জুহি পরমারের তুরুপের তাস অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’ হয়ে ওঠা। ব্যক্তিত্ব ও অভিনয়ের সেই দিকটিকে কাজে লাগিয়েই দীর্ঘ কয়েক দশক ছোট পর্দার বিনোদন দুনিয়া শাসন করেছেন তিনি। ‘মিস রাজস্থান’ থেকে হয়ে উঠেছেন ধারাবাহিকের জনপ্রিয় পুত্রবধূ।
মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে জুহির জন্ম ১৯৮০ সালের ১৪ ডিসেম্বর। আদতে তাঁর পরিবার ছিল গুজরাতি। তবে থাকতেন রাজস্থানের জয়পুরে। সেই শহরে বেড়ে ওঠা জুহির। ২০০৩ সালে তিনি ‘মিস রাজস্থান’-এর শিরোপা পান।
তার আগেই অবশ্য শুরু হয়ে গিয়েছিল জুহির অভিনেত্রীজীবন। ১৯৯৮ সালে ‘ওহ্’ সিরিয়ালে তাঁর প্রথম অভিনয়। এর পর ‘চুড়িয়াঁ’, ‘ইয়ে জীবন হ্যায়’, ‘রিশতে’-সহ বেশ কিছু ধারাবাহিকে অভিনয় করেন তিনি।
তবে প্রধান নায়িকা হিসেবে পরিচিতি পান ‘কুমকুম-এক প্যায়ারা সা বন্ধন’ ধারাবাহিকে। ২০০২ থেকে ২০০৯ অবধি দুপুরের স্লটে সম্প্রচারিত এই ধারাবাহিক ছিল তুমুল জনপ্রিয়। সে সময় ছোট পর্দার বিনোদনের সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল শাশুড়ি-পুত্রবধূর সম্পর্কের টানাপড়েন।
একতা কপূরের ‘কে সিরিজ’ সিরিয়ালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘কুমকুম’। প্রধান চরিত্র কুমকুমের ভূমিকায় ছিলেন জুহি। তিনি এবং তাঁর সংসার ঘিরেই আবর্তিত হত গল্প।
দীর্ঘ কেরিয়ারে ‘বীরাসত’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘কুসুম’, ‘দেবী’, ‘সন্তোষী মা’ এবং ‘তন্ত্র’-র মতো জনপ্রিয়তার প্রথম সারিতে থাকা ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন তিনি। পাশাপাশি, সুযোগ পেয়েছেন সিনেমাতেও। ‘পহেচান’, ‘এক থা টাইগার’-সহ কিছু ছবিরও অংশ ছিলেন জুহি।
কিছু দিন প্রেমপর্বের পরে কেরিয়ারের শীর্ষে থাকতেই গুজরাতি ব্যবসায়ী এবং টেলিভিশন অভিনেতা সচিন শ্রফকে বিয়ে করেন জুহি। জয়পুরে রাজকীয় অনুষ্ঠানে সাতপাকে বাঁধা পড়েছিলেন তাঁরা। অভিনয়ের পাশাপাশি সচিন সঞ্চালনাও করেন।
বিয়ের বেশ কিছু পর জুহি মেগা সিরিয়াল থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। ‘বিগ বস’-সহ কিছু রিয়্যালিটি শো-এ প্রতিযোগী এবং সঞ্চালকের ভূমিকায় দেখা গেলেও ধারাবাহিকের নায়িকা তিনি হননি।
২০১৩ সালে জন্ম হয় সচিন এবং জুহির একমাত্র মেয়ে সামাইরার। মেয়ের যখন ৩ বছর বয়স, আবার ধারাবাহিকের কাজে ফিরে আসেন জুহি। সিদ্ধার্থ কুমার তিওয়ারির পৌরাণিক ধারাবাহিক ‘কর্মফলদাতা শনি’-তে দেখা যায় তাঁকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সে খবর জানান জুহি নিজেই। ইনস্টাগ্রামে তাঁর পোস্ট করা ছবি দেখে অনুরাগীরা মেলাতে পারেননি। আগের থেকে অনেক বদলে গিয়েছিল তাঁর চেহারা। ১৭ কেজি ওজন ঝরিয়ে ধারাবাহিকে কামব্যাক করেন ছিপছিপে জুহি।
জুহি জানান, অভিনয়ের অফার তাঁর কাছে ছিল। কিন্তু মেয়ের কিছুটা বড় হওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করছিলেন। সন্তানের সামনে কর্মরতা মা হিসেবেই নিজেকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি।
কামব্যাকের মাঝেই ছন্দপতন। ২০১৭ সালে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন জুহি এবং তাঁর স্বামী। তার আগে বিয়ের ২ বছর পর থেকেই তাঁদের সাংসারিক অশান্তির খবর শোনা গিয়েছিল। কিন্তু পরে সেই গুঞ্জন উধাও হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আর গুঞ্জন থাকেনি। সত্যিই বিচ্ছেদ হয়ে যায় এই তারকা জুটির। ডিভোর্সের অনেক আগে থেকে আলাদা থাকছিলেন তাঁরা।
বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে জুহি পরে জানান, সচিনের সঙ্গে প্রেমহীন দাম্পত্য বয়ে নিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। বিয়ের ব্যর্থতার জন্য তাঁকেই দায়ী করেছিলেন সচিন। সেই অভিযোগও মানতে পারেননি জুহি।
বিচ্ছেদের পরে মেয়ে সামাইরার দায়িত্ব পেয়েছেন জুহিই। তবে মেয়ের কথা ভেবে প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন তিনি। সামাইরা যাতে তার বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখেন সচিনও।
আপাতত অভিনয়র ব্যস্ত সূচির ফাঁকে জুহির জীবন জুড়ে রয়েছে তাঁর মেয়ে। সিঙ্গল পেরেন্টের দায়িত্ব কঠিন হলেও তা উপভোগ করছেন বলে জানিয়েছেন জুহি। মেয়ের জন্য আরও বেশি করে কাজ করে যেতে চান তিনি। মেয়ের কথা ভেবে জয়পুরের পাট চুকিয়ে মুম্বইয়ে এসে থাকছেন তাঁর বাবা, মা।
অতীতের অনস্ক্রিন পুত্রবধূ জুহিকে এখন দেখা যাচ্ছে শাশুড়ির ভূমিকায়। সাম্প্রতিক ধারাবাহিক ‘হমারি ওয়ালি গুড নিউজ়’-এ শাশুড়ি রেণুকার চরিত্রে তিনি অভিনয় করছেন। তবে টাইপকাস্ট হওয়ার ভয় তিনি পান না।
জুহির কথায়, ‘কুমকুম’ ধারাবাহিকে তিনি শাশুড়ির চরিত্রে ছিলেন। আবার অষ্টাদশীর চরিত্রও করেছেন। শিল্পী হিসেবে নিজের অভিনয় ক্ষমতার উপর তাঁর আস্থা আছে।
ভরসা আছে টেলিভিশনের দর্শকের উপরেও। জুহি মনে করেন, ওটিটি-র দাপটেও ছোট পর্দা তার একনিষ্ঠ দর্শককে হারাবে না। টেলিভিশন তার নিজের জায়গা ধরে রাখবে।
কাজের বাইরে সম্পূর্ণ অন্য কারণে জুহি খবরের শিরোনামে এসেছিলেন গত বছর। অভিযোগ, ভুল চিকিৎসার জেরে প্রায় মৃত্যুমুখে পড়েছিলেন তিনি। জুহি জানান, হোলি উৎসব পালন করতে বান্ধবী আশকা গোরাডিয়ার বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখানে আচমকাই তাঁর নাক বন্ধ হয়ে যায়। নিঃশ্বাসের সমস্যা শুরু হয়। তার পরই আশকা ও তাঁর স্বামী জুহির চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
বান্ধবী আশকার বাড়ির কাছেই এক হাসপাতালে জুহিকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ, সেখানে ভুল ওষুধ দেওয়ার ফলে সমস্যা আরও বেড়ে যায়। সমস্যা বুঝতে পেরেই নিজেদের দায়িত্বে জুহিকে ওই হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে আসেন তাঁর বান্ধবী আশকা।
দ্রুত অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তি করার পরে সঠিক চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন জুহি। কিন্তু তাঁর অভিযোগ, মারাত্মক কিছু ঘটনা ঘটে যেতে পারত যে কোনও মুহূর্তে। প্রথম হাসপাতালের বিরুদ্ধে ভুল চিকিত্সার কোনও লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন কি না, তা অবশ্য প্রকাশ্যে বলতে চাননি জুহি বা তাঁর বান্ধবী।
বিনোদন জগতে দীর্ঘ কেরিয়ার সত্ত্বেও জুহিকে ঘিরে কোনও গুজব নেই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, আপাতত তাঁর বিয়ের কোনও পরিকল্পনা নেই। কারণ বিবাহবিচ্ছেদ তাঁকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। এখন মেয়েকে ঘিরে তাঁর জীবন আবর্তিত হলেও সারা জীবন যে তিনি একা থাকবেন না, সে কথাও জানিয়েছেন রোমান্টিক জুহি পরমার।