অঁসম্বল কাস্ট নিয়ে একাধিক প্লটের গল্প আগেও বলেছেন অনুরাগ বসু। ছবির নাম ‘লাইফ ইন আ...মেট্রো’। কসমোপলিটন শহরের গল্প বাঁধা ছিল প্রেম ও অপ্রেমের সরু সুতোয়। সেই ছবির তেরো বছর পরে অনুরাগের নেটফ্লিক্স ছবি ‘লুডো’র ঘুঁটিগুলিও ছুটছে প্রেমের টানে। কোথাও একতরফা প্রেম, কোথাও প্রেমবর্জিত যৌনতা, কোথাও হারিয়ে যাওয়া অপত্য স্নেহকে হাতড়ে বেড়ানো... প্রেমের চিরন্তন ভাষা নয়া রূপ পেয়েছে বাঙালির পরিচিত লুডোর বোর্ডে। প্রেমের রং এখানে নীল, কোথাও বা সবুজ...
তবে এ ছবি শুধু প্রেমের নয়, জীবনবোধেরও। পরিচালকের নিজস্ব ভাষা ও মননের, যেখানে বাস্তব আর কল্পনাবিলাসের সহজ সহাবস্থান। ‘জগ্গা জাসুস’-এর পরে ফের এই ছবিতে সিনেম্যাটিক ভাষা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করলেন অনুরাগ। কোথাও ডার্ক কমেডি, কোথাও বা সিচুয়েশনাল কমেডি... নানা জ়ঁরের গণ্ডি ছাড়িয়ে চরিত্রগুলি ছুটে-খেলে বেড়ায় অনুরাগের তৈরি করা ব্রহ্মাণ্ডে। কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। তবে মন ভাল রাখার উপাদানগুলি আগাগোড়া ছবিতে অক্ষুণ্ণ ছিল।
লুডোর হলুদ ঘুঁটি আকাশ (আদিত্য রায় কপূর) পেশায় ভেন্ট্রিলোকুইস্ট। শ্রুতির (সানিয়া মলহোত্র) সঙ্গে তার সঙ্গমের ভিডিয়ো ভাইরাল। এ দিকে ঘটনার দিনতিনেক পরেই বিয়ে শ্রুতির। সবুজ ঘুঁটি, অলোক বা আলু (রাজকুমার রাও) মিঠুন চক্রবর্তীেক অনুকরণ করে। একতরফা প্রেম পিঙ্কির (ফতিমা সানা শেখ) স্বামীকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বদ্ধপরিকর সে। লাল ঘুঁটি জেল-ফেরত গুন্ডা বিট্টু (অভিষেক বচ্চন), যার পরিবার ছত্রভঙ্গ। মেয়ে বাবা বলে চেনে তার স্ত্রীর দ্বিতীয় স্বামীকে। ছ’বছরের ঘরছুট মিনির (ইনায়াত বর্মা) সঙ্গে বিট্টুর চলে অন্তরের খেলা। নীল ঘুঁটি, রাহুল (রোহিত শরাফ)। প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সে ধরতে চায় দক্ষিণী শ্রীজার (পার্লে মানে) হাত। লুডোর ছক্কা ডন সত্তু ভাইয়া (পঙ্কজ ত্রিপাঠী)।
লুডো
পরিচালনা: অনুরাগ বসু
অভিনয়: পঙ্কজ, অভিষেক, আদিত্য, রোহিত, রাজকুমার, সানিয়া, ফতিমা
৬.৫/১০
প্রথম থেকেই চারটি ঘুঁটির চলার পথে একে-অন্যের অপরিকল্পিত বিচরণ। গল্পের চলন ঘটনাবহুল নয়, বরং পরিস্থিতিভিত্তিক। তবে এই ছবিতে যা বারবার করে দেখার মতো, তা হল প্রোডাকশন ডিজ়াইন। রাঁচী, ভিলাইয়ের মতো শহরের কথা বলা হলেও অনুরাগের ছবির ভৌগোলিক ঠিকানা নেই। এক ছুটেই টপকে ফেলা যায় রেল লাইনের ট্র্যাক, সুযোগ পেলে কলকাতার বহুরূপীরাও ঠেলাগাড়িতে উঠে পড়ে, হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলা যায় নাগাল না পাওয়া মুহূর্তের। সিনেম্যাটোগ্রাফার এবং প্রোডাকশন ডিজ়াইনার অনুরাগকে এই ছবিতে নতুন করে চিনতে হয়। চরিত্রগুলো খুবই সাধারণ। তবে এই অচেনা পরিমণ্ডলেই যেন তারা দর্শকের বেশি কাছের হয়ে ওঠে।
ছবির মুখ্য চরিত্রাভিনেতাদের সঙ্গে প্রথম বার কাজ করলেন অনুরাগ। অভিষেকের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স হয়ে থাকবে এই ছবি। এক দিকে পঙ্কজের কমিক টাইমিং, অন্য দিকে রাজকুমারের নাচের ছন্দে দুঃখকাহন বলার শৈলী, অসামান্য। আদিত্য ও সানিয়ার জুটি বেশ ভাল লাগে। রাজনৈতিক ইঙ্গিতপূর্ণ ছবির সেরা সংলাপগুলি বলতে পেরেছেন আদিত্য। এটি তাঁর উপরি পাওনা। বাকি শিল্পীরাও তাঁদের চরিত্রে ভাল।
অনুরাগের ছবি ও প্রীতমের সঙ্গীত একে অপরের পরিপূরক। অরিজিৎ সিংহের কণ্ঠে ‘আবাদ বরবাদ’, ‘হরদম হমদম’ প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে। কোনও কোনও দৃশ্যে সংলাপের পরিবর্ত হয়ে উঠেছে সঙ্গীত।
তবে ছবির সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা, ঘটনাপ্রবাহ ও লুডোর সঙ্গে চরিত্রদের মিল বলে দেওয়ার জন্য কথকের প্রয়োজন হয়। ছবির নিজস্ব এনার্জি ও ভাষার উপরে ভরসা রাখতে পারেননি পরিচালক। কিছু ক্ষেত্রে লেখনীর দুর্বলতা প্রতিভাত। ছবির দৈর্ঘ্য সমস্যারও বটে। এই ছবির ঘরানাও যে একেবারে নতুন, তা নয়। বরং ‘বরফি’, ‘জগ্গা জাসুস’-এর পরে এই ছবি যেন অনুরাগের ঘরে ফেরা, ঠিক লুডোর ঘুঁটির মতো।