ফাইল চিত্র।
তখনও তরুণ মজুমদার পরিচালক নন। তখন তিনি ছবির প্রচারবিদ। তৎকালীন জনপ্রিয় প্রচারবিদ বাগীশ্বর ঝা-র সহকারী। রুপোলি পর্দার সঙ্গে প্রেমের শুরু তখন থেকেই। ছবির স্বার্থে ছবির খবর নিয়ে দৌড়তেন এ দিক সে দিক। আরও একটি জিনিস সবার নজর কাড়ত। মুক্তোর মতো হাতের লেখা। সবাইকে ‘আপনি’ সম্বোধন করে কথা। সাল ১৯৫৯। এই প্রচারবিদই দিলীপ মুখোপাধ্যায়, শচীন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে পরিচালনায় এলেন। ত্রয়ীর গোষ্ঠীর নাম ‘যাত্রিক’। তরুণ মজুমদার তখন আক্ষরিক অর্থেই তরুণ! যাত্রিকের প্রথম ছবি ‘চাওয়া পাওয়া’। উত্তমকুমার নায়ক। বিপরীতে সুচিত্রা সেন। এত দিন যে ভাবে উত্তম-সুচিত্রার জৌলুস পর্দায় ব্যবহৃত হয়ে এসেছে এই গল্প তার থেকে লক্ষ যোজন দূরে। ছিমছাম গল্পে নায়ক-নায়িকা মাটির কাছাকাছি। ছবি জনপ্রিয় হল। পরিচালক তরুণের যাত্রা শুরু।
অবিভক্ত বাংলাদেশের বগুড়া জেলায় ১৯৩১-এ জন্ম তাঁর। বাবা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁর সন্তান জেদি, একরোখা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এই স্বভাব তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত সঙ্গী ছিল। যাত্রিকের ‘চাওয়া পাওয়া’ জনপ্রিয় হওয়ার পরেই তাদের দ্বিতীয় ছবি ‘কাচের স্বর্গ’। যেখানে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দিলীপ মুখোপাধ্যায়। ১৯৬৩-তে যাত্রিকের তিন পরিচালক যে যাঁর মতো।
নিজের মতো পথচলা শুরু হতেই তরুণ মজুমদার যুগ শুরু। ‘একটুকু বাসা’, ‘আলোর পিপাসা’, ‘বালিকা বধূ’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘পলাতক’, ‘ফুলেশ্বরী’। সমাজের আনাচে কানাচের মানুষদের নিয়ে গল্প। প্রতিটি ছবির গান কান পেতে শোনার মতো। সেটা ‘পলাতক’ই হোক বা ‘ফুলেশ্বরী’। শোনা যায়, ‘পলাতক’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করবেন বলে নাকি উত্তমকুমার পরিচালকের বাড়িতে হত্যে দিয়েছিলেন! তনুবাবুর এক কথা, তথাকথিত নায়ক এই ছবির মুখ্য অভিনেতা হবেন না। সেই অনুযায়ী তিনি বেছেছিলেন অনুপকুমারকে। বাকিটা ইতিহাস!
এও শোনা কথা, ছবি মুক্তির বেশ কিছু দিন পরে পরিচালক হাঁটছেন কলেজ স্ট্রিটে। বিদেশি পত্রিকার সন্ধানে। আচমকাই এক ব্যক্তি আপ্যায়ন করে তাঁকে নিয়ে যান স্থানীয় রেস্তরাঁয়। সেখানে বসে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। কৌতূকাভিনেতা সে দিন নাকি ভূরিভোজ করিয়েছিলেন পরিচালককে। তার পরেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘‘আপনে সক্কলরে দ্যাখাইয়া দেসেন, কমেডিয়ানরাও অভিনয় করতে পারে!’’ ‘ফুলেশ্বরী’-তেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এ বার নায়ক শমিত ভঞ্জ। এই ছবিতে মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষাল গেয়েছিলেন। এও সবার অজানা, ছবিটি প্রথমে করার কথা ছিল আরও এক জনপ্রিয় পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের। ঠিক ছিল, এই ছবির প্রযোজক হবেন তরুণ মজুমদার। অরবিন্দবাবু চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন। কিন্তু একটি জায়গায় এসে তাঁর লেখনি খেই হারিয়ে ফেলেছিল। তনুবাবুকে সে কথা জানাতেই তিনি নতুন করে চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন।
সেই চিত্রনাট্য অরবিন্দবাবুরও পছন্দ হয়েছিল। যে হেতু পুরো পরিশ্রম তনুবাবুর, তাই পরিচালনা থেকে তিনি সরে দাঁড়িয়েছিলেন। এ ভাবেই ‘ফুলেশ্বরী’ তরুণ মজুমদারের। তখন তরুণ মজুমদার ছবি মানেই সন্ধ্যা রায়। গাঁ-গঞ্জের গল্পে সন্ধ্যা অদ্ভুত মানিয়েও যেতেন। ওঁর গোল মুখ, মিষ্টি হাসি, ছোটখাটো চেহারা শহরের মেয়ের তুলনায় মফস্সলের মেয়ে হিসেবেই জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। এ ভাবেই কাজ করতে করতে পরিচালক-নায়িকার প্রেম। শেষে সাতপাক। এ বারেও মূল উদ্যোক্তা প্রচারবিদ বাগীশ্বর ঝা। টলিউড বলে, ইন্ডিয়ান ফিল্ম ল্যাবরেটরিতে নাকি বিয়ে, বৌভাত দুটোই হয়েছিল। প্রায় গোটা টলিউড তাঁদের বিয়েতে যোগ দিয়েছিল। এসেছিলেন উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ সুচিত্রা সেন।
মাছের একাধিক পদ দিয়ে আমন্ত্রিতদের আপ্যায়ন করেছিলেন তরুণ-সন্ধ্যা। তার পর এক সঙ্গে ভালবাসা ভালবাসা, পথভোলা, পথ ও প্রাসাদ প্রচুর ছবি করেছেন। পরিচালক-নায়িকার সুখের সংসার দেখে চোখ টাটিয়েছিল হয়ত অনেকের। হঠাৎই গুঞ্জন, পরিচালক স্বামীর সমস্ত ছবিতে অভিনয় করতে পারবেন বলেই নাকি তরুণ মজুমদারকে বিয়ে করেছিলেন সন্ধ্যা রায়! এই চর্চা চাউর হতেই একটা সময়ের পর পরিচালকের ছবিতে আর অভিনেত্রী স্ত্রীকে দেখা যায়নি। অভিমানও কি জমেছিল তখন থেকেই?
আস্তে আস্তে ছবির সংখ্যাও কমতে থাকে তরুণের। টলিউডে তখন নতুন গল্পের জোয়ার। তার সঙ্গে নাকি খাপ খাওয়াতে পারছিল না একাধিক জাতীয় পুরস্কারজয়ী পরিচালকের ছবি। ১৯৯৮ সালে তাঁর শেষ ছবি ভালবাসার বাড়ি দর্শক নেয়নি। পরিচালক তার পরেই নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তবু এই প্রজন্মের ছবির প্রতি কৌতূহলও ছিল তাঁর। কোনও ছবি ভাল হয়েছে শুনলে দেখতে চলে যেতেন। এ ভাবেই অনীক দত্তের অপরাজিত দেখে তিনি পরিচালককে বলেছিলেন, ‘‘বাংলা ছায়াছবির যা দশা তাকে টেনে তুলতে পারেন আপনারাই।’’ অসুস্থতার দিন কয়েক আগে ঝাড়গ্রামে লোকেশন দেখতেও গিয়েছিলেন। ঠিক ছিল, পরপর তিনটি ছবি করবেন।
নতুন করে আবার যখন নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন বর্ষীয়ান পরিচালক। এ বার শরীর বিশ্বাসঘাতকতা করল! কিডনি বিকল। হৃদরোগ, ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেশি। ফুসফুসে সংক্রমণ, রক্তচাপ কম। ৯১ বছর বয়সে এত রোগের সঙ্গে আর লড়া যায়? ৪ জুলাই স্বামী বিবেকানন্দের প্রয়াণ দিবসেই মাটির মায়া কাটালেন চিরকাল মাটিকে ভালবেসে আসা ‘জীবনপুরের পথিক’।