গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে। চার দিকে এখন শুধুই ভোটের গল্প। আমি যদিও ‘বহুরুপী’র শুট নিয়ে ব্যস্ত। সে ভাবে দেখতে গেলে এটাই আমার ‘ভোট’। এ বারে ভোট দিতে যাব কি না, এখনও জানি না। কাজের জন্যই পশ্চিমবঙ্গে হয়তো ওই সময়ে থাকা হবে না।
আমি রাজনীতি বা ভোট, এই বিষয় নিয়ে কোনও দিন তেমন আগ্রহ দেখাই না। আমার বাবা অবশ্য সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। তাই বাড়িতে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা চলতই। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বড় হওয়ার পরেও দেখেছি, রাজনীতি আমাকে খুব একটা আকর্ষণ করেনি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীনও আমি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমি চুটিয়ে নাটক করছি তখন। নাটকের অবশ্য নিজস্ব রাজনীতি রয়েছে। সে সিনেমারও আছে। সে দিক থেকে বলব, আমাদের উইনডোজ়ের প্রতিটি ছবির নিজস্ব ভাষাই আসলে আমার রাজনীতির ভাষা।
আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন যে, রাজনীতিতে কেন এলাম না। আমি তাঁদের একটাই কথা বলি, ভালবাসা না থাকলে কোনও কাজ হয় না।
আমি বিশ্বাস করি, রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সচেতনতা— এই দুটো বিষয় আলাদা এবং তাদের মধ্যে একাধিক পার্থক্য রয়েছে। এক জন শিল্পী তাঁর কাজের মাধ্যমেই সমকালীন সমাজ এবং তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দর্শনকে তুলে ধরেন। সেই শিল্পী কবি হতে পারেন। গদ্যকার হতে পারেন। আবার চিত্র পরিচালকও হতে পারেন।
আমরা যখন ‘হামি’ ছবিটা তৈরি করেছিলাম, তখন কিন্তু সারা দেশের মানুষ ‘স্কুল’ ব্যাপারটিকেই অবিশ্বাস করছেন। স্কুল-বিরোধী নানা কথা হচ্ছে চার দিকে। কিন্তু ওই ছবিতে আমরা স্কুলের অশিক্ষক কর্মীদের হয়ে বলার চেষ্টা করেছি। একই ভাবে আমরা ‘গোত্র’ করেছিলাম। ‘গোত্র’ যেমন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেছে, তেমন ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’ সংস্কার ভুলে মহিলা পুরোহিতের পুজো করার অধিকারের কথা বলেছে। আমাদের প্রযোজিত ‘লক্ষ্মীছেলে’ও সেই সংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। এটাই আমার রাজনীতির ভাষা, রাজনীতির স্বর।
তবে কেউ প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগদান করে কাজ করবেন, না তাঁর শিল্পের মাধ্যমে কাজ করবেন, সেটা একান্তই ব্যক্তিবিশেষের উপরে নির্ভর করে।
একই ভাবে কোনও শিল্পী চান বা না চান, তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস তাঁর শিল্পের মধ্যে একটা নূন্যতম প্রভাব ফেলবেই। আবার অনেক সময়ে এটিও হতে পারে যে, আজকের কোনও কাজের রাজনৈতিক মূল্যায়ন ভবিষ্যতেও হতে পারে।
যেমন ‘হামি ২’ ছবিতে আমার চরিত্রটা ছিল শিক্ষকের। তার চাকরি বাতিল হয়েছে। এখন দেখতে পাচ্ছি, চাকরি বাতিল নিয়ে সারা রাজ্য উত্তাল।
মে মাসে গরমের ছুটিতে সাধারণত আমাদের ছবি মুক্তি পায়। আবার এই গরমের সময়েই সাধারণত নির্বাচন আসে। আমাদের প্রথম ছবি ‘ইচ্ছে’ মুক্তি পায় ১৫ জুলাই। ঘোর বর্ষা। সেই মুক্তির সঙ্গে এক দিকে ছিল বলিউডের ‘জ়িন্দগি না মিলেগি দোবারা’। অন্য দিকে হলিউড থেকে ছিল 'হ্যারি পটার'। ‘অলীক সুখ’ জুলাইয়ে এবং ‘মুক্তধারা’ অগস্টে মুক্তি পেয়েছিল। ‘রামধনু’ ৬ জুন। ‘বেলাশেষে’ ১ মে। ২৭ মে মুক্তি পায় ‘প্রাক্তন’। সে দিনই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয় বাবের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ‘কণ্ঠ’ মুক্তির সময়ে কলকাতায় তখন ভরা নির্বাচনের মরসুম। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছে! আবার নির্বাচনী মরসুমেই তো ‘তুমি যাকে ভালবাসো’ জনপ্রিয় হয়েছিল। আসলে ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখার পর মে মাসে বা নির্বাচনের সময়ে ছবি রিলিজ় করব, এ রকম কোনও পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। তখন বছরের অন্য কোনও সময় আমাদের ছবি মুক্তির জন্য জন্য খালি ছিল না। মে মাসে গরম বা ভোটের কথা ভেবে সকলেই এই সময়টাকে এড়িয়ে চলতেন। সোজা কথায়, আমরা জায়গা পাইনি বলেই মে মাসে ছবি নিয়ে আসা শুরু করলাম। আমাদের পছন্দের কোনও জায়গা ছিল না। শঙ্খবাবুর (শঙ্খ ঘোষ) কবিতার সেই লাইনের মতো অবস্থা ছিল আমাদের, ‘ভিখারির আবার পছন্দ’! তার পর দর্শকের ভালবাসায় নিজের থেকেই ধীরে ধীরে জায়গাটা তৈরি হয়ে যায়।
একটা ঘটনা একটু উল্লেখ করি। ‘নান্দীকার’-এ সে সময় আমরা কর্মী হিসেবে কাজের স্বপ্ন দেখছি। তখন আমাদের একটা প্রশ্ন করা হয় যে, একজন অভিনেতার কী কাজ?
