ছবি: সংগৃহীত।
পরমারাধ্য মহাশয়,
বহুকাল হইল আপনার সঙ্গে আমার পত্রের আদানপ্রদান এক প্রকার স্তব্ধ হইয়াছে। ইহকালের চেয়ে পরকালে আসিয়া সবিশেষ শান্তি পাইলাম। এই অধম-অভাগিনী-অসহায়-জনমদুঃখিনীকে লইয়া কলিকাতায় এখন মস্ত চৰ্চা... যেন পুনর্জন্ম লাভ করিয়াছি। বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ‘স্টার’ থিয়েটারের নাম বদলাইয়া ‘বিনোদিনী’ থিয়েটার রাখিলেন সম্প্রতি... এক বঙ্গনায়িকা আভূমি সমাদরে আমার চরিত্রভূমিকায় অভিনয় করিলেন... আমার কথা স্মরণ করিয়া অশ্রুবিসর্জন করিলেন বারম্বার... জনৈকা থিয়েটার অভিনেত্রী আমার চরিত্রাভিনয় করিয়া প্রায় পঞ্চাশ নাইট শো করিলেন এবং দর্শকের প্রবল করতালি ও প্রশংসা কুড়াইলেন। অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী স্টারে যেন পুনরায় নাটকের অভিনয় আরম্ভ হয় তাহার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন। এ সকল সংবাদপ্রাপ্তিতে মন বড় প্রশান্ত হইয়াছে মাস্টারমশাই। চিরঅভাগিনীর দুঃখ তবে ঘুচিল! আপনারা যাহা পারিলেন না, উত্তরকালের প্রজন্ম তাহা করিয়া দেখাইল। এই দাসীর জীবনে ইহা হইতে আর কী সুখকর হইতে পারে?
২২ শে জানুয়ারি, ২০২৫ সন। আমার অপার্থিব মন প্রবেশ করিল আমারই নামাঙ্কিত থিয়েটারে। “বিনোদিনী থিয়েটার”। আহা! এই পোড়া মন আর হৃদয় কত স্বপ্ন দেখিয়াছে এত কাল ধরিয়া! নারী কাহারও বিলাস সঙ্গিনী ব্যতীত অন্য রূপ ও অন্য পরিচয় ধারণ করিতে পারে, কিংবা আত্মপরিচয়ে উদ্ভাসিত হইতে পারে, তাহা পরিচালক রামবাবু আর প্রযোজক দেববাবু কাজে করিয়া দেখাইলেন। গণিকাবৃত্তি হইতে প্রতি মুহূর্তে মুখ ফিরাইয়া লওয়া কি আমার একান্ত অপরাধ ছিল মাস্টারমশাই? যে পুরুষলাঞ্ছিত সমাজ আমাকে খ্যাতির উচ্চশিখরে আসীন দেখিয়াও আমার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করিবার অভিপ্রায়ে সদা ব্যস্ত ছিল, যাহার উপযুক্ত জবাব আমি কোনও দিন জীবন দিয়া দিতে পারি নাই, তাহা সেলুলয়েডের পর্দায় দেখিব, এমনটা আশা করিয়া প্রবেশ করিলাম থিয়েটারের অন্দরমহলে। কী আশ্চর্য মাস্টারমশাই! হরি সংকীর্তনের মৃদঙ্গধ্বনিতে আলোড়িত স্টার থিয়েটার যেন এক টুকরো শ্রীক্ষেত্র হইয়া উঠিয়াছে। খোল, করতাল, খঞ্জনিধ্বনি আমার অপার্থিব শরীরকে রোমাঞ্চিত করিতেছিল বারম্বার।
ছবিতে বিনোদিনীরূপী রুক্মিণীর সঙ্গে কুমার বাহাদুররূপী ওম সাহানি। ছবি: সংগৃহীত।
সেই শব্দ আর উচ্ছ্বাস ভেদ করিয়া থিয়েটার হলে প্রবেশ করিলেন যেন স্বপ্নের এক রাজপুত্র আর রাজকন্যে। তাহাদের ঘিরিয়া দর্শকের সে কী উচ্ছ্বাস! আমার মনে পড়িতেছিল অতীত দিনের কথা। ঠিক এমনটাই হইত গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার, বেঙ্গল থিয়েটার এবং স্টার থিয়েটারের প্রবেশদ্বারে আমি যখন গিয়া দাঁড়াইতাম। এ হেন উচ্ছ্বাস যাহাদের ঘিরিয়া চলিতে থাকে, তাহাদের শ্রমের মূল্য একমাত্র দর্শকের করতালিতেই নির্ধারিত হয়, এ কথা আপনার কাছেই শিখিয়াছিলাম মাস্টারমশাই। তাই আজও ভাবি ‘থিয়েটারে দর্শক ছাড়া কেহই অপরিহার্য নহেন’... আমার দিনাতিপাত শ্রম ও অব্যক্ত বেদনা ফুটিয়া উঠিবে পর্দায়! এ কি কম প্রাপ্তি মাস্টারমশাই?
