বিচারের দাবিতে আবারও রাজপথে জুনিয়র ডাক্তার-সহ অভয়া মঞ্চের সদস্যরা। দুর্নীতি ও অভয়া-কাণ্ডে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলের জামিন মঞ্জুরের খবর সামনে আসার পরই জুনিয়র ডাক্তারদের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষকে ফের পথে নামার আহ্বান জানানো হয়েছিল। নিজের ‘সুরক্ষিত’ কর্মস্থলে ধর্ষিতা ডাক্তার ছাত্রীর মৃত্যুর ইতিমধ্যে চার মাস পেরিয়ে গেছে। সে দিনের স্ফুলিঙ্গ যে ভাবে এ রাজ্য-সহ দেশ-বিদেশের অগণিত মানুষের মনে ক্ষোভের আগুন জ্বেলে দিয়েছিল, সময়ের সঙ্গে তার ধোঁয়াটুকুও যেন মিলিয়ে এসেছে। তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা এবং আদালতের রায় মেয়েটির বাবা-মায়ের পাশাপাশি বিচারের দাবিতে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে পথে নামা অজস্র মানুষকে শুধু হতাশই করেনি, প্রশাসন, তদন্তকারী সংস্থা এমনকি বিচারব্যবস্থাকেও অনেক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
নির্যাতিতা মেয়েটির দেহে আঘাতের চিহ্ন ও ক্ষতের ধরন প্রকাশ্যে আসার পর সিবিআই-সহ বিশেষজ্ঞ মহল সবাই নিশ্চিত, এমন ঘটনা এক জনের পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়। অথচ এই দীর্ঘ তদন্তের পরেও ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে না পারাটা কি নিছকই পেশাদারি ব্যর্থতা? এর পিছনে প্রভাবশালীদের অদৃশ্য হাত আছে কি না সেই সন্দেহ উড়িয়ে দেওয়ার নয়। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের ভাসিয়ে দেওয়া আত্মহত্যা-তত্ত্ব, এফআইআর-এ বিলম্ব, দ্রুত মৃতদেহ সৎকারে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক চাপ, ঘটনাস্থলের পাশের কক্ষ সংস্কারে তৎপরতা, অধ্যক্ষের চটজলদি ‘পুনর্বাসন’, এমনকি মেয়েদের রাত দখল কর্মসূচি চলাকালীন আর জি কর হাসপাতালে বহিরাগত দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব-সহ নানা ঘটনাকে অনেকেই মনে করছেন, এ সবই হল খুন ও ধর্ষণ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা।
গত ১০ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার শুনানি-পর্বে সলিসিটর জেনারেল জানিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ না পাওয়ার কারণে এই মামলায় গ্রেফতার হওয়া সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিৎ মণ্ডলের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে দেরি হচ্ছে। অথচ গত ১৪ ডিসেম্বর সিজিও কমপ্লেক্সের সামনে বিক্ষোভরত জুনিয়র ডাক্তারদের এক প্রতিনিধি-দলকে তদন্তকারী অফিসার জানিয়েছেন, কিছু ‘টেকনিক্যাল’ কারণে চার্জশিট পেশে দেরি হচ্ছে। কোনটা ঠিক, তা নিয়ে ব্যাপক ধন্দ। মৃতার অভিভাবকদের দায়ের করা মামলা থেকে আইনজীবী আচমকা কেন সরে গেলেন, তারও কোনও সদুত্তর নেই।
টানা তিন মাস তদন্তের পরেও নতুন তথ্যপ্রমাণ খুঁজে পাওয়া দূর, যে পাথুরে প্রমাণের ভিত্তিতে আর জি কর ধর্ষণকাণ্ডে তথ্যপ্রমাণ লোপাট ও বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সিবিআই সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করেছিল, গত ১৩ ডিসেম্বর শিয়ালদহ আদালতে শুনানি-পর্বে তারা সেগুলোও কেন দাখিল করে অভিযুক্তদের জামিনের বিরোধিতা করল না, তারও ব্যাখ্যা নেই। আর জি কর কাণ্ডের তদন্তভার হাতে নেওয়ার পর সিবিআই-এর পক্ষ থেকে তথ্যপ্রমাণ লোপাট, ‘প্লেস অব অকারেন্স অল্টার’ এবং ‘ট্যাম্পারিং’-সহ বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, চার মাস তদন্ত চালানোর পরে সে বিষয়ে তাঁদেরই নীরবতায় সন্দেহ জাগে না কি?
গত ১০ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টে শুনানির সময় জানা গেছে, এই মামলায় প্রধানত তিনটি বিষয়ে তদন্ত চালাচ্ছে সিবিআই। এক, অভয়ার খুন ও ধর্ষণ, দুই, তথ্যপ্রমাণ লোপাটে কারা যুক্ত এবং তিন, দুর্নীতি। সিবিআই তদন্তভার হাতে নেওয়ার পর এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে গত ১০ ডিসেম্বর সপ্তম স্টেটাস রিপোর্ট জমা দিলেও অভিযুক্ত হিসাবে সঞ্জয় রায় ছাড়া অন্য কোনও ব্যক্তির নাম সংযোজন করেছে বলে জানা যায়নি। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায়, অদূর ভবিষ্যতে তাঁরা তথ্যপ্রমাণ লোপাটের নেপথ্য-কুশীলবদের খুঁজে পাবেন, তা হলেও এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত অন্য অপরাধীরা চিরকালই পর্দার আড়ালে থেকে যাবে কি না, এই আশঙ্কাই এখন সবচেয়ে বড়। আবার, এক দিকে যখন তথ্যপ্রমাণ লোপাটের দোহাই দিয়ে তদন্তকারী সংস্থা নিজেদের অপারগতাকে আড়াল করছে, তখন রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন ও শাসক দল ব্যর্থতার দায় সিবিআই-এর ঘাড়ে চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে ব্যস্ত!
ঘটনায় যুক্ত দোষীদের শাস্তির দাবিতে চিকিৎসক-সহ সমাজের সব শ্রেণির যে মানুষেরা দিনের পর দিন পথে নেমেছিলেন, রাত দখলের আহ্বানে যে মেয়েরা স্লোগানে ও নানা কর্মসূচিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, এমনকি যাঁরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে শাসকের রোষ ও পুলিশি হেনস্থা-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাঁদের সিংহভাগই রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন, সিবিআই এমনকি বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করেছেন। সাধারণ মানুষের এই আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস যে এক অশনিসঙ্কেত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর পর অনুরূপ ঘটনা যদি তাঁদের আইন নিজের হাতে তুলে নিতে প্ররোচিত করে, শাসনের নামে তাঁদের পায়ে বেড়ি পরানো যাবে কি?