সিরিজ ‘দহন: রাকন কা রহস্য’ এই দুই (কিংবা তিন) জগতের টানাপড়েনকেই তুলে আনতে চেয়েছে।
রাজস্থানের কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রাম। শিলাসপুরা। নাগরিক আধুনিকতা তাকে স্পর্শ করেনি, এমন বলা যাবে না। কিন্তু সেই গ্রামে এমন কিছু রয়েছে, যা তাকে সারা দেশের থেকে, এমনকি গোটা পৃথিবী থেকেও হয়তো বিছিন্ন রেখেছে। সেই বিষয়টি ওই গ্রামের বাসিন্দাদের একটি বিশেষ বিশ্বাস। অথচ সেই গ্রামে রাষ্ট্রযন্ত্রের উপস্থিতি রয়েছে, পুলিশ থানা, সরকারি প্রশাসনিক দফতর এবং সরকারি চাকরে পর্যন্ত রয়েছে। এ সব সত্ত্বেও শিলাসপুরা তার গণবিশ্বাস নিয়ে এক ও অদ্বিতীয়। এই গ্রামের মানুষ মনে করে, তারা এক অভিশাপ বহন করছে।
অন্য দিকে রাষ্ট্র আর তার সহযোগী পুঁজির মালিক গ্রামটিকে বার করে আনতে চায় সেই শিকড়ে চারিয়ে যাওয়া ‘অন্ধবিশ্বাস’ থেকে। কারণ, শিলাসপুরার মাটির নীচে রয়েছে কোনও আশ্চর্য খনিজের ভান্ডার, যা কিনা বদলে দিতে পারে সভ্যতার গতি। প্রশাসন আর প্রযুক্তি, পুঁজি আর তথাকথিত সভ্যতার নাছোড়বান্দা লোভ প্রবেশ করে গ্রামে। নিযুক্ত হয় এক মহিলা আইএএস অফিসার। গ্রামে খনি খুঁড়তে এক বেসরকারি সংস্থাকে সাহায্য করাই তার ‘মিশন’। কারণ সে মনে করে, শিলাসপুরায় খনি চালু হলে গ্রামের মানুষের ‘প্রগতি’ ঘটবে, কর্মসংস্থান ঘটবে, আধুনিক নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের স্বাদ পাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
উপরে বলা দু’টি বিবরণ পরস্পর-বিরোধী। গ্রামের মানুষ তাদের বিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে রাজি নয়। কারণ সেই বিশ্বাসের জন্ম এক অন্ধকার অতীতে। আর খনি সংস্থা তার লোভের প্রতি একনিষ্ঠ। মহিলা প্রশাসনিক একনিষ্ঠ রয়েছেন তাঁর বিচার ক্ষমতা তথা যুক্তিবাদে। ডিজনি প্লাস হটস্টার-এর সাম্প্রতিক হিন্দি ওয়েব সিরিজ ‘দহন: রাকন কা রহস্য’ এই দুই (কিংবা তিন) জগতের টানাপড়েনকেই তুলে আনতে চেয়েছে। বিজ্ঞান-প্রসূত যুক্তিবাদ (যুক্তিবাদ-প্রসূত বিজ্ঞানও হতে পারে) যে চিন্তাপদ্ধতিগুলিকে ‘অযৌক্তিক’, ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ বা ‘অন্ধবিশ্বাস’ বলে বর্ণনা করে এবং ‘সর্বজনীন বৈজ্ঞানিক যুক্তিকাঠামো’ বা ইউনিভার্সাল সায়েন্টিফিক রিজনিং-কে এক এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী চিন্তাপদ্ধতি বলে চাপিয়ে দেয়, সেই চাপিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি এবং প্রচেষ্টার ফলে জন্ম নেওয়া এক রুদ্ধশ্বাস কাহিনিকেই বুনেছেন পরিচালক বিক্রান্ত পওয়ার। জয় শর্মা, নিখিল নায়ার এবং শিবা বাজপেয়ীর কাহিনি ও চিত্রনাট্য মানবসভ্যতার এই বিশেষ সমস্যাটিকে পরিবেশন করেছে যে আঙ্গিকে, তাকে সোজা কথায় ‘হরর কাহিনি’ বলা যেতেই পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সিরিজ ‘হরর’-এর বাইরে বেরিয়ে গিয়ে অতিরিক্ত কিছু দর্শককে দেয়, যা হজম করতে সত্যিই সময় লাগে।
ভূত নয়, তবে কীসের ভয় ‘দহন’-এ?
