সত্যজিতের আঁকা ‘দেবী’ (১৯৬০) ছবির পোস্টার।
সত্যজিতের ছবিতে চোখ বার বার সুতীক্ষ্ণ ভাবে এসেছে। তাদের দৃষ্টির আলো কখনও কখনও ক্যামেরার লেন্স, চলচ্চিত্রের পর্দা অতিক্রম করে গায়ে এসে পড়েছে আমাদের। স্পর্শ করেছে আমাদের চেতন। প্রথমেই হয়তো মনে পড়বে ছোট্ট অপুর দুই চোখ। বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে তার অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা। দারিদ্র্যের রূঢ় বাস্তবতা তাতে বয়সের তুলনায় পরিণত এক উপলব্ধির ছায়া ফেললেও, নিটোল রয়ে গিয়েছে শিশুসুলভ মুগ্ধতা। ঠিকরে বেরোনো বিস্ময়, কৌতূহল, বাঙ্ময় এক জীবনের প্রতিরূপ। এ ভাবেই আর এক জোড়া চোখ পঞ্চাশ বছর আগে সিনেমা ও বাস্তবের অদৃশ্য পর্দা ভেদ করে কড়া নেড়ে গিয়েছিল আমাদের মনের দরজায়। বোধহয় খানিক অস্বস্তিতেও ফেলেছিল পুরুষতন্ত্রে লালিত সমাজ ও মননকে। বলা বাহুল্য, এখনও ফেলে।
ছবির নাম ‘দেবী’। ক্ষয়িষ্ণু জমিদারির প্রতিনিধি কালীকিঙ্কর স্বপ্নে দেখলেন পুত্রবধূ দয়াময়ী আসলে মা কালীর অবতার। সাক্ষাৎ দেবী! মা কালীর ত্রিনয়নের সঙ্গে মিলে গেল দয়ার চোখ। সে চোখ তুলে চাইল। ক্লোজ আপ ফ্রেমে সেই দৃষ্টির অভূতপূর্ব দীপ্তি নাড়িয়ে দিল পুরুষতান্ত্রিক চোখ, দেখার দৃষ্টি। যেমন কালীর উগ্রতা, নগ্নতা, কৃষ্ণবর্ণ নাড়িয়ে দেয় পুরুষতন্ত্রের পবিত্রতা ও সৌন্দর্যের নির্মাণ। ‘পথের পাঁচালী’-র তুলনায় বেশ কিছুটা কম চর্চিত এ ছবি। অপুর সেই চোখ মেলার দৃশ্যের তুলনায় জনপ্রিয়তার নিরিখেও কিছুটা পিছিয়ে কালীকিঙ্করের স্বপ্নে দেখা দয়াময়ীর চোখজোড়া। তবু তার গুরুত্ব কমে না এতটুকু। কমে না দয়াময়ীর পরিণতির তাৎপর্য। কারণ ধর্মান্ধতা-যুক্তিবাদ দ্বিত্বের জনপ্রিয় পাঠের আড়ালে ‘দেবী’ আসলে দয়ার জিতে যাওয়ার গল্প। এখন কালী-আরাধনারই মরসুম। স্রষ্টার শতবর্ষে বরং স্মরণ করা যাক দয়াময়ীর কথা, একটু অন্য ভাবে।
পাশাপাশি সে সময়ে দু’টি ছবির কাজ চলছে। সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ ও ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’। প্রথমটির মুক্তি ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, দ্বিতীয়টির সেই বছরেরই এপ্রিলে। কাকতালীয় ভাবে দু’টি ছবিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে একই জিনিস— দেবীর আসনে বসিয়ে মেয়েদের সম্মানের আড়ালে কী সুচারু ভাবে লুকিয়ে এক প্রচ্ছন্ন, অথচ অবিশ্বাস্য নৃশংসতা। দেবীত্বের রূপভেদ ঘটেছে অবশ্য। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় নীতার রূপায়ণে এসেছিল জগদ্ধাত্রীর আখ্যান, ‘দেবী’-তে সেখানে মা কালীর কাহিনি।
ভারতীয় চলচ্চিত্র ধার্মিকতা-নির্ভর ভাষ্যের ধারা থেকে সবে বেরিয়েছে তখন। ছবিতে দেবীর প্রসঙ্গ মানেই এক মঙ্গলময়ী রূপ- যিনি ভাল করছেন দেশের, দশের। দেশ ও দশও তাঁর জয়গানে মুখরিত। বেশ কয়েক দশক পেরিয়ে হালের বলিউড ছবিতে ‘নারী-কেন্দ্রিক’ ছবির ভিড়। এখনও নায়িকার ক্ষমতায়নে বার বারই তার উপরে আরোপিত দেবীত্ব। স্যুট-বুট পরিহিতা একাধারে চাকরি থেকে সংসার সামলান। দশভূজা হয়েই। তিনি সর্বংসহা। আবার, সেই সর্বংসহা হওয়ার মূল্যেই তিনি দেবী। কিন্তু মজার বিষয়, এই গোটা আখ্যানের এক দিক যদি হয় দেবী, কল্যাণময়ী মা, তবে অপর দিক একেবারে উল্টো- রাক্ষসী, ডাইনি। এবং আরও মজার বিষয় হল, পুরুষতন্ত্রে এই দুইয়ের ব্যবধান আদপে নিতান্তই কম, যৎকিঞ্চিৎ। প্রায় অদৃশ্য। ফলে, দেবী থেকে রাক্ষসী রূপান্তরে সময় বেশি লাগে না। যেমন ঘটেছিল দয়ার ক্ষেত্রে।
