বিনোদন দুনিয়া আর শাসকদলের সমীকরণ নিয়ে সরব কৌশিক সেন। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
আমি শহরের বাইরে। মুম্বইয়ে একটি সিরিজ়ের শুটিংয়ে ব্যস্ত। তার মধ্যেই শুনলাম, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি টলিউড এবং টেলিপাড়ার সঙ্গে দূরত্ব বাড়াচ্ছেন। কারণ, আরজি কর-কাণ্ডে সরকারের বিরুদ্ধে অভিনেতাদের প্রতিবাদ। এই আবহেই টালিগঞ্জের সিনেমাপাড়ায় মন্ত্রী তথা টালিগঞ্জের বিধায়ক অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাস এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন চলচ্চিত্র ফেডারেশনকে নিয়ে ‘সরব’ হন ‘বিক্ষুব্ধ’ পরিচালকেরা। যাঁরা একই সঙ্গে অভিনেতাও।
যদিও কোনও সরকারি ঘোষণা হয়নি এই বিষয়ে। আমার মতে, সব সময় কোনও রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রী বা দল কিছু বলবেন বা বলবে, সেই প্রেক্ষিতে আমি প্রতিক্রিয়া জানাব, সেটা বোধ হয় নয়। আমার মনে হচ্ছে শুধুমাত্র আরজি কর-কাণ্ড নয়। ঘটনাটা এটাও যে, সেই সময় ফেডারেশনের অন্যায় আধিপত্যের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, সেটাই মুখ্য এবং বড় কারণ। যে কারণে প্রত্যেক বার যে পরিচালক, নির্দেশক, অভিনেতা বা অভিনেত্রীরা কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অনেক আগে থেকে অংশগ্রহণ করেন, সেই অংশগ্রহণে এ বারে হয়তো ভাটা পড়েছে। কারণ, একটা বড় সংখ্যক পরিচালকই কিন্তু ফেডারেশনের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ। একই ভাবে শিল্পী এবং প্রযোজকদের একটা বড় অংশও তাই-ই। এ ছাড়া, আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া তো রয়েছেই।
আমি সত্যিই জানি না, এই ধরনের কোনও মনোভাব আদৌ রাজ্য সরকার পোষণ করছে কি না। তার পরেও বলব, আরজি কর আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পিছনে কিন্তু অনেক কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ, আন্দোলনটাই ভুল দিকে চলে গেল। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমার বিশ্বাস, ২০২৬-এ আবারও শাসকদল ফিরবে। কারণ, রাজ্যে বিরোধী দলের অবস্থান আরও খারাপ। তার মানে তো এই নয় যে, যে অন্যায়ের কারণে শাসকদলের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে আদপে সেগুলো ঘটেনি। যেমন, শিক্ষা দুর্নীতি হয়নি অথবা হাসপাতাল নিয়ে দুর্নীতি হয়নি, তা তো নয়। সন্দীপ ঘোষ বা স্বরূপ বিশ্বাসের মতো মানুষদের বাড়বাড়ন্ত হয়নি, তা তো নয়। ফলে, ভোটের অঙ্ক কিন্তু সবটা প্রমাণ করে না। তাই আমার মতে, সমস্ত বিভাগের শিল্পীদের ‘ক্ষমতা’র সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এটাই তার প্রকৃষ্ট সময়।
আরও একটু সরলীকরণ করি। এই মুহূর্তে আমার চোখে পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতবর্ষে ‘ক্ষমতা’র কিন্তু দুটো ভাগ রয়েছে। গদিতে আসীন শাসকদলই যে শুধু ক্ষমতাবান, তা নয়। একই ভাবে বিরোধী দলও আর এক ভাবে ক্ষমতার প্রদর্শন করে। গত ১০-১২ বছর ধরে আমি টানা বলে এসেছি, শিল্পীদের অবশ্য কর্তব্য, সব রকমের ‘ক্ষমতা’র থেকে দূরত্ব বজায় রাখা। যেমন, আমি শুভেন্দু অধিকারী বা মহম্মদ সেলিমের পক্ষে নই। একই ভাবে সরকারের পক্ষেও নই। আমি ভাগ্যবান, আমার দেশ, আমার সংবিধান আমাকে বাক্স্বাধীনতা দিয়েছে। আমি এবং আমার মতো যাঁরা কোনও ভাবে সরকারি অনুদানের মুখাপেক্ষী নই, তাঁদের কিন্তু উচিত ‘ক্ষমতা’ থেকে এই দূরত্ব বজায় রেখে চলা। আমাদের তাই চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে হ্যাংলামি করার কিছু নেই। যদি মনে করি ভাল ছবি দেখব, তা হলে ‘ডেলিগেট কার্ড’ কিংবা টিকিট কেটে সিনেমা দেখতে যাব। সরকারি আমন্ত্রণের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকব না। এখন পৃথিবীটা ছোট হয়ে গিয়েছে। এখন বিশ্বের ভাল ভাল ছবি নানা ভাবে দেখা যায়। আগে সে সুযোগ ছিল না।
তাই মুখ্যমন্ত্রী আমাকে চাইছেন কি চাইছেন না, তৃণমূল সরকার আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে কি না, সেটা আমার কাছে ততটাও জরুরি নয়। আমি কী চাইছি, সেটা জরুরি। যেমন, আমি মনে করি, ফেডারেশন বেশ কিছু অন্যায় করেছে। অন্যায় করছেও। আমার যদি মনে হয় তার বিরুদ্ধে কথা বলব, তো বলব। তাতে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হলেও কিছু করার নেই। একই ভাবে আমার প্রতিবাদে বিরোধী দলনেতারা খুশি হলে তাতেও কিছু যাবে-আসবে না। তাঁদেরও খুশি করার দায় নেই আমার। যদিও দুর্ভাগ্য, সমাজ এবং সংবাদমাধ্যম মনে করে, মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা মানে বিরোধীদের সমর্থন জানানো। একই ভাবে শাসকদলকে সমর্থন জানানোর অর্থ আমি সেই দলভুক্ত, এমন নয়।
বরাবর বলে এসেছি। আবারও বলব, আমি নাগরিক হিসাবে এবং শিল্পী হিসাবে যেটা ঠিক মনে হবে সেটাই করব।