রাত আকেলি হ্যায়।
রাত অকেলি হ্যায়
পরিচালনা: হানি ত্রেহান
অভিনয়: নওয়াজ়, রাধিকা, শ্বেতা, শিবানী, স্বানন্দ
৬/১০
আগাথা ক্রিস্টির মার্ডার মিস্ট্রি মনে পড়ে যায় ছবিটি দেখতে দেখতে। ভিক্টিম এবং সাসপেক্ট সকলেই চোখের সামনে, অনুসন্ধানের সূত্রও সাজানো রয়েছে। কিন্তু গল্পের মোড় ঘুরতে না ঘুরতেই সন্দেহভাজন পাল্টাতে থাকে। ‘লকড রুম মিস্ট্রি’ কনসেপ্টেই পুরো ছবি সাজানো। যদিও খুনের তদন্তই ছবির উপজীব্য, কিন্তু সেই খুনকে ভরকেন্দ্রে রেখে তার চারপাশ দিয়ে পিতৃতন্ত্র, হিংসা, ঘৃণার সুন্দর জাল বুনেছেন পরিচালক। আর আছেন বাঘা-বাঘা সব অভিনেতা। তবে স্টার অব দ্য শো, নওয়াজ়ই।
ছবি শুরু হয় হাইওয়ের উপরে জোড়া খুন দিয়ে। একটি লরি এসে ধাক্কা মারে একটি গাড়িকে। দুমড়ে যাওয়া গাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে এক মহিলা, লরিচালক তার গলা কেটে খুন করে। গাড়ির চালককেও খুন করে ঘটনাস্থলে। তার পর তাদের একটি ট্যানারিতে নিয়ে গিয়ে পুঁতে দেওয়া হয়। এর পরে ছবি এগিয়ে যায় পাঁচ বছর। সেখানে আর একটা খুন। কানপুরের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি রঘুবীর সিংহ খুন হয় তারই দ্বিতীয় বিয়ের রাতে। রঘুবীর দ্বিতীয় বার বিয়ে করে তার রক্ষিতা রাধাকে (রাধিকা)। তদন্তের ভার পড়ে পুলিশ ইনস্পেক্টর জটিল যাদবের (নওয়াজ়উদ্দিন) উপরে। শুরু হয় খুনের তদন্ত। একটি হত্যাকাণ্ডের শিকড় খুঁজতে গিয়ে অন্য ঘটনার শিকড়ও এসে হাতে পড়ে জটিলের।
মিস্ট্রি মুভির চেনা গতে বাঁধা নয় এ ছবি। টানটান রহস্যের চেয়ে সম্পর্কের টানাপড়েনই ছবি এগিয়ে নিয়ে যায়। কাহিনির পরতে কখনও উঠে আসে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ক্রীড়নকসম মেয়েরা। কখনও আবার সেই সমাজের অন্য দিকেই রয়েছে মনের মতো পাত্রী পাওয়ার জন্য ফর্সা হওয়ার ক্রিম মাখা পুরুষ চরিত্র। জটিল শুধু এ ছবির মূল চরিত্রের নাম নয়, বরং গোটা প্লট। ততোধিক জটিল মনস্তত্ত্ব দর্শানো হয়েছে একটি খুনকে কেন্দ্র করে।
