তিনি বলিউডের ‘ট্র্যাজেডি কিং’। তবে পর্দায় ট্র্যাজেডির নায়ক দিলীপ কুমারের ব্যাক্তিগত জীবন ছিল বরাবরই রঙিন। হতে চেয়েছিলেন ব্যবসায়ী । কিন্তু ঘটনাচক্রে হয়ে গেলেন নায়ক। তার পর তাঁর অভিনয় জীবন প্রায় ছয় দশক বিস্তৃত হয়েছে বলিউডে। জীবনে বহু উত্থানপতন দেখেছেন। আবার নায়িকাদের প্রেমেও পড়েছেন একাধিক বার। বুধবার তাঁর মৃত্যুতে একটা যুগের অবসান হল।
বলিউডের প্রথম ‘খান’ দিলীপ। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৮। দীর্ঘ দিন ধরেই বয়সজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। ফুসফুসে ফ্লুইড জমছিল বারবার। গত এক বছর একরকম শয্যাশায়ীই হয়ে পড়েছিলেন দিলীপ। তবে স্ত্রী সায়রা বানু বরাবর পাশে থেকেছেন। এমনকি শেষ সময়েও দিল্পীপের পাশে ছিলেন সায়রা।
দিলীপের বাবা ছিলেন অবিভক্ত ভারতের পেশোয়ারের সম্পন্ন ব্যবসায়ী। তবে বাবার সঙ্গে একরোখা ছেলের সম্পর্ক কিছুতেই ভাল হত না। কথা কাটাকাটির জেরে এক দিন বাড়ি ছেড়েই বেরিয়ে পড়লেন কিশোর ইউসুফ।
বাড়ি পেশোয়ারে হলেও ইউসুফ পড়তেন নাসিকের বার্নেস বোর্ডিং স্কুলে। বাড়ি ছেড়ে আসার সময়েও মনে পড়ল পুণের কথা। সেখানে পৌঁছে আলাপ হল এক ক্যাফে মালিকের সঙ্গে। পাশে পেলেন এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান দম্পতিকে।
তাঁদের সূত্রে দেখা হল এক ক্যান্টিন কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে। সেনাবাহিনীর ক্লাবের কাছে একটি স্যান্ডউইচের দোকান খুললেন ইউসুফ। ইংরেজি ভাল বলতে আর লিখতে পারতেন। ব্যবসা দাঁড় করাতে সময় নিলেন না।
বাড়ি ফিরলেন পাঁচ হাজার টাকা জমিয়ে। তখনও অবধি জীবনের লক্ষ্য ছিল, ব্যবসায়ী হওয়া। ব্যবসা শুরু করার সূত্রেই আলাপ হল জনৈক মাসানির সঙ্গে। তিনি দেখেই বুঝলেন, ইউসুফের জায়গা ব্যবসার গদিতে নয়। বরং অন্য কোথাও।
মাসানি তাঁকে নিয়ে গেলেন বম্বে টকিজে। প্রথম দিকে ইউসুফ ছবির গল্প বাছাই এবং চিত্রনাট্য লেখার কাজে সাহায্য করতেন। খুব ভাল জানতেন উর্দু। ফলে নিজের কাজে সুনাম অর্জন করতে সমস্যা হল না।
অভিনেত্রী দেবিকারানি তাঁকে প্রস্তাব দিলেন অভিনয়ের। ১৯৪৪ সালে মুক্তি পেল অমিয় চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘জোয়ার ভাটা’। দেবিকারানির পরামর্শে নাম পাল্টে ফেললেন ইউসুফ খান। ছবির জন্য তাঁর নাম হল দিলীপকুমার। এর পর বাকিটা ইতিহাস।
প্রায় ছয় দশক ধরে বিস্তৃত কেরিয়ারে দিলীপকুমার অভিনয় করেছেন ৬৫টির বেশি ছবিতে। ‘দেবদাস’, ‘কোহিনুর’, ‘মধুমতী’, ‘মুঘলে আজম’, ‘গঙ্গা যমুনা’, ‘রাম অউর শ্যাম’, ‘শক্তি’ , ‘মসান’, ‘ক্রান্তি’, ‘সওদাগর’-সহ অসংখ্য ছবির নায়ক হয়ে গেলেন বলিউডের ‘ট্র্যাজেডি কিং’।
কেরিয়ারের মতো বর্ণময় ইন্ডাস্ট্রির ‘প্রথম খান’-এর ব্যক্তিগত জীবনও। ১৯৪৮ সালে মুক্তি পায় ‘শহিদ’। ছবিতে দিলীপকুমারের নায়িকা ছিলেন কামিনী কৌশল। এই ছবিতে অভিনয় করার সময়ে তাঁদের প্রেম ছিল ইন্ডাস্ট্রিতে বহুচর্চিত বিষয়।
দু’জনে বিয়ে করবেন বলেও ঠিক করেছিলেন। কিন্তু বাধা দিলেন কামিনীর দাদা। তিনি রাজি ছিলেন না এই সম্পর্কে। শোনা যায় তিনি দিলীপকুমারকে হুমকিও দিয়েছিলেন।
এর পর তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে যায়। সে বছরই কামিনী বিয়ে করেন তাঁর প্রয়াত দিদির স্বামীকে। দুর্ঘটনায় নিহত দিদির দুই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেন কামিনী।
