Coronavirus

যখন সময় থমকে দাঁড়ায়...

টলিউড ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান অবস্থা কেমন? আগামী দিনের রূপরেখাই বা কেমন হবে? খোঁজ করল আনন্দ প্লাস ইন্ডাস্ট্রির অনেকে সাহায্য করলেও, তাঁদেরও ক্ষমতা সীমিত।

Advertisement

পারমিতা সাহা ও দীপান্বিতা মুখোপাধ্যায় ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২০ ০০:০৮
Share:

জিৎ-এপ্রিলে ‘রক্ত রহস্য’র মুক্তি স্থগিত হয়েছিল-‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ছবিতে প্রসেনজিৎ-আরিয়ান-‘গোলন্দাজ’-এ দেব-লকডাউনে মুক্তি আটকে গিয়েছে ‘ধর্মযুদ্ধ’র

বিশ্ব-অর্থনীতি যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেখানে বিনোদন দুনিয়াও স্বাভাবিক ভাবে সঙ্কটে। আগে বাঁচার ন্যূনতম উপাদান জোগাড় হোক, তার পর বিনোদন। কিন্তু এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের কী ভাবে চলবে? শুটিং, পোস্ট প্রোডাকশন, ডিস্ট্রিবিউশন থেকে সিনেমা হলের কর্মী... এঁদের সংসার চলবে কী করে? ইন্ডাস্ট্রির অনেকে সাহায্য করলেও, তাঁদেরও ক্ষমতা সীমিত। লকডাউন উঠে গেলেও স্টুডিয়ো পাড়ায় লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন কবে শুনতে পাওয়া যাবে, তা নিশ্চিত নয়। যেমন নিশ্চিত নয় সিনেমা হলের পর্দা কবে উঠবে।

Advertisement

তারাদের কথা

তাঁরা ইন্ডাস্ট্রির ধারক, বাহকও। তাঁরা তারকা এবং প্রযোজক। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, জিৎ এবং দেব এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ নিয়ে কী বলছেন? দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ‘কাকাবাবু প্রত্যাবর্তন’-এর শুটিং সেরে ফিরে প্রসেনজিৎকে হোম কোয়রান্টিনে থাকতে হয়েছিল। কিছুটা বিষণ্ণ সুরেই বললেন, ‘‘আমরা ক্ষমতার কথা বলি। কিন্তু প্রকৃতি আর ঈশ্বরের উপরে যে কোনও শক্তি নেই, এটা আবার প্রমাণিত। সিনেমা মানে শুধু অভিনেতা নয়, শুটিং একটা বড় ব্যাপার। সেখানে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা কঠিন। এখনও সেই পরিস্থিতি আসেনি, যেখানে আলোচনা করতে পারি, পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে। সবটাই চেনের মতো জড়িয়ে। সিনেমা হল, এগজ়িবিটর, মাল্টিপ্লেক্স... আগামী দিনে সিনেমা রিলিজ় করা খুব কঠিন কাজ। সিনেমা হল খুললেও দেখা গেল, টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। প্রযোজক-এগজ়িবিটর সকলেরই ক্ষতি। বাড়িতে বসে শুটিং সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকার থেকে কিছু পদক্ষেপ করা হবে বলেই আমার ধারণা। এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে এই বছরের শেষ অবধি লেগে যাবেই।’’ তবে এত কিছুর মধ্যেও তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষই পারে এ যুদ্ধ জয় করে ফিরতে।

Advertisement

চিন্তায় রয়েছেন জিৎও। তাঁর প্রযোজনায় ‘সুইৎজ়ারল্যান্ড’ ছবিটি প্রায় রেডি হলেও, ‘বাজ়ি’র অর্ধেক কাজই বাকি। সে ছবি আদৌ এ বছর শেষ করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে তারকা-প্রযোজকের। ভাবছেন, ছোট স্কেলে হলেও কী ভাবে ব্যবসাটা ফের শুরু করা যায়। বললেন, ‘‘ডিস্ট্রিবিউটর এবং ইউনিট মেম্বারদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলেছিল একটা করে সিট বাদ রেখে ছোট স্কেলে অল্প কিছু সিনেমা রিলিজ় করে দেখবে, রেসপন্স কেমন পাওয়া যায়। এটা এখন মোটামুটি পরিষ্কার যে, মাস গ্যাদারিং তত দিন রেগুলারাইজ়ড হবে না, যত দিন না ভ্যাকসিন বেরোচ্ছে।’’ আপাতত সামনে আর কোনও পথ খোলা আছে বলে মনে হচ্ছে না তাঁর। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রিলিজ় করা নিয়ে কিছু ভেবেছেন? জিতের কথায়, ‘‘একজন অভিনেতার মানুষের কাছে পৌঁছনোটা সব সময়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখন ওটিটির দর্শকসংখ্যা বেড়েছে এবং সেখানে কনটেন্ট কনজ়াম্পশন হবে। তবে দর্শক কোন মাধ্যমে সিনেমা দেখছেন সেটা সমস্যা নয়, সমস্যা শুটিং করা।’’ সমস্যা আরও রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জিৎকে অফিস সেটআপও চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ‘‘চিন্তা তো আছেই। কোনও রোজগার নেই। গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি তলানিতে।’’

