দেশ স্বাধীন হয়েছে কয়েক বছর। দেশের প্রাক্তন রাজধানী কলকাতার গায়ে তখনও ব্রিটিশ গন্ধ। প্রায়ই নাটক দেখাতে আসত ব্রিটিশ নাটকের দল ‘শেক্সপিয়ারানা’। একবার তাদের শো-এর সঙ্গে একই জায়গায় পড়ল ‘পৃথ্বী থিয়েটার’-এর শো।
একই দিনে পড়েছিল দুই দলের শো। শেষে তাঁরা কথা বলে ঠিক করলেন দুই দল দু’দিনে শো করবেন। এত সবকিছুর মাঝে দেখা হল দু’জনের। পৃথ্বীরাজ কপূরের ছেলে বলবীররাজ কপূরের সঙ্গে জেনিফার কেন্ডলের।
পৃথ্বী থিয়েটারের কর্ণধার পৃথ্বীরাজ কপূরের ছোট ছেলে বলবীর তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেজ ম্যানেজার। মঞ্চ সাজাতে গিয়েই পর্দার আড়াল থেকে চোখ পড়ল বিদেশিনীর দিকে। সেই তরুণী, জেনিফার তখন সাদাকালো পোলকা পোশাকে মহড়া দিচ্ছেন মঞ্চে।
নাট্যব্যক্তিত্ব জিওফ্রে কেন্ডল তাঁর নাটকের দলের গোড়াপত্তন করেছিলেন লন্ডনে। তবে বছরের বেশিরভাগ সময়ে তাঁরা ঘুরে ঘুরে শো করতেন ভারতে। সে রকমই এক শো-এর সময়ে ‘দ্য টেম্পেস্ট’-এর মিরান্ডারূপী জেনিফারকে দেখলেন বলবীর।
বলবীর তখন থিয়েটারের একনিষ্ঠ কর্মী। অভিনয়ের পাশাপাশি সামলাতে হয় দলের অন্য দায়িত্বও। ইতিমধ্যে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়ও হয়ে গিয়েছে ‘আগ’, ‘আওয়ারা’, ‘সংগ্রাম’-এর মতো ছবিতে।
বলবীর ছবিতে অভিনয় করতেন শশীরাজ নামে। কারণ, সে সময় বলবীর নামে আর একজন শিশুশিল্পীও অভিনয় করতেন পৌরাণিক ছবিতে।
এহেন দুই নামী থিয়েটার পরিবারের সন্তানের আলাপ হল কলকাতায়। ক্রমে আলাপ গাঢ় হল প্রেমে। বলবীর তো প্রথম থেকেই জেনিফারের প্রেমে হাবুডুবু। কিন্তু জেনিফার সাড়া দিতে সময় নিয়েছিলেন।
দুই পরিবারের কেউই জানতেন না প্রেমের বিন্দুবিসর্গ। জিওফ্রে কেন্ডল তো নিজের দলে অভিনয়ের জন্য ডেকেও নিলেন বলবীরকে। জেনিফার তখন দায়িত্ব নিলেন প্রেমিকের ইংরেজি উচ্চারণ নিখুঁত করার। উইলিয়ম শেক্সপিয়ার-সহ অন্য ইংরেজি সাহিত্যভাণ্ডারের বিশাল দরজা খুলে গেল বলবীরের সামনে।
দু’জনেই জানতেন বাড়ি থেকে এই সম্পর্ক মেনে নেবে না। কিন্তু জানাতে তো হবে! অনেক ভেবে বলবীর জেনিফারের কথা বললেন বৌদি গীতা বালিকে।
বিয়ের আগেই একদিন জেনিফারের সঙ্গে আলাপ করলেন গীতা। বৌদির কাছে দেওরের আব্দার, বাড়িতে ম্যানেজ করতেই হবে। কী করবেন বুঝতে না পেরে গীতা প্রথমে জানালেন স্বামী, শাম্মি কপূরকে।
তারপর জানল বাকি কপূর পরিবার। একে বিদেশিনী, তারপর আবার ছেলের থেকে বয়সে পাঁচ বছরের বড়! জেনিফারকে নিয়ে তীব্র আপত্তি দেখা দিল। শাম্মি এবং গীতা চেষ্টা করলেন বিরোধিতার হাওয়াকে প্রশমিত করতে।
আপত্তি কম হয়নি জেনিফারের পরিবারেও। খাঁটি ব্রিটিশ হয়ে কিনা বিয়ে একজন ভারতীয়কে! কোনওমতেই মেনে নিতে পারেননি জিওফ্রে কেন্ডল। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, বিয়ে তো পরের কথা। আগে দু’জনকেই ‘শেক্সপিয়ারানা’ দল ছাড়তে হবে।
মন প্রস্তুত করলেন জেনিফার। ছেড়ে দিলেন প্রিয় নাটকের দল। আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন প্রেমিককে নিয়ে নতুন করে থিয়েটারে অভিনয়ের। কিন্তু কিছুতেই সাফল্য এল না।
দু’জনে যখন জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত, কপূর পরিবারের দরজা খুলল জেনিফারের জন্য। দু’বছরের প্রেমপর্বের পরে বহু বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে বিয়ে হল দু’জনের। ১৯৫৮ সালের জুলাইয়ে। তখন বলবীর কুড়ি বছরের সদ্য তরুণ। জেনিফারের বয়স পঁচিশ।
দু’জনে মধুচন্দ্রিমায় এসেছিলেন কলকাতায়। যে শহরে তাঁদের আলাপ হয়েছিল। সদর স্ট্রিটের এক হোটেলে বিয়ের আগে দেখা করতে আসতেন তাঁরা। সেই হোটেলেরই ১৭ নম্বর ঘরে কাটালেন বিবাহিত জীবনের প্রথম কয়েক দিন।
এরপর ধীরে ধীরে বলবীর হয়ে উঠলেন ‘শশী কপূর’। ছবিতে ব্যবহৃত নাম ‘শশীরাজ’-কেই নিজের পরিচয় করেছিলেন তিনি। অভিনয় করেছেন বহু নায়িকার সঙ্গে। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত একান্ত পরিসরে জেনিফার ছাড়া আর কোনও নারীর পা পড়েনি।
তাঁদের সন্তানরাও অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সাধল চেহারায় ব্রিটিশ ছোঁয়া। তাঁদের বড় কুণাল একজন সফল বিজ্ঞাপন নির্মাতা | বিয়ে করেছেন প্রযোজক, পরিচালক রমেশ সিপ্পির মেয়েকে | মেয়ে, সঞ্জনা গাঁটছড়া বেঁধেছেন ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞ বাল্মীক থাপারের সঙ্গে | ছোট ছেলে করণ থাকেন লন্ডনে | তিনি একজন সফল মডেল |
দাম্পত্যের পঁচিশ বছরে বিনা মেঘে বজ্রপাত। জেনিফারের কোলন ক্যানসার ধরা পড়ল। মাত্র এক বছর সুযোগ দিয়েছিলেন চিকিৎসার। ১৯৮৪ সালে প্রয়াত হন তিনি। জীবনের শেষ কিছু মাস কাটিয়েছিলেন শৈশবের শহর লন্ডনে।
স্ত্রীর মৃত্যুর পরে শশী কপূরের ব্যক্তিগত জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। অভিনয় থেকে সম্পূর্ণ সরে যাননি। কিন্তু কোনওদিনই আগের অবস্থায় ফিরতে পারেননি।
দীর্ঘ রোগভোগের পরে শশী কপূরের মৃত্যু হয় ২০১৭-র ৪ ডিসেম্বর। জীবনের রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে পাড়ি দেন অপার্থিব জগতে। কলকাতার সেই হোটেলে এখনও আছে শশী-জেনিফারের ছবি। ১৭ নম্বর ঘর উৎসর্গ করা হয়েছে দুই কুশীলবের স্মৃতিতে।