অনতিকাল পরেই প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার হইল। পর্দায় ফুটিয়া উঠিল আমার বাল্যকালের রূপ। আমার আশৈশব ভালবাসা। আমার মা, দিদিমা গঙ্গাবাঈ তথা আমার গোলাপ, শৈশব হইতে ক্রমশ যৌবনোত্তীর্ণ হইয়া আমার অভিনীত একের পর এক মঞ্চদৃশ্য। কী নিপুণ দক্ষতায় সে সব ফুটাইলেন আমার সেই রাজকন্যে! আমার কালে জন্মগ্রহণ করিলে হয়তো তাঁহার নাম হইত রুক্মিণীদাসী! বালাই ষাট, এ পোড়া দেশে ভাগ্যিস উহার আমার কালে জন্ম হয় নাই!
থাক এ সকল কথা, যাহা বলিতেছিলাম...
পর্দায় একে একে ফুটিয়া উঠিতে লাগিল আমার অভিনয়শিক্ষা তথা জীবনীশিক্ষার নানা রঙের দিনগুলি। অমৃতলালবাবু আর আপনার পরম যত্নে, প্রশ্রয়ে আমার দিনগুলি এক প্রকার কাটিতেছিল। তাহার মাঝে গঙ্গায় প্রবহমান জলরাশি জীবনতরীতে বহু বার মাথা ঠুকিয়া গিয়াছে। কালের দাবিতে ও দর্শকের অবিরল ভালবাসার ধারায় আমি হইয়া উঠিয়াছি বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের ‘স্টার’...আমার নামে অজস্র মুনাফা-সহ টিকিট বিক্রয় হয়। ‘সীতার বিবাহ’ হইতে শুরু করিয়া ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘সরোজিনী’, ‘নীলদর্পণ’— একের পর এক নাট্যদৃশ্যে অভিনীত আমার চরিত্রগুলিকে প্রাণবন্ত করিয়া তুলিয়াছেন ছবির নায়িকা। বাল্যকালের চরিত্রাভিনেত্রী বালিকাটিও মন্দ নহে। শৈশবের পুঁটি আর যৌবনের বিনোদিনীকে কিছু কিছু দৃশ্যপটে সম্পৃক্ত করিয়া রামবাবু এবং এডিটর প্রণয়বাবু সবিশেষ দাগ কাটিলেন মনে। ছবির মধ্যান্তরের পূর্ববর্তী দৃশ্যায়নে এলিজাবেথ ক্লার্কের সহিত আমার সাক্ষাৎকার, একক ছবি তোলা, নাট্যাচার্য-অমৃতলালবাবু-দাশুবাবুর প্রতিক্রিয়াকে একই ফ্রেমে গ্রথিত করার দৃশ্যটিতে দর্শকবৃন্দ করতালি দিয়া উঠেন।
আমার সাজসজ্জার খ্যাতি সে কালের বহু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইত। এ বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত গিল্টি গহনার ব্যবহার এবং আমার গর্বের কোঁকড়ানো কেশসজ্জা, এই ছবিতে আরও একটু বিন্যাসের দাবি রাখে। আমার এই রূপের জাদুতেই মগ্ন হইয়াছিলেন কুমার বাহাদুর। ওমবাবুর অনিন্দ্যসুন্দর কান্তি আর বলিষ্ঠ অভিনয় আমার হারানো প্রেম আর ব্যথার প্রেমের দিনগুলি স্মরণ করাইয়া দিল। কুমার বাহাদুরের বিবাহ সংবাদে বিধ্বস্ত এই দাসীর কাঁধে হাত রাখিলেন রাঙাবাবু। সমাজপতিতা, ঘৃণিতা বারনারীর জীবনে সর্বশক্তিমান, অচিন্ত্য পুরুষরূপে আমাকে চিরকাল সান্ত্বনাবারি দান করিয়া গিয়াছেন রাঙাবাবু। রাহুলবাবুর মার্জিত ভরসাবাক্যোচ্চারণে আমার সেই রাঙাবাবুকেই খুঁজিয়া পাইলাম। আমার হস্ত হইতে তাহার দেওয়া সোনার বালা খুলিয়া আমার নারীজীবনকে অপারমুক্তি দান আর কাঁধে হাত রাখিয়া বলা সেই গভীর কথাগুলি, “তুমি স্বপ্ন দেখো, তুমি স্বপ্ন না দেখলে আর কেউ স্বপ্ন দেখার সাহসই পাবে না”... শুধু আমার নয়, প্রেক্ষাগৃহের দর্শকচক্ষুও ভিজাইয়া দিয়াছে। মাস্টারমশাই জানেন আমার ‘বাসনা’ নামক কবিতাপুস্তিকার ‘পিপাসা’ শীর্ষক কবিতায় নিজের কথাকেই ব্যক্ত করিয়াছিলাম এই ভাবে...“তৃষিত চাতকী প্রাণ কাতর রহিল/ জীবন শুকাল তবু বারি না মিলিল।”
চৈতন্যলীলায় বিনোদিনী, অভিনয়ে রুক্মিণী মৈত্র। ছবি: সংগৃহীত