প্রোডাকশন হাউস চালানো নিয়ে চিন্তায় দেবও। বললেন, ‘‘আমার কর্মচারীদের যে স্যালারি দিই, সেটা পুরোটা দিতে পারিনি এ মাসে। কারণ চেষ্টা করছি, সকলকে যেন রাখতে পারি। তাঁদের সংসারটা যেন ভেসে না যায়, সেই দায়িত্বটা আমার। এর পর যখন পরিস্থিতি ঠিক হবে, তখন চেষ্টা করব ওঁদের পুরো পাওনা মিটিয়ে দিতে।’’ তাঁর মতে, এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে গেলে যত ভাবে পারা যায়, খরচ কমাতে হবে এবং অ্যাডজাস্ট করতে হবে। যেটা তিনি নিজে করছেনও। বললেন, ‘‘আমারও বিভিন্ন জায়গায় টাকা পাওনা রয়েছে। কিন্তু সেটা এখন চাইতে পারব না। কারণ তাঁরাও আমার মতোই সমস্যায়। এ বছর নতুন কোনও প্রজেক্ট শুরু করা সম্ভব হবে না। ‘টনিক’, ‘হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী’, ‘গোলন্দাজ’ এই তিনটে ছবি হয়তো মুক্তি পাবে।’’ তাঁর বাংলাদেশের ছবি ‘কমান্ডো’র একটা বড় অংশের শুটিং বাকি, যা বিদেশে হওয়ার কথা। ‘‘তাই কত দিন লকডাউন চলবে, এর পর কোন কোন রাজ্যে বা দেশে ট্রাভেল করার অনুমতি পাওয়া যাবে, ফিরলে কোয়রান্টিনে থাকতে হবে কি না... এই জবাবগুলো না পাওয়া পর্যন্ত আগামী পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়,’’ মত দেবের।

আরও পড়ুন: বিজয়ের সাহায্য

প্রযোজকের দৃষ্টিকোণ

গত এক বছর ধরে ঝুঁকিহীন নীতি নিয়ে ছবি তৈরির সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস। গত বছর তাঁদের বেশ কয়েকটি ছবি হিট ছিল। এ বছর ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ ভাল ব্যবসা করেছে। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে তাঁদের স্ট্র্যাটেজি কী? সংস্থার অন্যতম কর্ণধার মহেন্দ্র সোনি বলছেন, ‘‘পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। তাই এখনই কোনও স্ট্র্যাটেজি নেই। প্রত্যেকটা ইন্ডাস্ট্রিই তো ক্ষতিগ্রস্ত।’’ এসভিএফ-এর বেশ কিছু ছবির কাজ মাঝপথে— ‘গোলন্দাজ’, ‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘প্রেম টেম’, ‘ড্রাকুলা স্যর’। নতুন ছবি শুরু করার চেয়ে এগুলো শেষ করা সংস্থার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দিনে কি ছবির বাজেট কমবে? ‘‘যেগুলোর কাজ চলছে, সেগুলোর বাজেট কমানো সম্ভব নয়। ‘গোলন্দাজ’-এর শুটিং এখনও বাকি, কী করে তার বাজেট কাট করব! তবে নতুন ছবির ক্ষেত্রে বাজেট কমানোর কথা ভাবতে হবে,’’ মন্তব্য এসভিএফ কর্তার।

লকডাউন উঠে গেলেই প্রযোজকেরা চেষ্টা করবেন ছবি রিলিজ় করার। ক্যামেলিয়া প্রোডাকশনের নীলরতন দত্ত বলছিলেন, ‘‘প্রত্যেকের টাকা আটকে। আমার ‘ষড়রিপু’, ‘মায়াকুমারী’ ছবি দুটো তৈরি হয়ে থাকলেও নির্ধারিত সময়ে মুক্তি পাবে না। ‘খেলা যখন’-এর শুটিং কবে শুরু হবে, জানি না। এখন নতুন কাজের উৎসাহই নেই। সকলেই চাইবে, যে টাকাটা ব্লক হয়ে আছে, সেটা ফেরত পেতে। মানি রোটেশন পুরোপুরি ভাবে বন্ধ। তাই অনেকে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছেন।’’ সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় কিছু ভেবেছেন? ‘‘যে করেই হোক আগামী কয়েক মাস চালাতে হবে। আমার কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। টেকনিশিয়ান-সহ ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য, একটা ফান্ডের ব্যবস্থা করেছিলাম ভিডিয়ো তৈরি করে। আবার হয়তো সে রকমই কিছু একটা করতে হবে। ছবি রিলিজ়ের সমস্যার সমাধান সহজে হবে না। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির যে টার্নওভার গত বছর ছিল, এ বার তার চেয়ে অন্তত পঞ্চাশ-ষাট শতাংশ কমে যাবে।’’

