‘আজিব দাস্তানস’।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এখন অ্যান্থোলজি ছবির ট্রেন্ড নতুন কিছু নয়। আগে দর্শক উপহার পেয়েছেন 'লাস্ট স্টোরিজ,' 'ঘোস্ট স্টোরিজ'-এর মতো ছবি, এবং সেই তালিকায় নতুন নাম নেটফ্লিক্সের ছবি 'আজিব দাস্তানস'। এই ছবিতেও তেমনই ৪টি পৃথক প্লটের গল্প, 'মজনু', 'খিলোনা', 'গিলি পুচ্চি' এবং 'অনকহি' এক একে ছুঁয়ে যায় জাত-লিঙ্গ-শ্রেণি বৈষম্যের মতো সমাজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।
২ ঘন্টা ২২ মিনিটের এই ছবির প্রারম্ভেই যে গল্প আমরা পাই, তা অবশ্য কিঞ্চিৎ দুর্বল। শশাঙ্ক খৈতানের 'মজনু' শুরু হয় ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতার কন্যা লিপাক্ষী ও বড় ব্যবসায়ী বাবলুর ফুলশয্যার দৃশ্য দিয়ে, যেখানে বাবলু স্পষ্ট করে দেয় যে এই বিয়ে বলপূর্বক এবং তার অমতে, একেবারেই রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে। ফলে লিপাক্ষী যেন কোনও ভালবাসা প্রত্যাশা না করে। বিবাহে উপেক্ষিত লিপাক্ষী প্রায় আশা হারাতে বসেছে যখন, তখন তার জীবনে আসে রাজ। এর পরবর্তীতে তৈরি হওয়া ত্রিকোণ সম্পর্কের দ্বন্দ্ব ও টানাপড়েনই মূলত এই ছবির বিষয়বস্তু।
'মজনু' নিঃসন্দেহে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ মিথ ভেঙেছে, যার একটি অবশ্যই 'বিবাহ' নামক প্রতিষ্ঠান। শশাঙ্ক সরাসরি দেখিয়েছেন এর প্রাতিষ্ঠানিকতা— বিয়ের মূলে যে এখনও অর্থনৈতিক উন্নতির অভিসন্ধি থাকে, এবং এটি যে প্রকৃতপক্ষে একটি চুক্তিপত্র, তা উঠে আসে এই ছবিতে। তার সঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ্য পিতৃতন্ত্রে পুরুষের দ্বিচারিতা এবং এক উপেক্ষিতা স্ত্রীর স্বাভাবিক অথচ নিষিদ্ধ যৌন কামনার মতো তাৎপর্যপূর্ণ দিক। তবে এত অল্প সময়ে এত কিছু ধরতে গিয়ে খানিকে আপস করতে হয়েছে গল্পে। সংলাপও অত্যন্ত সরাসরি হয়ে যাওয়ায় তা ছাপ ফেলতে পারে না কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। নীল ও হলুদ রঙের বৈপরীত্যে সুন্দর আলোর ব্যবহারে ফ্রেমগুলি মনে থেকে যায়। আর মনে থেকে যায় লিপাক্ষীর ভূমিকায় ফাতিমা সানা শেখের দৃপ্ত অভিনয়।
পরের গল্প রাজ মেহতার 'খিলোনা'-র মূলে রয়েছে এক পরিচারিকার চোখ দিয়ে দেখা শ্রেণিগত বৈষম্যের সমস্যা। উচ্চবিত্ত পরিবারে পরিচারিকা হিসেবে নিযুক্ত মীনাল একাই থাকে তার চতুর্থ শ্রেণিতে পাঠরতা বোন বিন্নির সঙ্গে। ছবিতে উঠে আসে বাড়ি বাড়ি কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাড়ির মালিকের কাছে পরিচারিকাদের শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা। এই ছবির মূল সমস্যা শ্রেণির মতো গুরুতর এক বিভাজক শক্তির উপর মন্তব্য করলেও বার বার তা বিক্ষিপ্ত হয়েছে, ফলে শ্রেণিবৈষম্যের প্রতিবাদ কিছু দৃশ্য বা সংলাপ ছাড়া তেমন জোরালো হতে পারেনি। সব চেয়ে বড় সমস্যা হয়তো পরিচারিকা মীনালের ভূমিকায় নুসরাত ভারুচার চরিত্রায়ন। তার রূপটান এবং উচ্চারণ, উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্বাসযোগ্যতার ফাঁক রয়ে গেছে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো দক্ষ অভিনেতাও ছোট ভূমিকায় আলাদা করে নজর কাড়তে পারেননি। বরং ভাল লেগেছে বিন্নির ভূমিকায় ছোট্ট ইনায়ত বর্মাকে।