যদি ভুল না করি মাস্টারমশাই, জীবনে অন্তত এক বার আমাকে শান্তিবারিধারায় স্নাত করাইয়াছেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব! আমার অভিনীত ‘চৈতন্যলীলা’ ঠাকুর দেখিতে আসিয়াছিলেন, আমাকে পরম স্নেহভরে পাপমুক্ত করিয়া চলিয়া গেলেন। ছবিতে ঠাকুরের আবির্ভাব আর ‘চৈতন্যলীলা’র দৃশ্যনির্মাণ এত মনোজ্ঞ হইয়াছে যে দর্শককুল ভক্তিরসে নিমজ্জিত হইয়া আবেগাপ্লুত হইয়া পড়েন। আমি মনে মনে ভাবি ধন্য এ নটীর উপাখ্যান। এর পর এই অধম দাসীকে গ্রহণ করিলেন রাঙাবাবু, আপনার মুখের উপর জবাব দিয়া গেলেন “ও আমাকে গ্রহণ করেছে।” এ হেন সংলাপ রচনায় প্রিয়াঙ্কা নাম্নী কন্যাটি আমার মন ছুঁইয়াছে। রাঙাবাবুর মৃত্যু, একমাত্র কন্যা শকুন্তলার বিয়োগব্যথায় জর্জরিত বিনোদিনীর বার্ধক্য, শ্বেতীর ছাপগ্রস্ত মুখ অঙ্কনে বীথিকা যথাযথ কার্যসমাপ্ত করিয়াছে। নিজের বাল্যভিটা হইতে তারাসুন্দরীকে উদ্ধার করিয়া অকূল জীবনসমুদ্রে পাড়ি দেওয়া ও নেপথ্যে “ভাইস্যা যাইব গাঙের পাড়ে” গানটি মন উদাস করিয়া দেয়।
আপনার নিকট আমি চিরঋণী মাস্টারমশাই। এই অভাগিনী, পীড়িতাকে আপনি আশ্রয় দিয়াছেন, যশ-খ্যাতি দিয়াছেন কিন্তু বারবণিতার গ্লানির পরিচয় হইতে মুক্ত করিতে পারেন নাই। কখনওই সেই চেষ্টাও করেন নাই। গুর্ম্মুখবাবুর শর্তসাপেক্ষে আমার হইয়া লড়াই করা, আমার নামে থিয়েটার গড়িয়া তোলার উদ্যোগ আমাকে অন্তত এক বার নামের প্রলোভন দেখাইয়াছিল। আপনার চরিত্রে কৌশিকবাবুর এবং গুর্ম্মুখবাবুর চরিত্রে মীরবাবুর চাইতে দীনেন গুপ্তের ছবিতে দিলীপবাবু আর মেঘনাদবাবুর অভিনয় খানিক বেশিই মন ছুঁইয়া যায়। রামবাবু তাহার ছবির কিয়দংশ আপনকার ন্যায় ব্যক্ত করিয়াছেন। এ বিষয়ে আমার জীবন চরিতের সাহায্য লইলে এ দাসী কৃতার্থ হইতাম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমার ভ্রাতার মৃত্যু দাতব্য চিকিৎসালয়ে হইয়াছিল, আপন বাটীতে নহে। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত আমার প্রথম পার্ট ছিল "বেণীসংহার" নাটকে, "সীতার বিবাহ" নহে... জ্যোতিবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে রবিবাবুর নতুন বৌঠান দূরবীন দিয়া আমার পোড়া মুখ দর্শন করিয়াছিলেন কি না তাহাও আমার অজানা!
গঙ্গাবাঈ তথা আমার গোলাপের প্রসঙ্গ না তুলিলে অন্যায় হইবে। চান্দ্রেয়ী দেবী তাহাকে একেবারে রক্তমাংসের করিয়া তুলিয়াছেন। ছবিতে তাহার বিশেষ সংলাপ -"মনটার মতো নিজের কাঁধদুটোকে শক্ত করতে হবে পুঁটি"... সেই আজন্মলালিত পুঁটি শক্ত কাঁধে বহিয়া চলে গঙ্গার দেহ... পশ্চাতে সারি সারি গণিকার গঙ্গার দেহস্পর্শ করিয়া কাঁধে তুলিয়া সৎকারকার্যে লইয়া যাওয়ার দৃশ্যটি নারীর আত্মজাগরণের ও বিনোদিনীর আত্মউন্মোচনের পরিচায়ক।
ধৃষ্টতা মার্জনা করিবেন মাস্টারমশাই, ছোট মুখে অনেক বড় বড় কথা বলিয়া ফেলিলাম! অধম, অভাগী দাসীকে ক্ষমা করিয়া দিবেন নিজগুণে। তবু আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকিব রামবাবু, রুক্মিণীদেবী, দেববাবুর নিকট। আমার অনালোকিত জীবনে আলো ফেলিলেন তাহারা। বাহিরে আসিল ঘোমটা খসানো নিজগুণে প্রজ্জ্বলিত এক নটী। রবিবাবুর চণ্ডালিকার ন্যায় “এ নতুন জন্ম, নতুন জন্ম, নতুন জন্ম আমার।”
ইতি
আপনার চিরপদাশ্রিত
বিনোদিনী দাসী