ছবি রিলিজ়ের ভবিষ্যৎ

বলিউড সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুটিং, রিলিজ় বন্ধ রাখছে। সে ক্ষেত্রে পুজোর আগে ছবি মুক্তির সম্ভাবনা নেই টলিউডেও। মার্চ-এপ্রিলে যে ছবিগুলোর রিলিজ় ছিল, সেগুলো পিছিয়ে কবে মুক্তি পাবে তা-ও ঠিক হয়নি। ‘‘সিনেমার রিলিজ় নিয়ে খুব একটা ভাবছি না। পুরো সাইকেলটাই ছ’মাসের মতো পিছবে। যেগুলো তৈরি ছিল, সেগুলোই আসবে। কারণ নতুন ছবি তো নেই,’’ বলছিলেন মহেন্দ্র সোনি। প্রসেনজিৎ যেমন সংশয় প্রকাশ করেছেন পুজোর সময়েও হল খুলবে কি না, তা নিয়ে। দেবের প্রশ্ন, পরিস্থিতি ঠিক হলেও লোকের হাতে কি টাকা থাকবে সিনেমা দেখার জন্য? আন্তর্জাতিক বাজার না খুললে হিন্দি ছবি মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কম। আর ইংরেজি-হিন্দি ছবি যত দিন না রিলিজ় করবে, তত দিন বাংলারও ভাগ্য খুলবে না। এখন পুজোর সময়ে যাতে হল খোলে এবং দর্শক আসেন, সে দিকেই তাকিয়ে সকলে।

ওটিটি-নির্ভরতা কি ভোগাবে?

গত তিন মাসে নেটফ্লিক্স ১ কোটি ৬০ লক্ষ সাবস্ক্রিপশন বাড়িয়েছে। পরিচালক মৈনাক ভৌমিকের যুক্তি, ‘‘মানুষের বেসিক চাহিদার মধ্যে বিনোদন পড়ে না। তার উপরে ওটিটির অভ্যেস আরও পোক্ত হচ্ছে। বড় ক্যানভাসের ছবি ছাড়া হলে যাওয়ার প্রবণতা কমবে। আর বাজেট কাটের পরিস্থিতিতে বড় বাজেটের ছবিই বা কোথায়?’’ তবে প্রযোজক অতনু রায়চৌধুরী মনে করেন, ‘‘যত খারাপ পরিস্থিতিই আসুক না কেন, মানুষ সিনেমা দেখবেনই। কোথাও তো একটা রিলিফ দরকার।’’ কিন্তু সেই রিলিফ যদি বাড়ি বসেই পাওয়া যায়? ‘‘দর্শকের মধ্যেও ক্যাটিগরি আছে। কিছু দর্শক শুধুই সিরিয়াল দেখেন, কারও পছন্দ ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। আবার হলে গিয়ে সিনেমা দেখার এক্সপিরিয়েন্সটাও অনেকে ভালবাসেন। আগামী ছ’মাস হয়তো হলে ভিড় হবে না, কিন্তু এটা চিরস্থায়ী হতে পারে না,’’ মন্তব্য মহেন্দ্র সোনির।

সঙ্কটে সিনেমা হল

রাজ্যে এই মুহূর্তে দুশোর কাছাকাছি সিঙ্গল স্ক্রিন রয়েছে। আজই যদি হল খোলার অনুমতি দেওয়া হয়, তা হলেও দেখা যাবে আরও গোটা কুড়ি হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দু’মাস পরে খুললে, অন্তত ৬০-৭০টি সিঙ্গল স্ক্রিন বন্ধ হয়ে যাবে, এমন আশঙ্কার কথাই বললেন ডিস্ট্রিবিউটর-হলমালিক শতদীপ সাহা। ‘‘কোনও আয় নেই। তার মধ্যেই আমাদের কর্মীদের মাইনে, কর্পোরেশনের ট্যাক্স, বিদ্যুতের বিল দিতে হচ্ছে। শিল্পী, টেকনিশিয়ানদের সাহায্যের জন্য অনেকে এগিয়ে আসছেন কিন্তু সিনেমা হলের কর্মীদের জন্য কেউ নেই কেন?’’ প্রশ্ন শতদীপের। ইম্পার পক্ষ থেকে সরকারের কাছে ট্যাক্স ছাড়ের আবেদন করা হয়েছে। হল মালিকদের আর একটি সমস্যা বিদ্যুতের বিল। হল বন্ধ থাকলেও প্রতি মাসে বড় অঙ্কের বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়। সেটি মকুবেরও আর্জি সিনেমা হল মালিকদের।

আগামী দিনের ধূসর ছবিটা ইন্ডাস্ট্রির কাছে পরিষ্কার। কিন্তু উত্তরণের পথ? তা নিয়ে দোলাচলে সকলেই। তবে পৃথিবী আবার শান্ত হবে, এই আশাতেই তাঁরা পাকদণ্ডী পথটুকু পেরিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।

আরও পড়ুন: উপলব্ধি

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেনআপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement