বলিউডে পর্দার খলনায়কদের মধ্যে অন্যতম আশুতোষ রানা। নীরব থেকেও তাঁর চোখের চাহনিতেই বলা হয়ে যায় অনেক সংলাপ। শুধু খল চরিত্রই নয়। হিন্দি ছবির সিরিয়াস অভিনেতাদের মধ্যেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
মধ্যপ্রদেশের গডরওয়ারা শহরে তাঁর জন্ম ১৯৬৭ সালের ১০ নভেম্বর। জন্মগত নাম আশুতোষ নীখরা। পরে অভিনয়জীবনে এসে তিনি নামের সঙ্গে ‘রানা’ যোগ করেন।
আশুতোষের শৈশবে রামলীলার গভীর প্রভাব ছিল। তিনি ছোট থেকেই রামলীলায় অংশ নিতেন। তবে তাঁর পছন্দ ছিল রাবণের চরিত্র। ক্রমে এমনই অবস্থা দাঁড়ায়, রামলীলার সময় তাঁকে ছাড়া রাবণের চরিত্রে অন্য কাউকে ভাবাই হত না।
অল্প বয়স থেকেই দেব প্রভাকর শাস্ত্রীর ভক্ত হয়ে পড়েন আশুতোষ। তাঁকে তিনি ডাকতেন ‘দাদাজি’ বলে। জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি ‘দাদাজি’-র পরামর্শ নিতেন।
কলেজজীবনে পৌঁছে আশুতোষ পৌঁছে গেলেন নেতৃত্বের জায়গায়। ছাত্রমহলে তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল, রাজনীতিতে যোগ দিয়ে নেতা হওয়ার প্রস্তাব এসেছিল তাঁর কাছে। প্রথম দিকে তিনি কিছুটা আগ্রহীও হয়েছিলেন।
ছাত্রনেতা হওয়ার জন্য কার্যত প্রস্তুতই ছিলেন আশুতোষ। কিন্তু দাদাজি তাঁকে নিরস্ত করেন। নেতা নয়, বরং তিনি পরামর্শ দেন অভিনেতা হতে। তাঁর কথাতেই ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় ভর্তি হন আশুতোষ।
ভর্তি হতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু আশুতোষ বিপাকে পড়লেন পরে। বুঝলেন, গ্রামের জনপ্রিয়তা তিনি এখানে সহজে পাবেন না। সেখানে পড়ুয়াদের মধ্যে একাধিক গোষ্ঠী ছিল। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন মুকেশ তিওয়ারি, কুমুদ মিশ্র, যশপাল শর্মা। নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি ছিলেন জুনিয়র।
কিন্তু এনএসডি-তে প্রথম ১ বছর কার্যত বাতাসে মিলিয়ে য়ায়। সে সময় আশুতোষ নতুন জীবনে, নতুন পাঠ্যক্রমে মনই বসাতে পারছিলেন না। বছরের শেষে দেখা যায়, ফলাফলের তালিকায় সবথেকে নীচে তাঁর অবস্থান।
এনএসডি কর্তৃপক্ষ তাঁকে আর সুযোগ দিতে রাজি ছিলেন না। অনেক বার আর্জি জানানোর পরে অবশেষে তাঁকে ৬ মাস সময় দিতে রাজি হয় এনএসডি। এর পর নিজেকে উজাড় করে দেন আশুতোষ। তার ফলও পেয়েছিলেন। কোর্স শেষে দেখা যায় তিনি সহপাঠীদের থেকে অনেক এগিয়ে।
এনএসডি পর্ব শেষ হওয়ার পরেও আশুতোষ আবার দাদাজির পরামর্শ নেন। প্রবীণের কথাতেই তিনি মুম্বই পাড়ি দিয়ে মহেশ ভট্টের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। দাদাজি বলেছিলেন, আশুতোষের প্রথম কাজের নাম ‘এস’ বা ‘স’ দিয়ে শুরু হলে ভাল।
মুম্বইয়ে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে মহেশ ভট্টের কাছে পৌঁছনর সুযোগ পান আশুতোষ। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন এনএসডি-র কয়েক জন সহপাঠী। তাঁরা সে সময় মুম্বইয়ে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছিলেন।
প্রথম সাক্ষাতেই মহেশ ভট্টর পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলেন আশুতোষ। তাঁর পা ছুঁয়ে কেউ প্রণাম করুক, সেটা পছন্দ করতেন না মহেশ। তিনি সেট থেকে বার করে দেন আশুতোষকে। কিন্তু এর পর যত বারই মহেশের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছেন আশুতোষ।
তিনি মহেশকে বলেন, গুরুজনদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে শ্রদ্ধা জানানো তাঁর শৈশবের শিক্ষা। সেই ঐতিহ্য তিনি ছাড়তে পারবেন না। তাঁর এই কথায় মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন মহেশ ভট্ট।
সে সময় মহেশ ‘স্বাভিমান’ ধারাবাহিকের কাজ করছিলেন। ধারাবাহিকে ‘ত্যাগী’-র চরিত্রে সুযোগ পান আশুতোষ। প্রথমে দু’টি পর্বে অভিনয় করার কথা ছিল। সেখান থেকে ১২০টি পর্বে অভিনয় করেন আশুতোষ।
এর পর ‘তমন্না’, ‘গুলাম’ ছবিতে ছোট ছোট ভূমিকায় অভিনয় করেন আশুতোষ। কিন্তু নিজের কাজে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না তিনি। তাঁর আক্ষেপ দূর হল ১৯৯৮ সালে। সে বছর মুক্তি পেল পূজা ভট্টের ছবি ‘দুশমন’।
ছবিতে সঞ্জয় দত্ত, কাজলকে ছাপিয়ে নজর কেড়ে নিলেন আশুতোষ রানা। খলনায়ক পোস্টমাস্টার গোকুল পণ্ডিতের চরিত্রে বাজিমাত করলেন তিনি। বলিউডের নৃশংস খলনায়কের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে আছে ‘গোকুল পণ্ডিত’।
ক্রমে ইন্ডাস্ট্রিতে মহেশ ভট্ট হয়ে ওঠেন আশুতোষের মেন্টর। তাঁর ‘জখম’ ছবিতেও অভিনয় করেন আশুতোষ। তবে তিনি নিজের সব কাজকে ছাপিয়ে যান ‘সঙ্ঘর্ষ’ ছবিতে।
এই ছবিতে এক রূপান্তরকামীর চরিত্রে তাঁর অভিনয় দেখে দর্শকরা আক্ষরিক অর্থেই ভয় পেতেন। আশুতোষের অভিনয়ের তুলনা করা হয় ‘সড়ক’-এ সদাশিব আম্রপুরকরের অভিনয়ের সঙ্গে।
কাজের সূত্রেই আলাপ রেণুকা সাহানের সঙ্গে। আলাপ থেকে প্রেম। দু’বছরের প্রেমপর্বের পরে ২০০১ সালে বিয়ে করেন তাঁরা। রেণুকার এটা দ্বিতীয় বিয়ে ছিল। মরাঠি নাট্যব্যক্তিত্ব বিজয় কেলকরের সঙ্গে তাঁর প্রথম বিয়ে ছিল স্বল্পস্থায়ী। দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও রেণুকার মন জয় করে নেন আশুতোষ।
২০০২ সালের পর থেকে বলিউডে কাজ কমতে থাকে আশুতোষ রানার মতো অভিনেতার কাছেও। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বলিউডে ছবির ধরন পাল্টাচ্ছিল। পরিবর্তন হয়েছিল খলনায়কের ধারণাতেও। ভয়ঙ্কর-দর্শন খলনায়কের বদলে উঠে এসেছিল ‘ধূসর’ নায়কের ধারণা। অর্থাৎ আলাদা করে খলনায়ক নয়। নায়কের ভূমিকায় যিনি, তিনিই নেগেটিভ রোলে অভিনয় করতেন।
বাধ্য হয়ে আশুতোষ দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনয় শুরু করেন। সেখানেও তাঁর অভিনয় উঠে আসে প্রথম সারিতে। সে সময় তিনি ঠিক করেছিলেন এ বার হিন্দি ছবিতে বেছে বেছে অভিনয় করবেন। শুধু অর্থের জন্য অভিনয় করবেন না।
তাঁর হিন্দির ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাকিগুলি হল ‘রাজ’, ‘কসুর’, ‘বাদল’, ‘এলওসি: কার্গিল’, ‘দিল পরদেশি হো গ্যয়া’, ‘আওয়ারাপন’, ‘হাম্পটি শর্মা কি দুলহনিয়া’, ‘ডার্টি পিকচার’, ‘মুল্ক’ এবং ‘সোনচিড়িয়া’।
বলিউডের ছবিতে চরিত্রাভিনয়ের গুরুত্ব ফিরে আসায় খুশি আশুতোষ। জীবনে যা কিছু পেয়েছেন, তাঁর কৃতিত্ব আশুতোষ দেন তিন জনকে, তাঁর দাদাজি, মেন্টর মহেশ ভট্ট এবং স্ত্রী রেণুকা সহানেকে। লাইট ক্যামেরা অ্যাকশনের বাইরে স্ত্রী এবং দুই সন্তানের পরিসরে তিনি নিটোল ঘরোয়া।