Flaws of Jawan

তবু কিছু খুঁত রহিয়া গেল, জওয়ান-ঝড়ের মধ্যেও স্রোতের উল্টোপথে হাঁটল আনন্দবাজার অনলাইন

‘জওয়ান’ যে জনপ্রিয় হবে, বক্স অফিসে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করবে, নিজের তৈরি করা রেকর্ড যে শাহরুখ খান নিজেই ভেঙে দেবেন, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। তবে কয়েকটা খুঁত থেকেই গেল।

Advertisement

অঙ্গীরা চন্দ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:৩৪
Share:

আবার চর্চায় ‘জওয়ান’ শাহরুখ খান। — ফাইল চিত্র।

শাহরুখ খানের ‘বুড়ো হাড়ে ভেলকি’ দেখতে কাকভোরে সিনেমা হলে ভিড় করার মতো মানুষের অভাব নেই কলকাতায়। ‘পাঠান’-এর পর ‘জওয়ান’-এর উন্মাদনাও তা-ই বলে দিল নির্ভুল ভাবে। কোথাও বৃহস্পতিবার ভোর ৫টা, কোথাও সকাল সাড়ে ৬টার শো ‘হাউসফুল’। প্রেক্ষাগৃহের বাইরে-ভিতরে থিকথিক করছে ভিড়। কেউ কেউ একই দিনে দু’টি শো-এর টিকিট কেটে রেখেছিলেন!

Advertisement

‘জওয়ান’ যে জনপ্রিয় হবে, বক্স অফিসে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করবে, নিজের তৈরি করা রেকর্ড যে শাহরুখ খান নিজেই ভেঙে দেবেন, তা নিয়ে বিশেষ সন্দেহ ছিল না। ট্রেলার মুক্তির আগেই ‘সুপারহিট’ তকমা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। প্রশ্ন ছিল একটাই— ‘জওয়ান’ কি ‘পাঠান’কে ছাপিয়ে যাবে?

আট মাসের ব্যবধানে দু’টি পুরোদস্তুর অ্যাকশন থ্রিলার। তবে প্রথম দিন থেকেই ‘জওয়ান’ শাহরুখ ‘পাঠান’ শাহরুখকে হারিয়ে দিয়েছেন। অ্যাটলির ছবিতে চরিত্রের নির্মাণ, বাণিজ্যিক সাফল্যের মশলাপাতি সত্যিই নিখুঁত। কিন্তু প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা পরে হল থেকে বেরিয়ে মনে হল, তবু কিছু খুঁত রহিয়া গেল!

Advertisement

১. দ্বৈতচরিত্রে শাহরুখ

‘ওম শান্তি ওম’ বা ‘ডুপ্লিকেট’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা শাহরুখের দ্বৈতচরিত্রের সঙ্গে পরিচিত। ‘জওয়ান’-এর সবচেয়ে বড় চমকও শাহরুখের সেই দ্বৈতরূপ। কিন্তু সেখানেই সবচেয়ে বড় হোঁচট পরিচালক অ্যাটলির। পিতা-পুত্রের দ্বৈত ভূমিকায় কিং খান? উঁহু, ঠিক জমেনি। প্রায় একই ধরনের সাজ, একই ভাবভঙ্গি, মেকআপ— অ্যাটলি কি পিতা-পুত্রকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন শুধু দাড়ি-গোঁফ দিয়ে? ৫৭ বছরের শাহরুখের ক্ষেত্রে সেটা যথেষ্ট মনে হয়নি। পর্দায় কখন বাবা, কখন ছেলে— বার বার গুলিয়ে যাচ্ছে।

২. গানের জওয়ান

কাহিনি, চিত্রনাট্য-সহ একাধিক দৌড়ে ‘পাঠান’কে নিশ্চিত ভাবে ছাপিয়ে গিয়েছে ‘জওয়ান’। কিন্তু মনে রাখার মতো গান নেই। বাণিজ্যিক স্বার্থেই গুটিকয়েক গানের ব্যবহার করা হয়েছে। সেগুলো ছবির গতিকে খানিক শ্লথই করে দিয়েছে। শেষ দিকে ‘রামাইয়া বস্তাবইয়া’-র সুর-তাল কানে লেগে থাকে। বাকি গানে সেই ‘জোশ’ নেই। জনপ্রিয়তায় ‘পাঠান’-এর গানের ধারেকাছে থাকবে না ‘চলেয়া’ বা ‘জ়িন্দা বান্দা’।

৩. গল্পের গরু গাছে?

বাণিজ্যিক মশলায় ভরপুর অ্যাকশন থ্রিলার। সেখানে গল্পের গাঁথুনি আঁটসাঁট হওয়া অসম্ভব। ‘জওয়ান’-এও তাই বার বার গল্পের গরু গাছে উঠেছে। বুকে পাঁচটা গুলি খেয়ে, মাঝ আকাশে কপ্টার থেকে পড়ে যাওয়ার পরেও শাহরুখ বেঁচেছিলেন হয়তো ৩০ বছর পর পুত্রের ‘মসিহা’ হবেন বলেই। জেলবন্দি মহিলাদের নিয়ে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে আজাদের (শাহরুখ) লড়াইও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য ঠেকেছে।

৪. দ্বিতীয়ার্ধে নয়নতারা কই?

