ছবির একটি দৃশ্যে অঞ্জন দত্তের সঙ্গে ঋতদীপ। ছবি: সংগৃহীত।
ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ আমার অভিনয় জীবনের একদম শুরুতে। তখন সবে মাত্র আমি একটি সিরিয়ালে অভিনয় করেছি, ‘একুশে পা’। আমার দ্বিতীয় সিরিয়ালের পরিচালক অঞ্জন দত্ত। সিরিয়ালের নাম ‘স্বপ্ন নিয়ে’। আমি মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করছি। ঝন্টু বলে একটি ছেলে। যে বস্তিতে থাকে এবং গান গাইতে চায়। সেই প্রথম অঞ্জন দত্তের পরিচালনায় কাজ। অঞ্জন দত্ত মানে একটা মিথ, একটা পাগলামো, একটা খ্যাপামি। সময়টা ছিল ১৯৯৫-১৯৯৬। তার পর প্রায় দীর্ঘ ২৫ বছর বাদে রোলটা পাল্টে গেল। এখানে আমি পরিচালক এবং সহ-অভিনেতা এবং উনি অভিনেতা। নিতাই জ্যাঠার চরিত্র কে করবে? সেটা নিয়ে আমাদের যে দিন আলোচনা হয়েছিল, নন্দিতাদি অঞ্জনদার নামটা বলেন। আমরা কিছু ক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিলাম। দ্বন্দ্ব ছিল মনে। উনি রাজি হবেন কি না। ওঁর চরিত্রটা ভাল লাগবে কি না। উনি সময় দেবেন কি না। উনি আদৌ অভিনয় করতে চান কি না এই সময়। এত প্রশ্ন নিয়ে ফোন করে বসলাম। আমি বললাম, আমি ফোনে কিছু বলব না। আমি সামনাসামনি গিয়ে বলব। উনি রাজি হয়ে গেলেন। আবার বহু দিন বাদে অঞ্জন দত্তের বাড়ি। বাড়িটাই একটা আলাদা আমেজ তৈরি করে। বাড়ির বাইরেটা একটা বাগানের মতো। একটা অদ্ভুত চেহারা আছে। আমি বাইরেই বসে ওয়েট করছিলাম। অঞ্জনদা এলেন। আমরা একসঙ্গে কফি নিয়ে বসলাম। আমি চরিত্রটা বলতে শুরু করলাম। গল্পটা বললাম। সবটা শুনলেন। এ বার আমি অপেক্ষা করছি, উনি ওনার সিদ্ধান্ত জানাবেন। ওনার প্রথম মুখ থেকে বেরোল, ‘‘আমি কি ঘেরওয়ালা পাজামা পরব, না একটু চাপা? তার পরের প্রশ্ন, আমার একটা কোর্ট আছে জানো, একটু পুরনো পুরনো। আমি ওটাকে ব্যবহার করতে পারি? জুতোটা ওই পুরনো দিকের একটা কাবলিজুতো হয় না? আমি দেখছি, আমার কাছে আছে কি না। আর ড্রেসারের কাছে পেয়ে যাব। কী মনে হয়? তার পর একটার পর একটা প্রশ্ন। এ প্রশ্নগুলোই যেন এক একটা উত্তর। আর এই প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে উনি নিজেই তৈরি করে তুলছেন নিতাই জ্যাঠার চরিত্র। নিতাই জ্যাঠা কী পরবে?
‘হামি ২’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।
নিতাই জ্যাঠা কী ভাবে কথা বলবে? নিতাই জ্যাঠার চশমাটা কী হবে? নিজে অভিনেতা বলে একটা খিদে আছে এমন কোনও অভিনেতার সামনে যাওয়ার, যাকে মুগ্ধ হয়ে দেখব। যার অভিনয়ের প্রস্তুতি দেখে নিজেকে বলব, এমনটাই তো হওয়া উচিত ছিল। যে বাংলা ভাষাটা আমরা এখন ভাল করে বলতে পারি না সেইটা যখন কোনও অভিনেতা সুন্দর করে বলেন আর চরিত্রের সঙ্গে মিশিয়ে বলেন, তখন মুগ্ধ হয়ে সেটা দেখি। এই উচ্চারণ কি আমি করতে পারতাম? শুটিংয়ের দিনটা ছিল ২৫ ডিসেম্বর ২০২১। দৃশ্যটা ছিল, যেখানে লাল্টু তার ছেলেকে নিয়ে নিতাই জ্যাঠার কাছে গেছে। নিতাই জ্যাঠা ভেঁপু অর্থাৎ আমার ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে কথা বলছে। আমাদের সিনেমায় কিছু দৃশ্য থাকে, যে দৃশ্য সিনেমার প্রাণকেন্দ্র হয়ে থাকে। ‘অলীক সুখ’-এ যেমন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং দেবশঙ্কর হালদারের দৃশ্যটি। যেখান সৌমিত্রদা বলছেন, “কী করছ কিংশুক? কার পিছনে দৌড়চ্ছ? চার মিনিটে রুগীর মন জানবে না রোগ জানবে?” অনেকে এমনও বলেছেন যে ওই দৃশ্যটা দেখার জন্য সিনেমাটা বার বার দেখা যায়। আমার বিশ্বাস, অঞ্জন দত্তের এই দৃশ্য, ভেঁপু এবং নিতাই জ্যাঠা এবং দূরে দাঁড়িয়ে আছি আমি, লাল্টু। আর যখন অঞ্জনদা অর্থাৎ নিতাই জেঠুর সংলাপ, “বিস্ময় হতে যেয়ো না, বিস্মিত হয়ে যাবে,” মনে হয় মানুষকে ছোঁবে। ট্রেলার রিলিজ় হওয়ার পর সবার কাছে এই সংলাপটাই প্রিয় হয়ে গেছে। সহ-অভিনেতা হিসাবে একটু দূরে দাঁড়িয়ে, অঞ্জনদা বলতে শুরু করলেন—
নিতাই জ্যাঠা: লোকে তোমায় কী ভাবে?
ভেপু: বিস্ময় বালক।
নিতাই জ্যাঠা: বিস্ময় সাময়িক বাবা ফুরিয়ে যায়…জীবনে বিস্ময় হতে যেয়ো না, বিস্মিত হয়ে যাবে।
অঞ্জনদার হাত ছোট্ট ভেঁপুর অর্থাৎ ঋতদীপের কাঁধে। একটা বুড়ো আঙুলের টোকায় গালটা নাড়িয়ে দিলেন। মুখের ভেতরে একটা স্মিত হাসি। কিছু অভিনয় রিয়্যালিজ়মের ঊর্ধ্বে চলে যায়। আমার কাছে অঞ্জনদার এই দৃশ্যে অভিনয় তাই পরিচালক এবং সহ-অভিনেতা হিসেবে। ‘হামি ২’ করার অন্যতম সার্থকতা অঞ্জন দত্তকে অভিনেতা হিসেবে পাওয়া এবং এই দৃশ্যটা শুটিং করার সুযোগ পাওয়া। অজস্র ধন্যবাদ অঞ্জনদা, এইটুকু দেওয়ার জন্য।