১৯৫৯ সাল। পর্দায় আবির্ভাব তাঁর। তখন তিনি পঞ্চদশী। এক ঢাল চুল, আটপৌরে শাড়ি, আর মুখে উজ্জ্বল সারল্য— ‘অপুর সংসার’-এর অপর্ণা হলেন তিনি। ক্যামেরার সঙ্গে শর্মিলা ঠাকুরের সেই প্রথম পরিচয়।
তখন তিনি স্কুল পড়ুয়া। বই-খাতা-পড়াশোনার নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। ‘অপু’ অর্থাৎ বছর ২৩-এর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য হন্যে হয়ে নায়িকা খুঁজতে থাকা সত্যজিতের চোখে পড়ে ঠাকুর বাড়ির এই মেয়েকে। শর্মিলার বাবা গীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন স্বয়ং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি।
সত্যজিতের প্রস্তাবে অবশেষে রাজি হন শর্মিলার অভিভাবক। পরিচালক খুঁজে পান মনের মতো ‘অপর্ণা’। ছবি মুক্তি পেল। প্রশংসিত হলেন শর্মিলা। এল দ্বিতীয় ছবির প্রস্তাব। নাম ‘দেবী’। পরিচালক সত্যজিৎ। এর পর কাজ করেন তপন সিংহ, অজয় করের মতো পরিচালকের সঙ্গে।
১৯৬৪ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে বাংলা থেকে পাড়ি দেন সোজা আরব সাগরের তীরে। ‘কাশ্মীর কি কলি’-তে শাম্মি কপূরের বিপরীতে বলিউডে হাতেখড়ি। প্রথম ছবিতেই নজর কাড়েন বঙ্গতনয়া।
এর পরে ‘ওয়াক্ত’, ‘অনুপমা’, ‘আরাধনা’, ‘চুপকে চুপকে’র মতো অগুনতি সফল ছবির মুখ হয়ে ওঠেন সত্যজিতের আবিষ্কার। হিন্দির সঙ্গে বাংলা ছবিতেও কাজ করতে থাকেন সমান তালে। সেই সময় খুব বেশি নায়িকাকে এমনটা করতে দেখা যায়নি।
ছক ভাঙতে ভালবাসতেন শর্মিলা। তাই তো মলমলের শাড়ি আর টানা কাজলের প্রথা ভেঙে বিকিনি পরেও সাবলীল ছিলেন ক্যামেরার সামনে। যা কেউ ভাবতেও পারেননি, তিনি তা-ই করেছিলেন অবলীলায়।
পত্রিকার প্রচ্ছদে তাঁর স্নান পোশাক পরিহিত ছবি প্রকাশের পর বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। বয়েছিল কটাক্ষের বন্যা। কিন্তু এ সব কিছুকে তুড়িতে উড়িয়েছিলেন শর্মিলা।
ছক ভাঙ্গার এই প্রথা আটকে থাকেনি পেশাগত গণ্ডিতে। ব্যক্তি জীবনে শর্মিলা একই রকম সাহসী। কেরিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মনসুর আলি খান পতৌদির প্রেমে পড়েন তিনি।
১৯৬৮ সালে বিয়েও করেন তাঁরা। হিন্দু শর্মিলার সঙ্গে মুসলিম মনসুরের বিয়ে নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। তবে সে সবকে তোয়াক্কা না করেই নতুন সংসার শুরু করেন দু’জন। মনসুর শুধু একজন ক্রিকেটারই ছিলেন না, তিনি পতৌদিদের নবাবও বটে।
নবাব পরিবারে বিয়ে হওয়ার পর নতুন নাম পেয়েছিলেন শর্মিলা। বেগম আয়েশা সুলতানা। এই নাম যদিও গ্রহণ করেছিলেন নিয়ম রক্ষার খাতিরে। কখনওই তা ব্যবহার করেননি তিনি।
এক দিকে নতুন সংসার, অন্য দিকে কেরিয়ার। দিব্যি ভারসাম্য বজায় রেখে চলছিলেন। কিন্তু নায়িকা, স্ত্রীর পর মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেই সেই ছবি বদলায়। কম কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন নবাব-পত্নী।
পুত্রবধূ করিনা কপূর খানকে এক সাক্ষাৎকারে শর্মিলা জানিয়েছিলেন, সন্তানদের দেখাশোনা করার জন্য ‘খিলোনে’, ‘তেরে মেরে স্বপ্নে’, ‘হাতি মেরে সাথী’র মতো একাধিক ছবির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তিনি।
তিনি বলেন, “সমাজ মনে করে শিশুকে লালন করার দায়িত্ব শুধু নারীর। একজন মহিলা যদি তাঁর সন্তানকে ছেড়ে কাজে যান, সমাজের চোখে তিনি খারাপ হয়ে যান। আর আমরা তো প্রত্যেকেই আদর্শ নারীর আখ্যা পেতে চেয়েছি। তাই না?”
পরিবার, অভিনয় সামলেও নিজের পরিধি বিস্তার করেছিলেন শর্মিলা। সেন্ট্রাল ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ডের চেয়ারপার্সন পদে নিযুক্ত ছিলেন দীর্ঘ দিন। এ ছাড়াও ইউনিসেফের গুডউইল অ্যাম্বাসাডর ছিলেন সইফ-জননী।
বুধবার, ৮ ডিসেম্বর ৭৭-এ পা রাখলেন শর্মিলা। একদা নায়িকার জীবন যে তাঁর ছবির থেকেও বেশি বর্ণিল এবং ঘটনাবহুল, তা বললে অত্যুক্তি হবে না।