ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত
পয়লা বৈশাখ আমার জীবনে, স্মৃতিতে চিরনতুনের দিন। এই দিনটিতে যেন সব কিছুই নতুন।
বাড়িতে, পাড়ায় পয়লা বৈশাখ ছিল এক আনন্দ উৎসব। পয়লা বৈশাখ মানেই নতুন জামা। মিষ্টিমুখ। মায়ের সঙ্গে যেতাম গড়িয়াহাটের বাজারে। আমার নতুন পোশাক কেনা তো হতই, মাসি-পিসি, বাড়ির সবার জন্যই কেনাকাটা হত। সেই অল্প বয়সে পয়লা বৈশাখ ছিল উপহার পাওয়ার, আদর পাওয়ার দিন। অনেকটা দুর্গাপুজো বা ইদের মতো বা বড়দিনের মতোই চারদিক জমজমাট। বড় হয়ে বুঝেছি, বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব পয়লা বৈশাখ। আজ বাঙালি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। সব জায়গাতেই পয়লা বৈশাখ তাকে মনে করিয়ে দেয় বাংলা ভাষার কথা, জননী ভাষার কথা।
ছোটবেলার স্মৃতিরা মনে আজও উজ্জ্বল। বাড়ির আনন্দের পাশাপাশি আমাদের পাড়ায় নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠান হত। অনুষ্ঠানে প্রতি বছর অংশ নিতাম আমরা। আমাদের ছবি আঁকা, নাচগান শেখার স্কুলে অনুষ্ঠান। এক মাস আগে থেকেই মহড়া চলত। মনে পড়ে, সেই সময়ের সাজের কথা। কপালে লাল টিপ, মাথায় ফুল, লালপেড়ে সাদা শাড়ি। 'এসো হে বৈশাখ' আর 'হে নূতন' গান দুটো মনে গেঁথে আছে। এখনও কোথাও এই দুটো গান শুনতে পেলেই আচমকা মনে হয়, আজ কি পয়লা বৈশাখ?
জীবনে পয়লা বৈশাখের প্রাণবন্ত উপস্থিতি অনুভব করেছি সেই ছোটবেলায়। ছোট থেকে বড় হওয়ার সেই সুন্দর দিনগুলোয় ইচ্ছে করলেও আর ফিরে যেতে পারব না। স্মৃতির অলিগলি ধরে অবশ্য যাওয়া যায়। আমি তো যাই! এই এখন যেমন বাংলা নববর্ষের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মনে পড়ছে, ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখে ভোরবেলায় উঠে প্রথমে ঠাকুরমাকে প্রণাম করতাম। বড় প্রিয় মানুষ ঠাকুরমা। নববর্ষের প্রথম দিনে বাড়ির সবচেয়ে বড় মানুষকে, গুরুজনকে প্রণাম করার এই যে রীতি, এই সামাজিক রীতি বাঙালিকে আলাদা লাবণ্য দিয়েছে। শিকড়ের প্রতি ভালবাসায় দীক্ষা দিয়েছে। বড় সুন্দর। এ সব ভুলে যেতে নেই।
আজ নিজেকে একটু বিষণ্ণ লাগছে। ইন্দুমতীর কথা মনে পড়ছে খুব। আমি, ইন্দুমতী, তুতুন... একটা দল মতো ছিলাম। সব জায়গায় একসঙ্গে। একসঙ্গে কত কী যে করেছি ছোটবেলায়! কিশোরীবেলায়! বড় হওয়ার পর আমরা এদিক ওদিক ছিটকে গেলেও যোগাযোগ ছিল সব সময়। পয়লা বৈশাখ আমাদের যোগাযোগ হতই। বন্ধু ইন্দুমতী অকালে চলে গেছে কিছু দিন হল। এ বারের পয়লা বৈশাখে সে নেই। ওকে খুব মনে পড়ছে। বড় হওয়ার এই এক কষ্ট, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ছোট হয়ে যেতে থাকে বন্ধুদের দল।
চলচ্চিত্র জগতে যোগ দেওয়ার পর পয়লা বৈশাখকে আরেক রূপে পেয়েছি। ছবির মহরত হয়েছে। ছবি মুক্তি পেয়েছে। স্টুডিয়ো পাড়ায় উৎসব। ফ্লোরগুলো ফুলের মালায় সাজানো। পয়লা বৈশাখ মানেই যেন সব কিছু আবার নতুন করে শুরু করা।
নববর্ষের এই প্রথম দিনে এক বার বাংলাদেশে ছিলাম। এমন পয়লা বৈশাখ উদযাপন ভাবাই যায় না। সে বার আলমগীর ভাইয়ের ছবির শ্যুটিংয়ের জন্য গিয়েছিলাম বাংলাদেশ। অবাক হয়ে, মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম কী বড় আকারে নববর্ষ উৎসব হয় সে দেশে। অপূর্ব মঙ্গল শোভাযাত্রা! বাংলা ভাষাকে সত্যিকারের হৃদয় দিয়ে ভালবাসে বাংলাদেশ। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে রাস্তায় নাচগান, আবৃত্তি, নাটক করছে। বাঙালি সাজ। অনেকের হাতে বড় বড় বাহারি মুখোশ। বাঙালি জাতি এবং বাংলাভাষার সম্পর্কটা যে কতখানি আবেগের, তা বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করেছি। এখন কলকাতাতেও এখানে ওখানে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামবাংলায় পয়লা বৈশাখ এখনও সামাজিক উৎসব হিসেবে পালিত হয় ভাল ভাবেই।
এ বছর আমি সিঙ্গাপুরে আছি পয়লা বৈশাখে। আমার শাশুড়ি অসুস্থ। তিনি এখানে আছেন। পর পর শ্যুটিং সেরে পরিবারের সঙ্গে আজকের দিনটা কাটাব বলে চলে এসেছি। পয়লা বৈশাখ শুভ কামনার দিন। ভয়ংকর অতিমারির কবল থেকে এ বছর খানিক স্বস্তি পেয়েছে পয়লা বৈশাখ। প্রার্থনা করি, অতিমারি দূর হোক। এ দিকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে দুই দেশে। ধ্বংসের ছবি কষ্ট দেয়। মনে হয়, মানুষের শুভ চিন্তার চর্চা, শিল্পচর্চা-- সব বৃথা। মানুষকে ভালবাসায় ফেরাও, বাংলা নববর্ষ! প্রিয় পয়লা বৈশাখ!