দেশভাগের পরে ভারতের মুম্বইয়ে আসার পরে শরণার্থী কিষণচন্দ সিংহ এবং তাঁর স্ত্রী ননীর পরিবার তখনও চালচুলোহীন। তার মধ্যে সংসারে এসেছে নতুন অতিথি। জন্ম হয়েছে একটি কন্যাশিশুর। নাম রাখা হল নির্মলা।
তিন বছর বয়সি নির্মলা আবার দেওয়ালে নিজের ছায়া দেখে অঙ্গভঙ্গি করে! দেখে তো ভয় পেয়ে গেলেন ননী। মেয়েকে নিয়ে গেলেন চিকিৎসকের কাছে। তাঁর ধারণা, এই শিশু স্বাভাবিক নয়।
মায়ের আশঙ্কাকে অমূলক বলে উড়িয়ে দিলেন চিকিৎসক। বরং তিনি-ই প্রস্তাব দিলেন মেয়েকে যদি হিন্দি ছবিতে অংশ নিতে দিতে রাজি হন তাঁরা। রক্ষণশীলতার কথা মাথায় রেখে মেয়ের নাম পাল্টে দেওয়া হল। নির্মলা ছবিতে এলেন ‘সরোজ’ হয়ে।
ইতিমধ্যে সংসারে এসে গিয়েছে আরও কিছু কচি মুখ। কিন্তু উপার্জন নামমাত্র। বাধ্য হয়ে নির্মলাকে ছবিতে অভিনয়ের জন্য পাঠাতে রাজি হলেন তাঁর বাবা মা। যোগাযোগ করিয়ে দিলেন ওই চিকিৎসক। তাঁর ছবির জগতে জানাশোনা ছিল।
কিছু ছবিতে শিশুশিল্পী হয়ে অভিনয় করল নির্মলা। কিন্তু তার বয়স বছর দশেক হওয়ার পরে দেখা দিল সমস্যা। শিশুশিল্পীর ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ আর আসে না। এই বয়সে নায়িকাও হওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে গ্রুপ ডান্সের জন্য রাজি হল নির্মলা।
রাজি না হয়ে উপায়ও ছিল না। ইতিমধ্যে তার বাবা মারা গিয়েছেন। সংসারে উপার্জনক্ষম একমাত্র নির্মলা। সে সময় বলিউডে প্রথম সারির কোরিয়োগ্রাফার ছিলেন বি সোহনলাল সাউথ এবং তাঁর ভাই হীরালাল।
চেন্নাই থেকে বলিউডে এসে তাঁরা কোরিয়াগ্রাফির খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘আজাদ’। এই ছবিতে ‘আপলাম চাপলাম’ গানের সঙ্গে তাঁদের কোরিয়োগ্রাফি খুবই প্রশংসিত হয়।
বি সোহনলালের কাছে গ্রুপ ডান্সার হিসেবে নতুন জীবন শুরু হল নির্মলার। সে সময় গ্রুপ ডান্সারদের নাচের প্রশিক্ষণ আগে থেকে বিশেষ থাকত না। বাকিদের মধ্যে সহজেই নজর কেড়েছিলেন নির্মলা। কারণ ছোট থেকেই দেখামাত্র নাচের ভঙ্গি অবিকল রপ্ত করার ক্ষমতা ছিল তাঁর। যদিও তাঁর আগে পরিবারে নাচের কোনও ধারা ছিল না।
নির্মলাকে নিজের সহকারী করে নেন সোহনলাল। অল্প বয়স থেকে তিনিও মাস্টারজির পাশে অন্যদের প্রশিক্ষণ দিতেন। প্রশিক্ষক হওয়ার প্রথম সুযোগেই নির্মলার সামনে শাম্মি কপূর এবং বৈজয়ন্তীমালা। অ্যাসিস্ট্যান্ট কোরিয়োগ্রাফার ছিলেন হর্ম্য়ান বেঞ্জামিন। পরে তিনি শাম্মি কপূর ও শশী কপূরের ব্যক্তিগত নৃত্য প্রশিক্ষক হয়েছিলেন।
নির্মলাকে দেখে বিরক্ত হন বৈজয়ন্তীমালা। বি সোহনলালকে তিনি বলেছিলেন, শেষে কি না একটা বাচ্চা মেয়ের কাছ থেকে তাঁর মতো শিল্পীকে নাচের ভঙ্গি আয়ত্ত করতে হবে!
পরে সেই নির্মলার-ই ভক্ত হয়ে ওঠেন বৈজয়ন্তীমালা। তখন অবশ্য আর নির্মলা নন, তিনি কোরিয়োগ্রাফার সরোজ খান!
গ্রুপ ডান্সার নির্মলা থেকে প্রথম সারির কোরিয়োগ্রাফার সরোজ খান হয়ে ওঠার পথ খুব একটা মসৃণ ছিল না। তবু হার মানেননি তিনি।
১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় চল্লিশোর্ধ্ব বি সোহনলালের সঙ্গে। তার আগেই ধর্মান্তরিত হয়েছেন তিনি। নতুন নাম হয় সরোজ খান। পরে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তাঁর উপর কোনও চাপ ছিল না। স্বেচ্ছায় নতুন ধর্ম নিয়েছিলেন তিনি। নির্মলা নাম মুছে গিয়েছিল সরোজ খানের নামের আড়ালে।
বিয়ের পরের দুই বছরের মধ্যে দু’টি সন্তানের মা হন সরোজ। প্রথম সন্তান ছেলে। দ্বিতীয়টি ছিল মেয়ে। মাত্র আট মাস পাঁচ দিন বয়সে সরোজের সেই শিশুকন্যা মারা যায়। তাকে দুপুরে সমাধিস্থ করে বিকেলের ট্রেন ধরেছিলেন তিনি। সিনেমার গানের সঙ্গে কোরিয়োগ্রাফি করবেন বলে।
বিয়ের পরে এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি হন সরোজ। জানতে পারেন তাঁর স্বামী সোহনলালের আগে আরও একটা বিয়ে আছে এবং তিনি চার সন্তানের বাবা। সরোজের সন্তানদের তিনি নিজের পরিচয় দিতেও রাজি ছিলেন না।
এই নিয়েই দু’জনের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে। সরোজ খানকে ছেড়ে চলে যান সোহনলাল। শুরু হয় সরোজ খানের নতুন লড়াই। ১৯৭৪ সালে ‘গীতা মেরে নাম’ ছবি থেকে একক কোরিয়োগ্রাফার হিসেবে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
কিন্তু কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও প্রত্যাশিত পরিচয় বা খ্যাতি পাচ্ছিলেন না সরোজ। পরে এক সাক্ষাৎকারে জানান, বলিউডের পুরুষশাসিত কোরিয়োগ্রাফির দুনিয়া তাঁকে এক ইঞ্চিও জায়গা দিতে রাজি ছিল না। মহিলা বলে তাঁর উপর ভরসা করতেন না অনেক প্রযোজক-পরিচালক।
এই পরিস্থিতিতে সরোজ পাশে পেয়েছিলেন সুভাষ ঘাইকে। সরোজের কাজের সুখ্যাতি শুনে তিনি তাঁকে সুযোগ দিয়েছিলেন ‘বিধাতা’ ছবিতে। সেখানে একটি মাত্র গানের কোরিয়োগ্রাফি করেছিলেন সরোজ। সে কাজ এতই পছন্দ হয়েছিল সুভাষের, তিনি ‘হিরো’ ছবির সম্পূর্ণ কোরিয়োগ্রাফির দায়িত্ব দেন সরোজকেই।
এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সরোজকে। ‘নাগিনা’, ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’, ‘তেজাব’, ‘চালবাজ’, ‘চাঁদনি’, ‘বেটা’, ‘ডর’, ‘বাজিগর’, ‘মোহরা’, ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’, ‘খামোশি দ্য মিউজিক্যাল’, ‘পরদেশ’, ‘সোলজার’, ‘হম দিল দে চুকে সনম’, ‘তাল’, ‘ফিজা’, ‘লগান’, ‘দেবদাস’, ‘স্বদেশ’, ‘বীর জারা’, ‘ফনা’, ‘সাওয়ারিয়া’, ‘জব উই মেট’, ‘লভ আজ কাল’, ‘রাউডি রাঠৌর’, ‘গুলাব গ্যাং’, ‘তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস’, ‘মণিকর্ণিকা’ এবং ‘কলঙ্ক’— সরোজের নামের পাশে বসেছে একের পর এক ছবিতে সেরা কোরিয়োগ্রাফির স্বীকৃতি।
তিনি যখন কাজ শুরু করেছিলেন তখন মধুবালা মধ্যগগনে। তার পর সরোজের শিল্পসৃষ্টির অংশ বা সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছেন শ্রীদেবী এবং মাধুরী। নায়িকাদের পাশাপাশি নায়কদেরও সমান যত্ন নিয়ে তৈরি করেছেন তিনি। বলতেন, তিনি এমন নাচের স্টেপ তৈরি করেন, যাতে নাকি বাচ্চারাও সহজেই রপ্ত করতে পারে! তাঁর বিশ্বাস ছিল, শিশুদের কাছে জনপ্রিয় হলে তবেই সৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হবে।
ব্যক্তিগত জীবনে বার বার ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন তিনি। দু’টি সন্তানের জন্মের পরে স্বামী সোহনলাল তাঁকে ছেড়ে গিয়েছেন। আবার ফিরেও এসেছিলেন অসুস্থ অবস্থায়। কয়েক বছরের জন্য ফের জোড়া লাগে সরোজের সংসার। জন্ম হয় তাঁর এবং সোহনলালের তৃতীয় সন্তানের।
মেয়ের নাম সরোজ রাখেন কাক্কু। এর পরই তাঁদের ছেড়ে বি সোহনলাল চলে যান। আর কোনও দিন ফিরে আসেননি। সরোজ একাই বড় করেন দুই সন্তান রাজু এবং কাক্কুকে।
পরে ব্যবসায়ী সর্দার রোশন খানকে বিয়ে করেন সরোজ। তাঁদের একমাত্র মেয়ে সুকাইনা এখন দুবাইয়ে নৃত্য প্রশিক্ষক। সরোজের বড় ছেলে রাজুও নৃত্য প্রশিক্ষক। তবে সরোজকে ছেড়ে আগেই চলে গিয়েছেন তাঁর তৃতীয় সন্তান কাক্কু।
দীর্ঘ অসুস্থতার পরে মাল্টি অর্গান ফেলিয়োর হয়ে ২০১১ সালে প্রয়াত হন কাক্কু। এ বার তাঁর কাছে চলে গেলেন মা, সরোজও।