'মাসান'-এর মতো সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করা ছবি রয়েছে যাঁর ঝুলিতে, সেই নীরজ ঘেওয়ানের পরিচালনায় এই ছবির তৃতীয় গল্প 'গিলি পুচ্চি' যে বিশেষ প্রত্যাশা তৈরি করবে তা বলাই বাহুল্য। নীরজ হতাশ করেননি, উপরন্তু নির্দ্বিধায় বলা চলে 'গিলি পুচ্চি'-ই এই সংকলনের সবচেয়ে নৈপুণ্যের সঙ্গে তৈরি ছবি। জাতপাত ও কর্মরতা মহিলার বিরুদ্ধে পারিবারিক চাপের মতো একাধিক জটিলতা উঠে আসে ছবিতে। এই ছবি জাত-বৈষম্যের বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুই নারী— দলিত ভারতী মণ্ডল ও উচ্চবর্ণ প্রিয়া শর্মার আদানপ্রদানের গল্প। সংরক্ষণের ফলে উচ্চবর্ণ জেনারেলদের সিট কেড়ে নিচ্ছে দলিতরা— এহেন অভিযোগের মুখে একটা সপাটে চড় ভারতীর গল্প, যে কেবল 'মণ্ডল' হওয়ার অপরাধে ৭৪% নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও তার স্বপ্নের পদ পায় না। অথচ, 'শর্মা' হওয়ার সুবাদে সাক্ষাৎকারে বসের হাত দেখে দিয়ে সেই পদ পেয়ে যায় প্রিয়া।
অন্যান্য ৩টি ছবির থেকে মূলত যে কারণে এটি আলাদা ভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকে তা হল সূক্ষ্মতা। বিভিন্ন দৃশ্যে, সংলাপে ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গীতে এত সূক্ষ্ম ভাবে জাতিবৈষম্যের শিকড় তুলে ধরা হয়েছে এখানে যে, এ ক্ষেত্রে প্রতিবাদের ভাষাও সবচেয়ে জোরালো। অপ্রত্যাশিত ভাবেই এক অদ্ভুত পরিসর তৈরি হয় ভারতী ও প্রিয়ার, যেখানে জাতপাতের বৈষম্য ফুটে ওঠা সত্ত্বেও পিতৃতন্ত্রে নারী পরিচয়ের জন্য তাদের অবদমিত অবস্থান তাদের কাছাকাছি আনে। উচ্চবর্ণ বাড়িতে ভারতীকে আলাদা করে স্টিলের কাপে চা দেওয়া বা কর্মস্থলে প্রিয়ার জন্মদিনের সারপ্রাইজ পার্টিতে তাকে কেক কেটে শ্রমিকদের মধ্যে ভাগ করে দিতে বলার মধ্যে যে সুপ্ত জাতবিদ্বেষ রয়েছে, তা আরও প্রকট হয়েছে ভারতীর চরিত্রে কঙ্কনা সেনশর্মার শক্তিশালী অভিনয়ে। কঙ্কনার পাশাপাশি মনে থেকে যাবে প্রিয়ার চরিত্রে অদিতি রাও হায়দরিকেও। কঙ্কনা ও অদিতি জুটি কেবল 'গিলি পুচ্চি' নয়, গোটা ছবিরই এক প্রাপ্তি হয়ে থাকবে।
ছবির শেষ গল্প কায়োজে ইরানির 'অনকহি'। ক্রমশ বধির হয়ে চলা মেয়ের জন্য সাংকেতিক ভাষা রপ্ত করেছেন নাতাশা, কিন্তু স্বামী সেই পরিশ্রম ও সময় ব্যয় করতে অরাজি। এই সাংসারিক অশান্তির মধ্যেই নাতাশার পরিচয় ঘটে মূক ও বধির চিত্রগ্রাহক কবিরের সাথে, যার মধ্যে নাতাশা ফিরে পায় যত্ন ও ভালবাসা। মূলত সংকেতের উপরেই নির্মিত এই ছবি। তবে সংলাপের অভাব ঢেকেছে আবহসঙ্গীত ও নাতাশা-কবিরের সাংকেতিক কথোপথনের মিষ্টি দৃশ্যগুলি। এক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় নাতাশার ভূমিকায় শেফালি শাহের দৃপ্ত চরিত্রায়ন এবং কবিরের ভূমিকায় মানব কৌলের অভিনয়। 'গিলি পুচ্চি'-র পরেই এই গল্প সামান্য ম্লান লাগলেও সম্পূর্ণ ছবির সব ক'টি গল্পের বিচারে এটি মনে থেকে যায়।
৪টি গল্পের মধ্যে জাতপাত, শ্রেণি ও পিতৃতন্ত্রের মতোই পাশাপাশি উঠে এসেছে যৌনতা ও যৌন পরিচয়ের কথা, এবং সেই সংক্রান্ত সমস্যা ও সংগ্রাম। ফলে 'আজিব দাস্তান' অ্যান্থোলজির ধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি বটেই, এবং বেশ কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত ও সংলাপের জন্যও এটি এক বার দেখাই যায়। যদি বলা হয় 'গিলি পুচ্ছি'-ই এই ছবি দেখার যথেষ্ট কারণ, তা হলেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না।