এক জনের ভাল লাগত ক্যামেরার সামনে থাকতে। অন্য জনের পছন্দ ছিল লেখালেখি। তবে দু’জনের ভালবাসা মিলে গিয়েছিল একটি বিন্দুতে। সেটা হল, ভাল নাটক আর সিনেমা দেখা। সেখান থেকেই গভীর হয় নিজেদের সম্পর্ক। ছবি নিয়ে আড্ডা দিতে দিতেই বন্ধুত্ব কখন প্রেমে বদলে গিয়েছে, টের পাননি ইরফান বা সুতপা, দু’জনের কেউ।
আশির দশকের শেষে সহপাঠী হিসেবে তাঁদের আলাপ দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-য়। প্রথম থেকেই ইরফান খান চেয়েছিলেন অভিনেতা হতে। সুতপার ঝোঁক ছিল পরিচালনা এবং সংলাপ লেখায়। পরবর্তী কালে বলিউডে পরিচিত পাওয়ার লড়াইয়ে দু’জনে দু’জনের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। ইদানীং ইরফানের সাক্ষাৎকারে বার বার উঠে আসত সুতপার কথা। বলেছিলেন, জীবন যদি সুযোগ দেয় তবে বাঁচবেন স্ত্রী সুতপার জন্যই।
পঁচিশ বছরের দাম্পত্যের অনেক আগে থেকেই ইরফান আর সুতপা সহযোদ্ধা। ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-র দিন যখন শেষ হল, তত দিনে তাঁরা বুঝে গিয়েছেন এ বার বাকি জীবনটাও থাকতে হবে একসঙ্গেই। থাকতে শুরুও করে দিলেন। দু’জনেই তখন ইন্ডাস্ট্রিতে পরিচিতি পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
একসঙ্গে থাকতে থাকতেই সুতপার মধ্যে নতুন অতিথির আগমন। এ বার তাঁরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। সুতপার জন্য ধর্মান্তরিত হতেও আপত্তি ছিল না ইরফানের। কিন্তু তার প্রয়োজন হয়নি। দুই বাড়ি থেকেই মেনে নিয়েছিল তাঁদের সম্পর্ক। ১৯৯৫ সালে রেজিস্ট্রি বিয়ে করেন তাঁরা।
অভিনেতা ছাড়া নিজের অন্য পরিচয় নিয়ে কোনওদিন মাথাব্যথা ছিল না ইরফানের। পরবর্তী সময়ে ‘খান’ বাদ দিয়ে পরিচয় দিতেন শুধু ‘ইরফান’ বলে।
শুধু স্ত্রী নন, সুতপা ছিলেন ইরফানের প্রিয়তম বন্ধু-ও। প্রথম বার হৃদয় ভেঙে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বন্ধু সুতপার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন। সেই হৃদয়ভঙ্গ ঘটেছিল ইরফানের কৈশোরে।
ষোলো বছর বয়সে ইরফান প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর বাড়ির দুধওয়ালার মেয়ের। রোজ দুধ আনার দায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন শুধুমাত্র ওই কিশোরীকে এক বার চোখের দেখা দেখবেন বলে। তাঁর দিকে কিশোরীর মুচকি হাসি দেখে ইরফানেরও বিশ্বাস হয়েছিল, তার ভাললাগা একতরফা নয়।
ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। কয়েকদিন পরে ইরফান জানতে পারেন তাঁর তুতো ভাই কিশোরীর প্রণয়ী হওয়ার দৌড়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। প্রথম প্রেম ভেঙে যাওয়ার দুঃখে কয়েক দিন নাকি শুধুই মুকেশের গান শুনে সময় কাটাতেন তিনি।
জীবনের প্রথম প্রেম ভেঙে যাওয়ার কথা স্বভাবসিদ্ধ রসিকতার ছলে পরে সাক্ষাৎকারেও জানিয়েছিলেন ইরফান। সেইসঙ্গে বলেছিলেন, কী ভাবে লড়াইয়ের প্রথম দিন থেকে তাঁর পাশে ছিলেন সুতপা। নিজে যে জায়গায় পৌঁছেছিলেন, তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব স্ত্রী সুতপাকেই দিতেন ইরফান।
কেরিয়ারের শুরু থেকেই অনেক কাজ একসঙ্গে করেছেন ইরফান আর সুতপা। ইরফানের ‘মাদারি’ এবং ‘করিব করিব সিঙ্গল’ ছবির প্রযোজকও ছিলেন সুতপা। পাশাপাশি তিনি অন্য ছবির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘শব্দ’ এবং নানা পটেকর, মনীষা কৈরালার সুপারহিট ছবি ‘খামোশি’-র সংলাপ সুতপারই লেখা।
দু’বছর আগে ইরফানের দেহে দুরারোগ্য অসুখের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। প্রথমে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন সুতপা। কিন্তু হার মানেননি। তাঁর চিরযোদ্ধা মানসিকতা দিয়েই হাল ধরে থেকেছেন। অসুস্থ ইরফান বলেছিলেন, সুতপার মতো শুশ্রূষাকারী বিরল।
মুম্বই বা লন্ডন, যেখানেই ইরফানের চিকিৎসা হয়েছে, পাশে থেকেছেন সুতপা। স্ত্রী তাঁর পাশে না থাকলে আরও অনেক আগেই তাঁকে যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করতে হত, মনে করতেন ইরফান। এমনকি, শেষ ছবি ‘আংরেজি মিডিয়াম’-এর কাজও তিনি সুতপার জন্যই করতে পেরেছেন, জানিয়েছিলেন অভিনেতা।
এই ছবির শুটিং শেষ হওয়ার পর বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন ইরফান। সুতপা তখন তাঁকে অন্য কাজ নিতে নিষেধ করে দেন।
করোনা-সঙ্কট সুতপার লড়াইকে আর কঠিন করে তোলে। তাঁদের বড় ছেলে বাবিল সে সময় লন্ডনে ছিলেন। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনেন সুতপা। জানান, বাবিলের স্বাস্থ্যপরীক্ষা হয়েছে এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ।
কয়েক দিন আগে জয়পুরে প্রয়াত হয়েছেন ইরফানের মা-ও। লকডাউনে মায়ের শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকতে পারেননি গুরুতর অসুস্থ ইরফান। এর পর তিনি নিজেও পাড়ি দিলেন দিকশূন্যপুরের দিকে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন ঘুরছে অনুরাগীদের জন্য ইরফানের শেষ বার্তা। ‘আংরেজি মিডিয়াম’-এর প্রচারে তিনি থাকতে পারেননি। পরিবর্তে ছিল তাঁর কণ্ঠ। তিনি বক্তব্য শুরু করেছেন এই বলে, ‘আজ আমি আপনাদের মধ্যে নেই। আবার আছি-ও।’
এই শব্দবন্ধ এখন বড় সত্যি সুতপার ক্ষেত্রে। ইরফান তাঁর কাছে নেই, আবার আছেন-ও। দেহে বাসা বাঁধা ‘অবাঞ্ছিত অতিথি’-দের কাছ থেকে সুতপা তাঁর সহযোদ্ধাকে ফিরিয়ে আনতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু অতীতে বহু লড়াইয়ে তাঁদের সহ-সংগ্রামের সুখস্মৃতি সুতপার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।