অভিনেতা অভিষেক চট্টোপাধ্যায় চলে যাওয়ার পর দেখেছিলাম আমার দিকে ধেয়ে আসছে স্বরচিত প্রশ্নবাণ! আমি এই নেটমাধ্যমে ঘুরতে থাকা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যকে বরাবর দূরে সরিয়ে রাখি। কারণ, যারা এগুলো ছড়ায়, তারা কতটা চেনে আমাকে? কতটাই বা জানে মিঠুকে? ও তো আমার সঙ্গে নায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি বাংলা ছবিতে কাজ করেছে।
অভিষেকের জন্মদিনে লিখলেন ঋতুপর্ণা
শুভ জন্মদিন মিঠু। আজ সকাল থেকেই তোর কথা মনে পড়ছে। কত জন্মদিন আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি! শ্যুট চলছে হয়তো। সেদিনই মিঠুর জন্মদিন। আর কী?ওখানেই উদ্যাপন। হইহই। তখন এত নেটমাধ্যমের আধিক্য তো ছিল না। নিজেদের মধ্যেই হত সব। কত বার সব বন্ধু মিলেও মিঠুর বাড়িতে গিয়ে জন্মদিনে ওকে চমকে দিয়েছি!
চারপাশটা কেমন একটা হয়ে থাকে আজকাল। নেটমাধ্যম বললেই কেমন একটা অস্বস্তি হতে থাকে। মানুষ চলে যাওয়ার পর এত চুলচেরা বিচার তাকে নিয়ে! কেন? এই কি আমাদের সংস্কৃতি? বুঝে উঠতে পারি না। যে মানুষ চলে যাচ্ছে, তার বাড়ির লোক ঠিক কেমন করে কাঁদছে? কতটা কাঁদছে? তাকে এখন কেমন দেখতে লাগছে...চলতেই থাকে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় সেই চলে-যাওয়া মানুষকে নিয়ে কাটাছেঁড়া আর বিশ্লেষণ। সে কত ভাল কাজ করতে পারত? কিন্তু কেন পারেনি? কে বা কারা তাকে আটকে দিল? মানুষটার পরিবারও দু’দণ্ড শান্তি পায় না শোক অনুভবের।
অভিনেতা অভিষেক চট্টোপাধ্যায় চলে যাওয়ার পর দেখেছিলাম আমার দিকে ধেয়ে আসছে স্বরচিত প্রশ্নবাণ! আমি এই নেটমাধ্যমে ঘুরতে থাকা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যকে বরাবর দূরে সরিয়ে রাখি। কারণ, যারা এগুলো ছড়ায়, তারা কতটা চেনে আমাকে? কতটাই বা জানে মিঠুকে? ও তো আমার সঙ্গে নায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি বাংলা ছবিতে কাজ করেছে। আমাদের জুটি সে সময় পড়তির দিকে-চলা ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। থাক সে কথা। আর ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকার লড়াই? সে তো আজও আমাকে করতে হচ্ছে। কবে থেকে কাজ শুরু করেছি! কিন্তু মাঠে নেমে রোজ রান তোলার পরিশ্রম তো আজও করছি। পরিশ্রম আর ঈশ্বর— এই দুইয়ের সংযোগে একজন শিল্পীর কাজ আর কৃতিত্ব নির্ধারিত হয়। এই দুই ইতিবাচক শক্তি কিন্তু সেই শিল্পীকেই অর্জন করতে হয়। কেউ তাকে আটকাতে পারে না।এটাই আমার বিশ্বাস। অমুক ইন্ডাস্ট্রিতে এসে আর একজনের ছবির বাজার নষ্ট করল, এ ভাবে আমাদের ভাবানো হয়। এটা ভুল! যার ক্ষমতা আছে, নিজের প্রতি বিশ্বাস আছে তাকে কেউ আটকাতে পারবে না।আমার জীবন দিয়ে আমি এটাই বুঝেছি। একটা সময় থেকে ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় নায়কের সঙ্গে আমার কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়। আমার কোনও নায়ক ছিল না। সেই সময়ে নতুন প্রযোজক, পরিচালকদের সঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে আমি কাজ করেছি। ঈশ্বরের আশীর্বাদে সেই ছবিগুলি হিটও হয়েছে। এ ভাবেই চেষ্টা করেছি কাজ চালিয়ে যাওয়ার। তাই বলে আমি অন্য কাউকে এই প্রতিকূল অবস্থার জন্য দোষারোপ করিনি। শুধু তা-ই নয়, বড় প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে আমার ছবির কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য। এ ভাবেই কাজ করে যেতে হয়। হবেও...।
তবে মিঠুর চলে যাওয়ার পর এই লেখালেখি দেখে খুব কষ্ট হয়েছে। দেখলাম, বহু জায়গায় লেখা হয়েছে, আমি নাকি মিঠুর স্ত্রী সংযুক্তাকে একবার ফোন অবধি করিনি! এটা সম্পূর্ণ অসত্য। ও যে দিন চলে যায়, সেদিন আমি গুজরাটে ছবির শ্যুটে। খবর পেলাম আমাদের বহু দিনের রূপটান শিল্পী আজাদ মিঠুর বাড়িতেই তখন। আজাদই আমায় ফোন করে। আমি আজাদকে বলি মিঠুর স্ত্রীকে ফোনটা দিতে। ওর সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষণ কথাও হয়। এমনকি, ওর স্ত্রী সংযুক্তাই আমায় বলেছিল যে, শেষ দিনে মিঠু শ্যুট করতে যেতে চায়নি। এবং সংযুক্তাও ওকে বারণ করেছিল শ্যুটে যেতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কাজের দায়িত্ব তো এড়ানো যায় না। তাই মিঠুকে শ্যুট করতে যেতে হয়। তার পর আজাদকেই বলি, আমার নাম করে একটা মালা মিঠুকে দিতে। অভিনেত্রী ইন্দ্রাণী দত্তও ছিল সেখানে। ও-ও জানে আমি ফোন করেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ এমন একটা দিন ঘিরে আমার নামে এমন ভুল তথ্য ছড়াল কেন? আমি জানি না। সংযুক্তা বলল, আমি সমবেদনা অবধি জানাইনি! এটা হতে পারে?
ভাল লাগে না। একজন প্রযোজককে দেখেছিলাম, ফেসবুকে লিখে দিলেন ইন্ডাস্ট্রি কতটা খারাপ করেছে মিঠুর সঙ্গে। ছবি করতে দেওয়া হয়নি। আচ্ছা, ওই প্রযোজক নিজেও তো মিঠুকে দিয়ে কাজ করাতে পারতেন। ছবির কাজ দিতে পারতেন? শুধু ফেসবুক পোস্ট!জীবনের সব হিসেব এত সাদা-কালোয় হয় না। হতে পারে না। মিঠু চলে যাওয়ায় শুধু আমি নই, ওর সঙ্গে কাজ করতে থাকা ইন্ডাস্ট্রির সমস্ত মানুষ ভেঙে পড়েছিল। আজ ওর জন্মদিনে দুঃখ একটাই, ও যে একটানা এত ভাল কাজ করেছিল, তা নিয়ে দীর্ঘ কাল কোনও কথা না বলে হঠাৎ ওর মৃত্যুর পর ওকে নিয়ে কুরুচিকর বিশ্লেষণ শুরু হল।
ওর কাজ দিয়েই পরবর্তী প্রজন্ম ওকে চিনবে। আমি নিজেও তো একদিন চলে যাব...। আমার কাজ নিশ্চয়ই থাকবে। বাকি সব মিলিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে।