- এর পরিচালক সত্রবিতের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানালেন, জুন মাস নাগাদ নন্দন ২-তে ছবিটির মুক্তির জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু হল পাননি। তাঁর কথায়, “ব্যক্তিগত পরিসরে খুব বেশি মানুষের কাছে স্বাধীন ভাবে তৈরি ছবি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। নন্দন ২-এর মতো সরকারি প্রেক্ষাগৃহ পেলে সুবিধে হত। এসআরএফটিআই-এর মতো জায়গায় স্পেশাল স্ক্রিনিং-এর কথা কেউ কেউ বললেও আমরা নন্দন ২-ই চাই। ৭০-৮০ জন দর্শক, অন্তত কয়েক দিন চলবে। এক দিন ছবি চালিয়ে কী লাভ!” জানালেন, আবার আবেদন করবেন। হাল ছাড়বেন না।

এই মুহূর্তে বাংলায় পুরস্কারপ্রাপ্ত (নানা চলচ্চিত্র উৎসব চত্বরে) স্বাধীন ছবির হাট। গত সপ্তাহেই একই দিনে মুক্তি পেয়েছে ‘দোস্তজী’ আর ‘ঝিল্লি’। বিষয় এবং নির্মাণ— দু’দিক থেকেই ভিন্ন স্বাদের ছবি দুটি দর্শকের মন কেড়েছে। কিন্তু মুক্তির পথ নেহাত সহজ ছিল না। অনেকে মনে করছেন ‘দোস্তজী’ অধিক মর্যাদা পেল, ‘ঝিল্লি’ পেল না। ‘খোলামকুচি’র পরিচালক সৌরভ পালোধী তো বলেই দিলেন, “আজ ‘দোস্তজী’ বেঁচে গেল প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় দায়িত্ব নিলেন বলে। না হলে ‘ঝিল্লি’র মতো ‘দোস্তজী’ও হারিয়ে যেত। আমি শুরুতেই ভেবেছিলাম ‘ঝিল্লি’ দেখতে যাব। কারণ মাথায় ছিল ওটা এক সপ্তাহই থাকবে। ‘দোস্তজী’ আরও কিছু দিন পরও দেখতে পারব জানতাম। এগুলো তো ঘরে বসেই বলে দেওয়া যায় এখন। কারণ এর পিছনে বড় হাউস আছে। ‘ঝিল্লির’ও প্রচুর শো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা ধরে নিলাম যে ‘ঝিল্লি’ গ্রামেগঞ্জে কেউ দেখবে না। তাই রাখাই হল না প্লেটে।’’

‘দোস্তজী’-র পথ এত মসৃণ হল শুধুই কি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ছোঁয়ায়? অস্বীকার করলেন না পরিচালক প্রসূন চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

সত্যিই কি তাই? স্বাধীন ছবি বলেই মুক্তির ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে ‘ঝিল্লি’কে? পরিচালক ঈশান ঘোষের কাছে জানতে চেয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন। ছবিনির্মাতা বললেন, “‘ঝিল্লি’ ইতিমধ্যেই ছোট জায়গায় মুক্তি পেয়েছে আনুষ্ঠানিক ভাবে। তেমনই পরিকল্পনা ছিল।” কারণও নিজেই ব্যাখ্যা করলেন ঈশান। তাঁর কথায়, “বড় বড় অনেক ছবি সাড়ম্বরে মুক্তি পেলেও টাকা তুলতে পারেনি শেষ অবধি। স্বাধীন ছবির পরিচালকদের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটলে আর্থিক ঝুঁকির সম্ভাবনা থেকে যায়।” তাই ধীরে ধীরে বিশেষ বিশেষ জায়গায় ‘ঝিল্লি’ মুক্তির ব্যবস্থা করবেন তাঁরা। জানালেন, আগামী ১০ ডিসেম্বর বড় করে ছবির স্ক্রিনিং হবে মুম্বইতে।আর যে ছবি নিয়ে সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে বেশি হইচই, সেই ‘দোস্তজী’-র পথ এত মসৃণ হল শুধুই কি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ছোঁয়ায়? অস্বীকার করলেন না পরিচালক প্রসূন চট্টোপাধ্যায়। তবে আরও কয়েকটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাইলেন সেই সঙ্গে। আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন,“ছবিটি ভাল হওয়া দরকার। তাতেই ছবির ভবিষ্যৎ তৈরি হয়ে যায়। তার মধ্যেও নানা রকম রাজনৈতিক চাপ এবং জটিলতা কাজ করে। যার মধ্যে যেতে চাইছি না। ‘দোস্তজী’র ক্ষেত্রে এমন কিছু হয়নি, তার কারণ ছবিটি দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্ন চলচিত্র উৎসব ঘুরে পরিচিতি তৈরি করে নিয়েছিল। দর্শক উদ্‌গ্রীব ছিলেন দেখার জন্য। এর পর ডিস্ট্রিবিউটরের সঙ্গে কথা হলে তারা রাজি হয় এগোতে এবং হয়ে যায়।” তবে সবার ক্ষেত্রে পথ এতটা মসৃণ হয় না বলেও জানান প্রসূন।