শিলাসপুরার বাসিন্দারা বিশ্বাস করে, তাদের গ্রামের উপর এক অভিশাপ রয়েছে। এই বিশ্বাস তারা বহন করছে যুগযুগান্ত ধরে এক কিংবদন্তির মাধ্যমে। তাদের ধারণা, শিলাসপুরার মাটির গহীন তলদেশে ঘুমন্ত রয়েছে ‘রাকন’ নামে এক অশুভ শক্তি। বেশি খোঁড়াখুঁড়ি করলে সে বেরিয়ে আসতে পারে। রাকন মানুষকে তার দাসে পরিণত করতে পারে, তার ‘মনুষ্যত্ব’-কে লহমায় ধ্বংস করে দিয়ে তাকে মহাবলশালী এক দানবে পরিণত করতে পারে। রাকন এক মায়াবিনীর সন্তান। হাডিকা নামের সেই মায়াবিনীই পারে রাকনকে নিয়ন্ত্রণ করতে। রাকন যাতে না জাগে, তার জন্য গ্রামে রয়েছে এক ‘শিলাস্থল’, যেখানে এক বিচিত্র ঢিপিকে সেই গ্রামের ‘প্রমুখ’ (প্রধান পুরোহিত) পুজো করে বা নানা উপচারে তুষ্ট রাখে। কিন্তু খনি কোম্পানির খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হলে রাকন জেগে উঠতে পারে, তখন মহামারির মতো সে গ্রাস করে নিতে পারে গ্রামের পর গ্রাম, হয়তো গোটা সভ্যতাকেই।
খনি সংস্থা তার নিজের যুক্তিতে অবশ্যই এই কাহিনি বিশ্বাস করে না। আপাদমস্তক লোভী কর্তা আর সদ্য সেই গ্রামে আসা অবনী রাওয়ত নামের মহিলা আইএএস গ্রামে নিয়ে আসতে চান যুক্তি-তর্ক, যা ‘গপ্পো’-র দিন শেষ করে গ্রামবাসীকে ‘প্রগতি’র রাস্তায় নিয়ে যাবে। অবনীরও এক ছায়াচ্ছন্ন অতীত রয়েছে। সে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছিল। এবং তারই জেরে তার স্বামী আত্মহত্যা করে। পরে অবনী বেকসুর প্রমাণিত হয় এবং কাজে যোগ দেয়। সে নিজে থেকেই শিলাসপুরা যেতে চায়। সঙ্গে তার একমাত্র ছেলে অনয়। অনয় আবার অত্যন্ত গোলমেলে এক মানসিকতার মধ্যে রয়েছে। বাবার মৃত্যুকে সে মেনে নিতে পারেনি, প্রশাসনিক মায়ের ছড়ি ঘোরানোকেও সে সহ্য করতে পারে না। শিলাসপুরায় আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অবনী এক অতিপ্রাকৃত অনুভূতি প্রাপ্ত হয়। তার যুক্তিবাদী মন সেই অনুভূতিকে মেনে নিতে পারে না। বিভ্রম বলে সে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় মাত্র। ওদিকে অনয় জড়িয়ে পড়ে গ্রামের প্রায় সমবয়সি চার কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে এবং বিশ্বাস করতে থাকে শিলাসপুরার রাকন-কিংবদন্তিতে।
এই সিরিজ ‘হরর’-এর বাইরে বেরিয়ে গিয়ে অতিরিক্ত কিছু দর্শককে দেয়, যা হজম করতে সত্যিই সময় লাগে।
খনি খোঁড়ার কাজ কিছু দূর এগোতে না এগোতেই গ্রামে ঘটতে থাকে রহস্যমৃত্যু। এক খনিশ্রমিক অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করে এবং একের পর এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুরু করে। তার ভিতর থেকে মনুষ্যত্ব যেন উবে গিয়েছে, সে যেন এক অজ্ঞেয় শক্তির আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত। খনির কাজের সূত্রপাতে ডিনামাইট বিস্ফোরণে শিলাস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রমুখ স্বরূপ খনি সংস্থা এবং অবনীকে জানায় যে, এর ফলে সর্বনাশ ঘটে যাবে। এবং ‘সর্বনাশ’ ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠতে শুরু করে।