ছবিতে খুনির পিছনে ছোটার তাড়া নেই। বরং প্রত্যেকটা জট সময় নিয়ে ছাড়ানো হয়েছে। মুহূর্ত তৈরি হয়েছে ছোট ছোট। সিনেম্যাটোগ্রাফিও কাবিল-এ-তারিফ। ছবির আগাগোড়া আলো-ছায়ার খেলা অসাধারণ। খুনের দৃশ্যও মনে রাখার মতো। একদম প্রথমেই রয়েছে লরির পিঠে করে জোড়া লাশ নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। বার্ডস আই ভিউ থেকে ক্যামেরায় ধরা পড়ছে লরির খোলা পিঠের অংশ। স্ট্রিট লাইটের আলোয় অন্ধকার লরির খোলের মধ্যে ফুটে উঠছে দুটো লাশ। পথের বাঁক ঘুরতেই যা আবার মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের নিকষ অন্ধকারে। উত্তরপ্রদেশের হাইওয়ে, গলিঘুঁজি, সড়কপথও সুন্দর ব্যবহার করা হয়েছে ছবিতে।
তবে ত্রুটিও আছে। ওটিটির জ়ঁরই যখন আঁধারে ঢাকা, তখন সেই অন্ধকারের খেলায় দড় হতেও জানতে হবে। ছবির চরিত্রায়ণ, গল্প, মোচড় সবই আছে, তবুও যেন একটা গা-ছাড়া ভাব। আড়াই ঘণ্টার এই ছবি দেখতে বসে তাই মাঝেমাঝে ধৈর্যচ্যুতিও ঘটে। পুলিশ ইনস্পেক্টর হলেও, যখন ইচ্ছে এক নামজাদা ব্যক্তির বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে যাওয়া কি অতই সহজ? ক্লাইম্যাক্সের রহস্য উন্মোচন বেশ ইন্টারেস্টিং। কিন্তু যে ঘটনায় জড়িত নেতা সেখানে উপস্থিত, তার সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে আঙুল তোলাও কি আসলে সম্ভব? বলিউডি ছবিতে ক্ষমতাবান নেতাদের সামনে পুলিশের সাসপেনশন অর্ডার আর ট্রান্সফার দেখা দর্শকের তখন নিজেকে নেহাতই বোকা মনে হয়। বা কাহিনিকারকে...
তবে এ ছবির প্রাপ্তি হল অঁসম্বল কাস্ট। নওয়াজ়উদ্দিন সিদ্দিকি এ ছবিতে অসাধারণ। বলিউডের সিক্স প্যাক অ্যাবওয়ালা তথাকথিত পুলিশ চরিত্রকে এক লহমায় ভেঙে দিয়ে গড়ে নিয়েছেন আমআদমির পুলিশ। এর আগেও অবশ্য ‘কহানি’র খানের সঙ্গে পরিচয় করান নওয়াজ়ই। অক্ষয়কুমার, অজয় দেবগণ, সলমন খানের মতো স্ক্রিনজোড়া প্রেজ়েন্স না থাকলেও আছে মগজাস্ত্র। যার সঙ্গে বাঙালিরা পূর্বপরিচিত। তাই এ ছবিও নওয়াজ়কে জিতিয়ে দিয়েছে ওই মগজাস্ত্রের জোরেই। রাধিকা আপ্টেও চোখ সরাতে দেননি তাঁর উপর থেকে। কখনও ধারালো সংলাপ, কখনও আবার কোনও দৃশ্যে তাঁর জোরালো ‘না’ দাগ কেটে যায়। সাবলীল অভিনয়ে নজর কেড়েছেন শ্বেতা ত্রিপাঠী, ইলা অরুণ, শিবানী রঘুবংশী, রিয়া শুক্ল, স্বানন্দ কিরকিরেও।
কথায় আছে সব ভাল তার, শেষ ভাল যার। পরিচালকও ছবির ক্লাইম্যাক্সে ছক্কা হেঁকেছেন। তবে পুলিশের আক্ষরিক ‘মাচো’ ইমেজ তৈরির জন্য অতিরিক্ত মার্কস প্রাপ্য নওয়াজ়ের। ছবিটি দেখার সময়ে বারবার মনে পড়ে ‘সরফরোশ’-এ পুলিশ কাস্টডিতে পড়ে পড়ে মার খাওয়া কৃশকায় মানুষটাকে। এ ছবির বুকে তিনি পুলিশের চরিত্রে রীতিমতো রাজত্ব করেছেন।