মেয়ের ইচ্ছে পড়াশোনার। কিন্তু মা চান, মেয়েকে হিন্দি সিনেমার নায়িকা হিসেবে দেখতে। মায়ের ইচ্ছেতেই রুপোলি দুনিয়ায় পা রাখা। চেনা ছবির উলটপুরাণেই বলিউড পেয়েছিল নায়িকা, সোমা আনন্দকে।
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবথেকে ছোট সোমার জন্ম ১৯৫৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। তাঁর বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। মা, গৃহবধূ। ছোট মেয়ের নাম তাঁরা রেখেছিলেন ‘নীলম’। শৈশব-কৈশোরের বেশ কিছুটা অংশ অমৃতসরে কাটিয়ে পরিবারের সঙ্গে নীলম মুম্বই এসেছিলেন ১৯৬৮ সালে।
প্রথম দিকে নীলম অভিনয়ের থেকেও ভালবাসতেন নাচতে। সঙ্গীত পরিচালক সমীর সেনের বাবা শম্ভু সেনের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি। অভিনয়ের প্রস্তাব নীলমের কাছে এসেছিল অপ্রত্যাশিত ভাবেই। মায়ের উৎসাহে সেই সুযোগ হাতছাড়া করেননি তিনি। বাবার বন্ধু জানকী দাসের কথায় নীলম যোগাযোগ করেন পরিচালক প্রমোদ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তাঁকে পছন্দ হয় পরিচালকের।
প্রথম ছবিতেই ঋষি কপূরের বিপরীতে অভিনয় করার সুযোগ পান তিনি। তবে পাল্টাতে হয় নিজের নাম। পাবলিসিস্ট দীপ সাগরের দেওয়া নাম ‘নীলু ববি’ পছন্দ হয়নি নীলমের। নামের সঙ্গে পদবিও পাল্টে নেন নবাগতা। বলিউডে তাঁর পরিচয় হয় ‘সোমা আনন্দ’।
সিনেমায় অভিনয় শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ছেদ পড়ে লেখাপড়ায়। দুই নৌকায় পা রাখতে না পেরে ফার্স্ট ইয়ারেই কলেজ ছেড়ে দেন মেধাবী সোমা। আর ফিরে আসা হয়নি পড়াশোনার দিকে।
সোমার প্রথম ছবি ‘বারুদ’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৬ সালে। বক্স অফিসে সুপারডুপার হিট হয়েছিল ছবিটি। পরে এক সাক্ষাৎকারে সোমা জানান, তিনি কোনও দিন ভাবতেই পারেননি কলেজজীবনের স্বপ্নের নায়ক ঋষি কপূরের সঙ্গে তিনি কেরিয়ারের প্রথম ছবিতে অভিনয় করবেন!
সহজেই বড় ব্যানারে প্রথম সারির নায়কের সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। সে কথা স্বীকার করেন সোমা। সে ছবির শুটিঙের সুবাদেই প্রথম বিদেশে গিয়েছিলেন তিনি।
এর পর ‘পতিতা’, ‘জাগির’, ‘কুলি’ ছবিতেও সোমা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করেন। কিন্তু নিজের স্টারডম বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি। নায়িকাবৃত্ত থেকে সরে যেতে হয়েছিল তাড়াতাড়ি। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই সোমা নায়িকার ভূমিকা থেকে চরিত্রাভিনয়ে।
তাঁর কেরিয়ারে উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম ‘বিন্দিয়া চমকেগি’, ‘ঘর এক মন্দির’, ‘পাতাল ভৈরবী’, ‘আজ কা দৌড়’, ‘খুনি মহল’, ‘সীতাপুর কি গীতা, ‘প্যায়ার কা মন্দির’, ‘ইনসাফ কা খুন’, ‘কাল হো না হো’, ‘হাঙ্গামা’ এবং ‘প্যায়ার কোই খেল নেহি’।
শেষের দিকে মূলত তাঁকে দেখা গিয়েছে কৌতুকশিল্পী হিসেবে। তবে এক দশকেরও বেশি সময় তিনি সিনেমায় অভিনয় করছেন না। ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘লাইফ পার্টনার’-এ শেষ বার তাঁকে দেখা গিয়েছিল।
সোমার কেরিয়ার দ্রুত ফুরিয়ে আসার পিছনে অনেকেই দায়ী করেন তাঁর বিয়ের সিদ্ধান্তকে। ১৯৮৭ সালে তিনি বিয়ে করেছিলেন অভিনেতা-পরিচালক তারিক শাহ-কে। দাম্পত্য জীবন নিয়ে সোমা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও শোনা যায়, বিয়ের পরে ছবিতে অভিনয়ের ক্ষেত্রে তিনি পরিবারের সমর্থন পাননি।
কিন্তু সোমা ঠিক করেছিলেন তিনি অভিনয় চালিয়েই যাবেন। ছবিতে সুযোগ না পেয়ে তিনি সরে আসেন ছোট পর্দায়। বিনোদনের এই মাধ্যমে তিনি অনেক বেশি সফল হন।
একতা কপূরের প্রযোজনায় ‘হম পাঁচ’ সিরিয়ালে অশোক সরাফের স্ত্রীর ভূমিকায় বিপুল জনপ্রয়িতা পান সোমা আনন্দ। এই সিরিয়াল এবং এর প্রতিটি চরিত্র ভারতীয় টেলিভিশন মহলে মাইলফলক হয়ে রয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে ‘হম পাঁচ’ দিয়ে শুরু। তার পর ‘কিতনে কুল হ্যায় হম’, ‘ভাভী’, ‘শরারত’, ‘মায়কা’-সহ বহু ধারাবাহিকে সোমার অভিনয় প্রশংসিত হয়।
তাঁর চেহারার সঙ্গে হেমা মালিনীর সাদৃশ্য খুঁজে পান দর্শকরা। অনেকে বলেন, তিনি হেমার অভিনয়ের ধারাও অনুকরণ করেন। কিন্তু এই অভিযোগ অস্বীকার করেন সোমা। তাঁর কথায়, তিনি সোমা আনন্দ এবং নিজস্ব ধারাতেই কাজ করে এসেছেন।
হেমা মালিনীর সঙ্গে সাদৃশ্য থাকলেও সোমার প্রিয় অভিনেত্রী মীনাকুমারী। চেয়েছিলেন, মীনাকুমারী মতো নায়িকা হতে এবং বৈজয়ন্তী মালার মতো নৃত্যশিল্পী হতে। কিন্তু এই দু’টো স্বপ্নের কোনওটাই পূর্ণ হয়নি। তবে জীবনের প্রতি কোনও অভিযোগ নেই এই প্রাক্তন নায়িকার। যা পেয়েছেন, খুশি তা-ই নিয়েই।
১৯৮৩ সালে ‘কুলি’ ছবির শুটিঙের সময় পরিচালক কেতন দেশাইয়ের সঙ্গে সোমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে ইন্ডাস্ট্রিতে গুঞ্জন। তার পরের বছর সোমা নাকি এক কানাডাপ্রবাসী ভারতীয় ব্যবসায়ীকে বিয়েও করেন বলে শোনা গিয়েছিল। কিন্তু সবই রয়ে গিয়েছে গুঞ্জন হয়েই।
সিনেমা বা সিরিয়াল, এই মুহূর্তে কোথাও দেখা যায় না সোমাকে। লাইমলাইট থেকে দূরে তিনি এখন ব্যস্ত সংসারের ঘেরাটোপে।