প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এতে যুক্ত হয়ে পড়ায় কি অনেকটা সুবিধা হল? প্রসূন বললেন, “অবশ্যই, সেটা একটা আশীর্বাদ। ওঁর শুধু ছবিটা দেখে ভাল লাগায় বিন্দুমাত্র ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছাড়াই এতটা করলেন, আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। সেটা অবশ্যই অনেকটা সাহায্য করেছে।” সঙ্গে ‘ঝিল্লি’-র প্রশংসাও করলেন প্রসূন। জানালেন, ঈশানের সঙ্গে বসেই ‘ঝিল্লি’ দেখেছেন। তাঁর কথায়, “খুব সাহসী ছবি। বিষয়বস্তুর দিক থেকে দুটো ছবির মধ্যে তুলনাও চলে না। কিন্তু সে ছবিও সবার দেখা উচিত। আমিও ভীষণ ভাবে চাই দর্শক দু’ধরনের ছবিই দেখুক।”

স্বাধীন ছবি বলেই মুক্তির ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে ‘ঝিল্লি’কে? ছবি: সংগৃহীত।

কিন্তু দর্শক দেখবেন কী ভাবে? ছবিগুলি যে পৃথিবীর আলোই দেখছে না অনেক সময়! তার কী হবে? প্রশ্ন করতে এক এক পরিচালক এক এক উপায় বললেন। তবে প্রদীপ্ত থেকে শুরু করে প্রসূন— কেউই যে বিশেষ আলো দেখাতে পারলেন, তা নয়। কারণ আলোটা তাঁদের কাছেও অস্পষ্ট।

প্রদীপ্তর মতে, “সিস্টেম চালাতে গেলে পয়সা লাগে। তার চেয়ে বিকল্প হতে পারে নিজের টাকা থেকে শো-এর ব্যবস্থা করা। তাতে টাকা উঠবে না কিন্তু। লোককে দেখানো যাবে। যোগেশ মাইম এবং নন্দনে আর্ট ফিল্ম দেখানোর আবেদন করা যায়। সেটা সাশ্রয়ী। ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ আমি চালিয়েছিলাম ও ভাবেই। নিজস্ব ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমও তৈরি করে নেওয়া যায়, কিন্তু আমি বলব বন্ধুবান্ধব এবং চেনাজানা না থাকলে মুশকিল।”

প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির অনুমতি পায়নি পরিচালক সৌরিশ দে-র স্বল্প বাজেটের স্বাধীন ছবি ‘জুতো’। ছবি: সংগৃহীত।

বন্ধুবান্ধবের ভরসা ছিল না বলেই ‘জুতো’ নিয়ে হিমসিম খাওয়া সৌরিশের হাত ধরেছিলেন তথাগত। এক জন তরুণের ছবিমুক্তির স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে— নিজে পরিচালক হয়ে সেটা চাননি তিনি।

তবে নাট্যকার তথা পরিচালক সৌরভ সাফ বললেন, “আমার অত জেদ নেই। একটা ছবি করলাম মানে সেটা প্রেক্ষাগৃহেই মুক্তি দিতে হবে এমন ব্যাপার নেই। সিরিজ়ের ক্ষেত্রে তো সম্ভবও নয়। আমি কেবল চাইব, যেখানেই হোক, যে ভাবেই হোক সবাই দেখুন কাজটা। গ্রাম-শহরে মানুষ যেন দেখার সুযোগটুকু পান।” ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে এক জন পরিচালককে ছবির প্রচার-কৌশল নিয়েও ভাবতে হবে বলে জানান সৌরভ।

প্রসূন অবশ্য তাঁর নিজের ছবির সাফল্যে সন্তুষ্ট। এত কিছু নিয়ে ভাবার সময় নেই তাঁর। তবু বললেন, “কনটেন্টের জোরে লোকের কাছে পৌঁছবে ভেবে ছবি বানিয়ে ফেলে রেখে দিলাম, তা করলে কিন্তু হবে না। ছবি তৈরির পর ডিস্ট্রিবিউশন এবং অন্যান্য পথে মুক্তির চেষ্টা করতে হবে।”

সেই পরিস্থিতিতে বৃহত্তর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন অভিনেতা-পরিচালক তথাগত। আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “বিদেশে ছবি দেখানোর বিকল্প পরিসর হল পার্কিং লট। কলকাতা শহরেও এমন কিছু উদ্যোগের ভাবনা থেকেই কিছু ক্যাফের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। হলে মুক্তি না-পাওয়া ভাল ভাল ছবি এই ক্যাফেগুলিতে এলেই দর্শক দেখতে পাবেন। অত্যন্ত স্বল্প মূল্যে।” তথাগতের আশা, এতে ভাল সাড়া পাওয়া গেলে ভবিষ্যতে ক্যাফে চেন তৈরি করা সম্ভব হবে। নির্ধারিত পদ্ধতি মেনে স্বল্প বাজেটের ছবিগুলির মুক্তির উপযুক্ত পরিসর তখন হয়ে উঠতে পারে এই ক্যাফেগুলিই। যদি এখানে ক্যাফেতে সিনেমা দেখানোর একটা সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, ভবিষ্যতে স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালকরা আর বঞ্চিত থাকবেন না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement