সুজন নীল মুখোপাধ্যায়, সৌরভ পালোধি, অম্বরীশ ভট্টাচার্য। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
সেই ব্রিটিশ রাজত্বও নেই, সেই সাহেবিয়ানাও অতীত। তা বলে ২০০ বছরের পরাধীনতা কি এত সহজে ভোলা যায়? তাই এখনও বড়দিন আর ইংরেজি বর্ষবরণের রাত এলে বাঙালির গন্তব্য পার্ক স্ট্রিট। যেখানে আদ্যন্ত সাহেব সেজে, পানপাত্রে চুমুক দিয়ে, ইষৎ টলোমলো পায়ে এবং স্খলিত কণ্ঠে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর রেওয়াজ আজও বর্তমান। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি নিশিঠেক। সেখানে পপ গানের দাপট। রাত বারোটা বাজলেই স্থানীয় গির্জায় ঘণ্টাধ্বনি। এ ভাবে শহর নতুন বছরে পা রাখে প্রতি বছর।
ঠিক উল্টো ছবি অ্যাকাডেমি চত্বরে। সেখানেও রাতজাগা, গান শোনা, উচ্ছ্বাস, উল্লাস— সবই আছে। কিন্তু সমে বাঁধা। পপ গানের বদলে সেখানে শোনা যায় নাটকের গান। দর্শক রাত জাগে নাটক দেখে। একের পর এক নানা স্বাদের নাটক মঞ্চস্থ হয়। বঙ্গ মতে এমন ইঙ্গ বর্ষবরণের ধারা ১৯৯৯ সালে চালু করেছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী। ‘নাট্য স্বপ্নকল্প’ নাম তার। ‘চেতনা’ নাট্যগোষ্ঠীর অন্যতম কর্ণধার সুজন নীল মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথায়, “বিভাসদা সেই সময় বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট করে দিতেন। তাকে ঘিরে নতুন বছরে নতুন নাটক। আলাদাই উত্তেজনা।” ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই ধারা চলেছিল। সেই সময়ের নাট্যমোদী দর্শক খুবই উৎসাহ নিয়ে ভিড় জমাতেন অ্যাকাডেমিতে।
মাঝে বছর ছয়েকের বিরতি। ফের হাল ধরলেন এই প্রজন্মের নাট্যব্যক্তিত্বরা। সুজন নীল মুখোপাধ্যায়, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, সৌরভ পালধি হয়ে এ কালের ঋদ্ধি সেন, সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়। সেই রাতভর নাটক, সেই নাটকের গানে বর্ষবরণ। নাম ‘ইচ্ছেমতো পার্বণ’। সৌরভ আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছেন, “নাম বদলেছে। নাটকের ধারাতেও সামান্য বদল এসেছে। বাকিটা কিন্তু এক।” এ-ও জানিয়েছেন, এখনও বিভাস চক্রবর্তীর ‘নাট্য স্বপ্নকল্প’ উৎসব হয়।
এ বারের পার্বণে কী কী থাকছে? সৌরভ জানিয়েছেন, ৩১ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৯টা থেকে মঞ্চস্থ হবে নানা স্বাদের নাটক। তালিকায় ‘উদ্বোধনী পার্বণ’, ‘মাটির জন্য’, ‘পুনুপিসি পিএনপিসি’, ‘বড়দা বড়দা’, ‘আনসেন্ট লেটার্স’, ‘বনবিবি পালা’, ‘চিচিবাবা ল্যান্ড’ মঞ্চস্থ হবে। এর মধ্যে ‘পুনুপিসি পিএনপিসি’ একা মঞ্চস্থ করবেন মানসী সিংহ। ‘চিচিবাবা ল্যান্ড’ পরিবেশন করবে এক দল খুদে অভিনেতা। ‘উদ্বোধনী পার্বণ’-এ থাকবেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, কিঞ্জল নন্দ, সীমা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
এছাড়াও থাকবে নাটকের গান। দেবদীপ মুখোপাধ্যায়ের উপস্থাপনায় গান শোনাবেন সুজন নীল, অম্বরীশ, ঋদ্ধি, সুরঙ্গনা, আহেলি সরকার। আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করেছিল প্রথম দুই শিল্পীর সঙ্গে। উভয়েই তিনটি করে গান শোনাবেন। সুজন নীলের ঝুলিতে ‘মারীচ সংবাদ’-এর ‘সিয়ার গান’, ‘নরক গুলজার’-এর ‘কথা বোলো না কেউ শব্দ কোরো না’ এবং ‘ডন তাকে ভাল লাগে’র ‘তাকে ভাল লাগে’। এ ছাড়া, কবীর সুমনের ‘চেনা দুঃখ চেনা সুখ’, অঞ্জন দত্তের ‘আমার জানলা দিয়ে আমার পৃথিবী’ গান দু’টি কাছাকাছি সুরের হওয়ায় এক সুরে বেঁধে নতুন ভাবে পরিবেশন করবেন। অম্বরীশের ঝুলিতেও একই ভাবে তিনটি গান। অভিনেতা শোনাবেন, ‘সীতা’ নাটকের ‘অন্ধকারের অন্তরেতে’, ‘রাজনৈতিক হত্যা’র ‘গর্তের ভিতর থাকি আমরা’ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকের গান।
গত পাঁচ বছরের মতো এ বছরেও ইংরেজি বর্ষবরণে পার্ক স্ট্রিট বনাম অ্যাকাডেমি হতে চলেছে? পপ গান বনাম নাট্য গান?
সুজন নীল, সৌরভ, অম্বরীশ— তিন জনেরই দাবি, “বনামের কোনও জায়গাই নেই। যাঁরা নাটক ভালবাসেন তাঁরা দল বেঁধে এখনও অ্যাকাডেমিতেই আসেন। হতে পারেন তাঁরা আগের প্রজন্মের। একই সঙ্গে এই প্রজন্মেরও। তাঁরা রাত জাগেন নাটক দেখবেন বলে, নাটকের গানে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবেন বলে।” ওঁদের উদ্যম নাট্যব্যক্তিদেরও প্রতি বছর এই বিশেষ আয়োজনে আগ্রহী করে তোলে।