অভিনেতা ঘুম থেকে উঠলেন। একটু পড়াশোনা করার পর হয়তো তিনি গলা সাধলেন কিছু ক্ষণ। মহড়ার ঘরটাকে হয়তো তিনি পরিচ্ছন্ন করলেন। তার পর হয়তো ছন্দের অনুশীলন করলেন। তার পর ইমপ্রোভাইজ়েশনের কাজ। বিকালে শারীরিক প্রশিক্ষণ। আর সন্ধে থেকে আমাদের নাটক পড়া শুরু হত। দিনের শেষে, সারা দিনে কে কী করলেন, তার একটা মূল্যায়নের পর আমরা বাড়ি ফিরতাম। তো, এই হল অভিনেতার কাজ। সারা দিনের কাজ।
এক জন অভিনেতা বা পরিচালক যেমন হোলটাইমার, তেমনই এক জন রাজনীতিকও। এ বার শিল্পী যদি রাজনীতিতে পা রাখেন, তা হলে কি এটা নয় যে, তিনি হয় শিল্প বা রাজনীতি কোথাও একটু হলেও কম সময় দিচ্ছেন? যাঁরা এই সমতা বজায় রাখতে পেরেছেন বা আগামী দিনে পারবেন, তাঁদেরকে আমি প্রণাম জানাচ্ছি। আমি কোনও দিনই ‘মাল্টিটাস্কিং’ করতে পারিনি, হয়তো ভবিষ্যতেও পারব না।
একটা সময় ছিল, যখন বছরে একটা করেই ছবি তৈরি করেছি। পরিচালনায় এসেছি বলে আমাকে অভিনয় ছাড়তে হয়েছে। কারণ দুটো এক সঙ্গে করতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে যখন আরও একটু গুছিয়ে নিতে পেরেছি, তখন পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছি।
এখন বিভিন্ন সময়ে চারপাশে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নিয়ে কথা ওঠে। সব কিছুতেই মেরুকরণ। সব কিছুই যেন একটু উগ্র। আমাকে এ রকম প্রশ্নও শুনতে হয়েছে, দেশে যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়েছে, সেখানে অদূর ভবিষ্যতে কি আমরা আমাদের মনের কথা বলতে পারব? যে ধরনের ছবি এত দিন তৈরি করেছি, সেগুলি তৈরি করত পারব?
আমার বিশ্বাস পারব। আমি মনে করি এ ক্ষেত্রে শিল্পের নির্মাণ সূত্রই আসল। শিল্প কাউকে উদ্দেশ্য করে তৈরি হচ্ছে, না মনে যা ধাক্কা দিচ্ছে, তা নিয়ে শিল্প তৈরি হচ্ছে— এই পার্থক্যটা বিচক্ষণ রাজনীতিকও জানেন। তার থেকেও বড় কথা, আমি পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক হিসেবে গর্বিত। এত দিন আমি এখানে যে ছবি করতে চেয়েছি, করতে পেরেছি। শিল্পী হিসেবে এখনও পর্যন্ত কোনও সমস্যার সম্মুখীন হইনি। তার জন্য এখানকার রাজনীতিকদের আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই।
আমি কোনও দিন রাজনীতিতে আসতে চাই না, সে কথা আগেই লিখেছি। এখন প্রশ্ন, যদি আসতে হয়। পাকেচক্রে কোনও দিন জনপ্রতিনিধি হয়ে গেলেও আমি জানি আমার মা আমাকে আগে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন। স্ত্রীও তাই করবেন। নন্দিতাদি (পরিচালক নন্দিতা রায়) হয়তো আমাকে প্রযোজনা সংস্থা থেকেই বার করে দেবেন।