এর পর দিলীপকুমার প্রেমে পড়েন মধুবালার। দীর্ঘ সাত বছর চলেছিল তাঁদের প্রেমপর্ব। এই সম্পর্ক ভেঙে যায় দুই তারকার ইগো সমস্যায়। একটি ছবির শুটিং লোকেশনে মধুবালাকে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না তাঁর বাবা।
পরিচালক-প্রযোজক অনুরোধ করেন দিলীপকুমারকে। তিনি যেন কথা বলেন মধুবালার বাবার সঙ্গে। দিলীপকুমারের অভিযোগ ছিল, মধুবালার বাবা তাঁকে অপমান করেছেন।
অন্য দিকে মধুবালার বক্তব্য ছিল, দিলীপকুমারের কাছে অপমানিত হয়েছেন তাঁর বাবা আতাউল্লাহ খান। তিনি তাঁর বাবার বিরুদ্ধাচারণ করতে পারেননি। মধুবালার কথায় আতাউল্লাহর কাছে ক্ষমা চাননি দিলীপকুমার। চাপানউতরের জেরে ভেঙে যায় দিলীপকুমার-মধুবালা প্রেম।
১৯৬০ সালে মধুবালা বিয়ে করেন কিশোরকুমারকে। কিন্তু দিলীপকুমার বেশ কয়েক বছর কোনও সম্পর্ক থেকে দূরে ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বিয়ে করেন সায়রা বানুকে। শোনা যায়, তাঁর বিয়ের খবরে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন অসুস্থ মধুবালা। তার তিন বছর পরে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন তিনি।
সায়রা বানুকে বিয়ের সময় দিলীপকুমারের বয়স ছিল ৪৪ বছর। সায়রা বানু ছিলেন ঠিক অর্ধেক, মাত্র ২২ বছর। পরে সায়রা বানু একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি ১২ বছর বয়স থেকেই দিলীপকুমারের অন্ধ ভক্ত ছিলেন।
অথচ তাঁর স্বপ্নের নায়কই তাঁকে প্রথম দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। প্রথম আলাপে সায়রা বানুর রূপের প্রশংসা করেছিলেন দিলীপকুমার। কিন্তু ‘বাচ্চা মেয়ে’ বলে বজায় রাখতেন দূরত্ব।
এ দিকে দিলীপকুমারের ছবির ভক্ত সায়রা বানু নিজেই এক দিন পা রাখলেন ইন্ডাস্ট্রিতে। শোনা যায়, সে সময় রাজেন্দ্র কুমারের সঙ্গে তাঁর মৃদু ভাল লাগার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সায়রার মা, বিগত দিনের অভিনেত্রী নাসিম বানুর হস্তক্ষেপে বিবাহিত রাজেন্দ্রকুমারের কাছ থেকে সরে আসেন ‘জংলি’ ও ‘পড়োসন’-এর নায়িকা।
এর পর নাসিম বানুই উদ্যোগী হন দিলীপকুমারের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের। সায়রা বানুর মনে হয়েছিল, দিলীপকুমারকে স্বামী হিসেবে পেয়ে তাঁর বহু দিনের স্বপ্ন পূর্ণ হল।
সে সময় অনেকেই বলেছিলেন, এই বিয়ে বেশি দিন স্থায়ী হবে না। কিন্তু নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করে দিলীপকুমার-সায়রা বানু দু’জনে দু’জনের পাশে ছায়া হয়ে পাঁচ দশকের বেশি দাম্পত্যজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।
তবে আটের দশকের গোড়ায় কিছুটা হলেও ঝড়ের মুখে পড়েছিল তাঁদের দাম্পত্য। পাকিস্তানের নাগরিক আসমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন দিলীপকুমার। এমন গুঞ্জনও শোনা যায়, তিনি সায়রা বানুকে ডিভোর্স করে বিয়ে করেছিলেন আসমাকে।
কিন্তু দিলীপকুমাররে দ্বিতীয় বিয়ে নাকি মাত্র দু’বছর স্থায়ী হয়েছিল। সেই সম্পর্ক ভেঙে তিনি ফিরে আসেন সায়রা বানুর কাছে। আবার বিয়ে করেন তাঁকে। এর পর সায়রা বানু অভিনয় পুরোপুরি ছেড়ে দেন। তাঁদের মতো দীর্ঘ বসন্তের দাম্পত্য বলিউডে বিরল।