একের পর এক মানুষের হত্যা যখন ঘটে চলেছে, অবনীর এক পক্ষীবিদ বন্ধু সন্দীপ আবিষ্কার করে পাখিদের মধ্যেও এই হন্তারক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। তারা পরস্পরকে হত্যা করছে। দেখা যায়, জলাশয়ে অগণিত মরা মাছ ভেসে উঠছে। প্রমুখ এ সমস্ত কিছুকেই রাকনের জাগরণের ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নেয়। আর অবনী খুঁজতে থাকে এর পিছনে ক্রিয়াশীল ‘বৈজ্ঞানিক’ কারণকে। প্রমুখের নিজস্ব গোষ্ঠীর মধ্যেও ঘাত-প্রতিঘাত রয়েছে। অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের শত্রুতা রয়েছে। এ যেন এক সনাতন ভারতবর্ষ, যেখানে কাহিনি আর কহাবত, কালপরম্পরায় চলে আসা শত্রুতা আর হিংসার নির্বিকার সহাবস্থান। খনি সংস্থা আর অবনী আধুনিক সভ্যতা আর প্রশাসনের প্রতিনিধি। কিন্তু তাদেরও চিন্তা এক সময়ে ধাক্কা খায়। অবনী অসম্ভব সব পরিস্থিতিতে তার মৃত স্বামীকে দেখতে শুরু করে। কিন্তু সে সেটাকে ‘বিভ্রম’ বলে ধরে নিলেও দেখা যায়, অবনীর এই অ-প্রাকৃত দর্শনের বিষয়টি প্রমুখ জানে। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, ‘সত্য’ কী? রাকন-হাডিকার কাহিনি কি সত্য, কারণ সেই কিংবদন্তিতে বলা ভবিষ্যদ্বাণী ফলতে শুরু করেছে। না কি পাখিদের মৃতদেহ আর ‘রাকন’-এর আক্রমণে নিহত মানুষদের ময়নাতদন্ত থেকে অন্য কোনও সত্যকে খুঁজছেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ? মানুষের মাথায় বইতে থাকা স্থির বিশ্বাসগুলিকে ‘দহন’-এর চিত্রনাট্য, আশ্চর্য দৃশ্যগ্রহণ, নিখুঁত সেট ও অসম্ভব রকমের সংযত স্পেশাল এফেক্ট ঘেঁটে দিতে থাকে। মুহূর্তে মুহূর্তে কাহিনি মোড় নেয়। থ্রিলার ও হরর-এর সংমিশ্রণে ‘চিলার’ নামক যে জ্যঁরটিকে এই মুহূর্তে পশ্চিমী দুনিয়া ভাবতে চাইছে, প্রায় সেই রাস্তাতেই হেঁটেছেন পরিচালক। হিন্দি ‘হরর’ ছবির চেনা ছক এখানে নেই। এই ‘ভয়’ দর্শকের ভাবনার সীমাকেও মাঝেমাঝে তছনছ করে দেয়। খনিগর্ভে কী রয়েছে, যা মানুষকে এমন মহাহিংস্রতায় নিয়ে যায়? ‘রাকন’ কি কিংবদন্তি মাত্র, যার রূপকের অন্তরালে থমকে রয়েছে কোনও বিশেষ সাবধানবাণী, যা মানুষকে প্রকৃতির সব কিছু ওলটপালট করতে নিষেধ করে? সাহিত্যিক তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘অলাতচক্র’ উপন্যাসে এমন কোনও শক্তির কথা লিখেছিলেন, যা ‘সভ্যতা’কে তার কাছে ঘেঁষতে দিতে চায় না। বিভূতিভূষণও কি ‘আরণ্যক’-এ এমন শক্তির আভাস দেননি? আমেরিকান হরর সাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ এইচ পি লাভক্র্যাফটের ‘থুলু মিথোজ’-এর কাহিনিমালা তো এমন কিছুর কথাই বলে।
‘দহন’ একটি বিষয়কে স্পষ্ট করে দিল যে, ভারতীয় সিনেমায় উদ্ভট ভয়ের ছবির অবসান ঘটেছে। অতৃপ্ত আত্মা বা ‘শয়তানি তাকত’-এর বাইরেও যে এক আলো-অন্ধকারে মোড়া জগৎ থেকে যায়, তা এর আগে দেখা গিয়েছিল ‘টুম্বাড’ (২০১৮) ছবিতে। কিন্তু সে ছবি ছিল কিছুটা নীতিকথার মতো। ‘দহন’ আপাত ভাবে কোনও নৈতিক জ্ঞান দিতে চায়নি। সোজাসাপটা ভাবে এই সিরিজ বলতে চেয়েছে প্রগতির সঙ্গে বিশ্বাসের, বিশ্বাসের সঙ্গে যাপনের, যাপনের সঙ্গে মনোজগতের সঙ্ঘাত আর সহাবস্থান-সমঝোতার এক আখ্যানকে। টিস্কা চোপড়া (অবনী), সৌরভ শুক্ল (প্রমুখ), রোশন জোশী (অবনীর ছেলে অনয়), পঙ্কজ শর্মা, রাজেশ তিলং প্রমুখের অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ওয়েব সিরিজ যে ‘বিশ্বস্ত’ অভিনয়ধারাকে এর মধ্যেই এ দেশে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, এঁরা সকলেই তার উপযুক্ত মর্যাদা রেখেছেন। ‘দহন’ দুই বা তিনটি সিজনে শেষ হবে বলে খবর। অপেক্ষা থাকল পরের সিজনের জন্য।