ছোটবেলায় ছিলেন পরিহাসের পাত্রী। চার ভাইবোনের মধ্যে সবথেকে রোগা। হাসিঠাট্টার পাত্রী হতে হত আত্মীয় পরিজনের মধ্যে। পরবর্তী জীবনে সেই বালিকার মাথাতেই উঠেছিল ভারতসুন্দরীর খেতাব। তিনি পরিচিত হয়েছিলেন বলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী হিসেবে। তিনি নূতন। নামের সার্থকতা রেখেছিলেন। প্রতি ছবিতেই নিজেকে মেলে ধরেছিলেন নতুন নতুন রূপে।
কবি-পরিচালক কুমারসেন সমর্থ এবং অভিনেত্রী শোভনা সমর্থের বড় মেয়ে নূতনের জন্ম ১৯৩৬ সালের ৪ জুন। তাঁর দুই বোন তনুজা ও চতুরা এবং ভাই জয়দীপ। তনুজাও পরে নামী অভিনেত্রী হন। জয়দীপের জন্মের আগেই কুমারসেন-শোভনার দাম্পত্য ভেঙে যায়। চার সন্তানকে নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন শোভনা।
পঞ্চগনির সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট স্কুলের পরে ১৯৫৩ সালে নূতন উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেন সুইৎজারল্যান্ড।
তার আগেই হয়ে গিয়েছে হিন্দি ছবিতে হাতেখড়ি। ১৯৫০ সালে তাঁর মা শোভনা সমর্থ পরিচালিত ও প্রযোজিত ‘হামারি বেটি’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন চোদ্দ বছর বয়সি নূতন। নায়িকা হিসেবে তাঁর প্রথম ব্রেক ১৮৫৭ সালে, ‘সীমা’ ছবিতে। এই ছবির জন্য তিনি সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারও পান।
এরপর ‘পেয়িং গেস্ট’, ‘সুজাতা’, ‘আনাড়ি’— একের পর এক সফল ছবি নূতনের নামের পাশে। দেব আনন্দের সঙ্গে তাঁর রোমান্টিক জুড়ি ছিল খুবই জনপ্রিয়। ‘পেয়িং গেস্ট’ ছাড়াও তাঁদের অভিনয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে ‘মঞ্জিল’, ‘তেরে ঘর কে সামনে’-এর মতো নামী ছবি।
বিমল রায়ের পরিচালনায় ‘বন্দিনী’ ছবিতে নূতনের অভিনয় সবথেকে বেশি চর্চিত ও প্রশংসিত। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হন। নূতন সেই অভিনেত্রীদের মধ্যে অন্যতম, যাঁদের কাজ সমালোচক এবং দর্শক, দুই দিকেই সমাদৃত হয়েছে। ‘মিলন’, ‘সওদাগর’, ‘মেরি জঙ্গ’, ‘নাম’-এর মতো জনপ্রিয় ও বক্স অফিস সফল ছবিতে নূতনের অভিনয় দর্শকমনে দাগ কেটে গিয়েছে।
প্রায় চার দশকের কেরিয়ারে মোট ছ’বার তিনি সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে। ‘সীমা’, ‘সুজাতা’, ‘বন্দিনী’, ‘মিলন’, ‘ম্যায় তুলসি তেরে অঙ্গন কি’ ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রী এবং ‘মেরি জঙ্গ’ ছবির জন্য সেরা সহ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। একটিমাত্র টেলিভিশন সিরিজ ‘মুরজিম হাজির’-এও নূতনের অভিনয় স্মরণীয়।
‘বন্দিনী’, ‘মিলন’ এবং ‘সওদাগর’ ছবির জন্য তিনি হিন্দিতে বিএফজেএ পুরস্কার লাভ করেন। জীবদ্দশায় তাঁর অভিনীত শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছবি ‘কানুন আপনা আপনা’ হলে এসেছিল ১৯৮৯ সালে। ১৯৯১ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন নূতন। মৃত্যুর পরেও মুক্তি পেয়েছিল নূতনের দু’টি ছবি।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ‘মোস্ট আনকনভেনশনল’ নায়িকাদের মধ্যে অন্যতম নূতন। পর্দার বাইরেও তাঁর ভূমিকা প্রথাগত রীতির থেকে দূরে। অভিনয়ের পাশাপাশি তাঁর শখ ছিল শিকার করা।
এই বলিষ্ঠ ভাবমূর্তি নূতন বজায় রেখেছিলেন জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই। অভিনেতা সঞ্জীবকুমারকে একবার প্রকাশ্যে চড় মেরেছিলেন নূতন। অভিযোগ ছিল, সঞ্জীবকুমার নিজের কেরিয়ারের শুরুতে বলেছিলেন তাঁর প্রতি নূতনের দুর্বলতা ছিল। কিন্তু সঞ্জীবকুমার আগ্রহী না হওয়ায় সেই সম্পর্ক এগোয়নি।
নূতনের অভিযোগ ছিল, সঞ্জীবকুমারের রটানো এই গুজবে সমস্যা দেখা দিয়েছিল তাঁর বিবাহিত জীবনে। নৌসেনার লেফ্টেন্যান্ট রজনীশ বহেলকে ১৯৫৯ সালে বিয়ে করেছিলেন নূতন। শোনা যায়, বিয়ের পরে নূতনের অভিনয় নিয়ে আপত্তি ছিল রজনীশের। অভিনয়ের অনুমতি দিলেও বেশ কিছু শর্ত মেনে চলতে হত নূতনকে। সঞ্জীবকুমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গুঞ্জনে সংসারে জটিলতা এসেছিল বলে শোনা যায়।
নূতনের ধারণা ছিল, সঞ্জীবকুমারই সংবাদমাধ্যমে এ সব কথা বলছেন। একবার ছবির সেটে সঞ্জীবকুমারকে সংবাদমাধ্যমের লোকজনের মাঝখানে পেয়ে নূতন নিজের রাগ বশে রাখতে পারেননি। তখন নূতন একজন প্রতিষ্ঠিত তারকা। অন্য দিকে সঞ্জীবকুমার উঠতি নায়ক। নূতনের মতো একজন মার্জিত তারকার এই আচরণে হতচকিত হয়ে গিয়েছিল ইন্ডাস্ট্রি।
অভিনেত্রী মায়ের রেখে যাওয়া ব্যাটন হাতে তুলে নিয়েছেন নূতনের একমাত্র ছেলে, অভিনেতা মনীশ বহেল।