‘জওয়ান’-এর অন্যতম উল্লেখ্য দক্ষিণী নয়নতারার বলিউড-উত্থান। দক্ষিণের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির অভিনেত্রীর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। জওয়ান নয়নতারাকে দক্ষিণের গণ্ডি পার করে পৌঁছে দিল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী। ছবির প্রথমার্ধে নয়নতারার বলিষ্ঠ অভিনয়, ঝকঝকে উপস্থিতি আলাদা করে নজর কেড়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে সেই নয়নতারাই যেন নিভে গেলেন। পিতা-পুত্রের প্রতিশোধের খেলায় আচমকা ছোটখাটো পার্শ্বচরিত্র হয়ে গেলেন। ওই চরিত্রে দীপিকা পাডুকোন থাকলে এমন নিষ্প্রভ থাকতেন?

৫. স্মৃতি-বিস্মৃতির শাহরুখ

কপ্টার থেকে পড়ে পাহাড়ি গ্রামে আশ্রয় পান শাহরুখ। সেবাশুশ্রূষা করে তাঁকে বাঁচিয়ে তোলা হয়। তিনিই গ্রামের রক্ষাকর্তা হয়ে বসেন। কিন্তু তাঁর পূর্বের কোনও স্মৃতি থাকে না। কে তাঁর ছেলে না জেনেই তিনি পুত্রকে বাঁচাতে ছোটেন! ‘ভুলে যাওয়া’ কয়েক জন বন্ধুর কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। আবার খলনায়কের সঙ্গে শেষ মারপিটের দৃশ্যে আচমকা তাঁর সব কথা মনে পড়ে যায়! চিত্রনাট্যে শাহরুখের এই স্মৃতিভ্রম অনাবশ্যক, অপ্রয়োজনীয়।

‘জওয়ান’ ছবির একটি অ্যাকশন দৃশ্যে শাহরুখ। — ফাইল চিত্র।

৬. ক্লাইম্যাক্সে তাড়াহুড়ো!

শুরু থেকে যে ভাবে গল্প বুনেছিলেন অ্যাটলি, তাতে প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিল। শেষে কিন্তু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছেন। আলাদা আলাদা অবিচারের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ধাপে ধাপে সরকারের মুখোশ খুলে দেওয়ার গল্প শেষ দিকে আর ধোপে টেকেনি। ছয় নারীর প্রতিশোধ দুইয়ে এসে থেমেছে! সময়ের মধ্যে সব ক’টা সূত্র গাঁথতেও পারেননি পরিচালক। আগামী কোনও সিক্যুয়েলের জন্য কি কিছু হিসেব তুলে রেখে দিলেন?

৭. পুরনো ছাঁচ

চেনা গল্পের ছাঁচে নতুন করে অ্যাকশনের রং। গল্পে খুব নতুন কিছু কিন্তু নেই। বাবার উপর অবিচারের প্রতিশোধ কয়েক দশক পরে ছেলে নিচ্ছে— বলিউড এমন ছবি বহু বার দেখিয়েছে। সার্বিক পরিকল্পনায় ‘পাঠান’-এর ছাপও কিছুটা রয়ে গিয়েছে। ‘পাঠান’ও দেশের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিল। ‘জওয়ান’ও তা-ই। অ্যাটলির ধরন পুরনো ছাঁচে নতুনত্বের প্রলেপ মাত্র।

৮. অ্যাকশনের নেপথ্যসজ্জা

নায়ক-খলনায়কের মারপিট দেখতেই হল ভরেছে। সেই অ্যাকশনেও খামতি থাকলে ছবিতে খুঁত থাকে। শেষ দিকে অ্যাকশন দৃশ্যের নেপথ্যসজ্জা হতাশ করেছে। শাহরুখের ধাক্কায় বিজয় সেতুপতি যখন ছিটকে পড়ছেন, তার প্রতিঘাতে দেওয়ালও খসে পড়ছে! থার্মোকলের ব্যবহারও চোখে পড়ে।

৯. চিতার গর্জন

‘জওয়ান’-এর ট্রেলারে এক চিতার উপস্থিতি আলাদা নজর কেড়েছিল। মনে হয়েছিল, হিংস্র জন্তুকে পোষ মানানো কোনও দুর্ধর্ষ খলনায়ক থাকবেন ছবিতে। কিন্তু ছবিতে তেমন দুর্ধর্ষ কাউকে তো দেখা গেল না! কয়েক মিনিটের দৃশ্যে কেন চিতাটাকে রাখা হল, তার মালিককে সিক্যুয়েলের জন্য তুলে রাখা হল কি না, বোঝা গেল না। চিতার দৃশ্যটাও অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে।

তবে এই সব খুঁত ঢেকে দিয়েছে বিজয়, নয়নতারার অনেক দিন মনে রেখে দেওয়ার মতো অভিনয়। দীপিকা স্বল্প সময়ে বরাবরের মতো ঝকঝকে। আলাদা করে উল্লেখ্য সান্যা মালহোত্র, প্রিয়মণি, সুনীল গ্রোভারদের কথা। দেশের রাজনীতি, সমাজ নিয়ে বার্তাও মন্দ নয়। সর্বোপরি, বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণে অ্যাটলি ১০০ শতাংশ সফল। প্রথম দিনের পারফরম্যান্স তেমনই বলছে। আনন্দবাজার অনলাইন শুধু ঝড়ের উল্টো দিকে হেঁটে দেখল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement