সত্যজিৎ-কিউ
পরিচালক সত্যজিৎ রায় আর পরিচালক কিউ-এর দ্বন্দ্ব কারওর অজানা নয়। সম্ভবত ২০১৫-য় সন্দীপ রায়ের ‘ডাবল ফেলুদা’ নিয়ে সত্যজিৎ সম্বন্ধে প্রথম বিস্ফোরক মন্তব্য তাঁর। ‘অশালীন’ শব্দও উচ্চারণ করেছিলেন। বাঙালি ভোলেনি।
সেই কিউ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনীচিত্র ‘অভিযান’-এ সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকায়! পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘কিংবদন্তি পরিচালকের সঙ্গে কিউয়ের মতো বাহ্যিক সাদৃশ্য আর কারওর নেই। আমিই রূপটানের পরে দেখে চমকে গিয়েছিলাম।’’ কিউ কী বলছেন? যাঁকে নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য, পর্দায় তাঁকেই ফুটিয়ে তুলতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল?
২ মে, সত্যজিতের ১০১ তম জন্মবার্ষিকীর দিনে আনন্দবাজার অনলাইন প্রশ্ন রেখেছিল পরিচালক-অভিনেতার কাছে। কিউয়ের কথায়, ‘‘অবশ্যই মহড়া দিতে হয়েছিল। এক, ওঁকে সবাই চেনেন। দুই, ওঁর আচরণের সঙ্গেও সবাই পরিচিত। যা আমার থেকে একদম আলাদা। ফলে, ওঁর সব কিছু নিজের মধ্যে ধারণ করতে গিয়ে আমায় প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকতে হয়েছে। চরিত্রের মধ্যে থেকেও দিনযাপন করতে হয়েছে।’’
ইতিমধ্যেই জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে পর্দায় তিন ‘সত্যজিৎ রায়’ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ‘অভিযান’ ছবিতে কিউ। অতনু বসুর ‘অজানা উত্তম’-এ প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায়। অনীক দত্তের ‘অপরাজিত’-য় জিতু কমল। সাদৃশ্যে এবং অভিনয়ে কে বেশি পরিচালকের কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছেন? কিউ এ বারেও সোজাসাপ্টা। তাঁর যুক্তি, তিনি প্রিয়াংশুর অভিনয় দেখেননি। তবে তিনি নিজে পরিচালককে নিয়ে, চরিত্রটি নিয়ে আলাদা করে পড়াশোনা করেছেন। তাই অন্তরে তিনিই হয়তো সত্যজিতের কাছাকাছি পৌঁছোতে পেরেছেন।
সত্যজিৎ, উত্তকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আজও বাঙালির আবেগ। যা নিয়ে কিউয়ের প্রবল আপত্তি। সেই চরিত্রে অভিনয়ে কোনও দ্বিধা বা ভয় কাজ করেছিল? সঙ্গে সঙ্গে অভিনেতা বিস্ফোরক আবারও। দাবি, ‘‘আমার এক ফোঁটা আবেগ নেই। আমি আবেগ পছন্দও করি না। সবাই সেটা জানেন। তাই আমায় প্রচণ্ড গালাগালি খেতে হয় সারা ক্ষণ। বাঙালি আবেগ আঁকড়ে পিছনে পড়ে থাকতে ভালবাসে। সেটা আমার আসে না। তাই অভিনয়ের আগে এ ভাবে ভাবিনি। চেষ্টা করেছি সোজাসুজি ভাবে দেখার। এই চরিত্রের হাত ধরে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম তাকে গ্রহণ করে আমার সেরাটা দিতে। আমার কাছে এটি চরিত্র ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। আবেগসর্বস্ব হয়ে ভয় পেলে তো কাজটাই করতে পারব না।’’
তবে পর্দায় নিজেকে দেখার পরে ভাল-মন্দ দুটোই অনুভব করেছেন অভিনেতা। তিনি যতটা চেষ্টা করেছিলেন তার অনেকটাই ক্যামেরার চোখে এবং পর্দায় ফুটে উঠেছে। এই কারণে তিনি কিছুটা তৃপ্ত। একই সঙ্গে কিছু কিছু অ্যাঙ্গেল বা দৃশ্যে নিজের অভিনয় দেখে মনে হয়েছে, আরও একটু ঘষামাজা করলে বোধহয় ভাল হত। যেহেতু তিনি পেশাদার অভিনেতা নন তাই সেই খামতি তাঁর চোখে বড় হয়েই ধরা পড়েছে। কিউয়ের মতে, তাঁর কয়েকটি জায়গায় গাফিলতি আছে।
এই মুহূর্তে বাংলা বিনোদনের যা অবস্থা তাতে আরও একজন সত্যজিৎ রায়কেই কি দরকার টলিউডের? ১০১ বছর পরেও তিনিই এক এবং অদ্বিতীয়? উত্তর দিতে গিয়ে ছদ্ম ভয় ‘গাণ্ডু’ পরিচালকের গলায়, ‘‘আবার একজন সত্যজিৎ রায়! না না। সে কী? ১০০ বছর পরেও আবার তিনি, কেন?’’ এমন কথার প্রেক্ষিতে যুক্তিও দিয়েছেন, সত্যজিৎ যখন ছবি বানিয়েছেন তখন বাঙালি কিন্তু তাঁর ছবি দেখেনি। মৃত্যুর পরে দর্শকের দরবারে তাঁর কাজ স্বীকৃতি পেয়েছে। অর্থাৎ, তাঁর মতো পরিচালককেও ছবি তৈরি করতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। তাঁর সময়েও বাংলা ছবি তৈরি করা সহজ ছিল না। এখনও নয়। পাশাপাশি দাবি, ছবি তৈরি অনেকটাই ‘এনার্জি ফিল্ড’-এর মতো। নতুন ছবি না বানালে সেটি আসে না। তাই বাঙালি যত অতীত আঁকড়ে থাকবে ততই বিনোদন দুনিয়া পিছিয়ে পড়বে।
কিউয়ের মতে, ‘‘বাংলা ছবি তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা সত্যজিৎ রায়। তার থেকেও বড় সমস্যা তাঁকে ঘিরে আমাদের অনুভূতিগুলো। সত্যজিৎকে ঈশ্বরতুল্য বানিয়ে নিজেদের সমস্যা আমরা নিজেরাই ডেকে এনেছি। জাপান, আমেরিকায় প্রচুর সত্যজিৎ রায়। ওরা একজনে সন্তুষ্ট নয়। ফলে, একজনকে আঁকড়ে তারা তাকে ঈশ্বর বানায়নি। সময়ের দাবি মেনে প্রতি দশকেই নতুন পরিচালক এসেছেন। তাঁদের কাজে ওদের ইন্ডাস্ট্রি সমৃদ্ধ। বাংলায় সেটি হচ্ছে না। তাই এই দুরবস্থা।’’ ঠিক এই জায়গা থেকেই পরিচালকের চোখে সত্যজিতের কোনও ছবিই পছন্দের নয়। তিনি ক্লাসিক ছবি দেখতে ভালবাসেন না। ওই সময়ের কাজও তাঁকে আকর্ষণ করে না। তাঁর বক্তব্য, একা সত্যজিৎ নন, সেই সময়ের কোনও পরিচালকের ছবিই তিনি দেখতে ভালবাসেন না। তাই সত্যজিতের কোনও ছবি তাঁর চোখে ‘প্রিয়’ নয়।