প্রবল প্রত্যাশার চাপে নীরবে সে যখন আরোপিত দেবীত্ব পালন করে চলেছে, তখন সে পূজিত। সেই মাতৃ আরাধনার ধুমে সে জ্ঞান পর্যন্ত হারায়, তবু কিছু বলে না। অলৌকিক ভাবে তার চরণামৃতে মৃতপ্রায় শিশু জীবন ফিরে পায়। ভক্তির ধূমধাম যায় বেড়ে। এতটাই যে, কলকাতা থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত উমাপ্রসাদও স্ত্রীর মনুষ্যত্বের পক্ষে সওয়াল করতে পারে না বাবা কালীকিঙ্করের কাছে। কিন্তু যে মুহূর্তে দয়া এই অমানবিক প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ, সেই মুহূর্তে সে রাক্ষসীতে পরিণত হয়। কখনও দেবী, কখনও রাক্ষসী। কিন্তু কদাপি মানুষ নয়।
প্রবল প্রত্যাশার চাপে নীরবে দয়া যখন আরোপিত দেবীত্ব পালন করে চলেছে, তখন সে পূজিত।
ছবির শেষে দয়া সর্ষে ক্ষেতে ঘন কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যায়। বিলীন হয়ে যায় যেন। এই দৃশ্য মনে করাতে পারে রামায়ণের সীতার পরিণতি। সীতাকে যেমন চরম অপমানের পরে নিজের কোলে আশ্রয় দিয়েছিল ধরণি, তেমনই সে যেন দয়াকেও এই ক্লান্তিকর অস্তিত্ব থেকে সযত্নে আড়াল করে নেয়। মহাকাব্যের নায়িকা হোক কিংবা কিশোরী গৃহবধূ, বার বার তাকে পরখ করে নিতে চায় পুরুষতন্ত্র। সে সতীসাধ্বী, না অসতী? দেবী, না রাক্ষসী? এই ছবিতে দয়ার অবস্থান কেবল দেবী-রাক্ষসী সরলরেখার মধ্যে নয়। উনিশ শতকে সদ্য পাশ্চাত্য শিক্ষার স্বাদ পাওয়া বাংলায় তার পরিচয় নির্মাণে ঢুকে পড়ে অন্য একটি দ্বন্দ্ব— ধার্মিকতা ও যুক্তিবাদ। বলা বাহুল্য, প্রথমটির প্রতিনিধি কালীকিঙ্কর। দ্বিতীয়টির উমাপ্রসাদ। প্রাথমিক স্তরে ছবিটির অবস্থান পিতা-পুত্রের এই বিরোধে। মাতৃভক্ত কালীকিঙ্কর স্বপ্নাদেশ পেয়ে দয়াকে সাক্ষাৎ কালীর আসনে বসালেন। অন্য দিকে, যুক্তিবাদী তরুণ উমাপ্রসাদ প্রতিবাদ করে প্রমাণ করতে চাইলেন দয়া আসলে মানুষ।
এই বিরোধের মধ্যে আটকে গেল সতেরো বছরের একটি কিশোরী। দেবী-মানুষ-রাক্ষসী: তিনটি বিন্দুতে দয়ার পরিচয় ক্রমাগত তৈরি হল ও ভাঙল। কিন্তু এর একটিতেও দয়ার নিজের কোনও হাত নেই, কর্তৃত্ব নেই, বক্তব্য নেই। তরুণ উমাপ্রসাদ দয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল। তার মুখে শোনা যায় রামমোহন রায়ের কথা, তার নখের ডগায় বিদ্যাসাগরের ‘আর্গুমেন্টস’। গোটা ছবি জুড়েই কালীকিঙ্করের ধর্ম-সর্বস্ব মননের বিরুদ্ধে যেন রক্ষক বা উদ্ধারকারীর ভূমিকায় উমাপ্রসাদ। কিন্তু দয়ার দেবীত্ব নির্মাণের পুরুষতান্ত্রিক ভাষ্য থেকে যে উমা নিজেও মুক্ত নয়, তা ছবিতেই আছে। বিয়ের দিন নতুন বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে প্রথমে বলে, ‘‘তুমি কি মাটির পুতুল, যে কথা বলো না? কই দেখি?’’ নববধূর দ্বিধা থরথর মুখটি তুলে সে একটিই শব্দ উচ্চারণ করে- ‘‘প্রতিমা!’’
ছবির শেষে দয়া সর্ষে ক্ষেতে ঘন কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যায়।
বার বার উমা তার বাবাকে দায়ী করে দয়ার এই পরিণতির জন্য। সে অবতীর্ণ হতে চায় দয়ার রক্ষকের ভূমিকায়- যে এসে এই পাকচক্র থেকে উদ্ধার করবে দয়াকে। কিন্তু দয়া ফিরিয়ে দেয় তাকে। এক বার নয়, দু’বার। প্রথম বার রাতের অন্ধকারে, উমা যখন তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঘাটের দিকে। সেখানে বাঁধা আছে নৌকো। কলকাতার দিকে রওনা দেবে। সেই আপাত সুখের আধুনিক জীবনের হাতছানি ফেলে ফিরে আসে দয়া। হয়তো দয়া জানত, সেখানেও আধুনিকতার নামে তার জন্য অপেক্ষা করছে অন্য কোনও অবদমন। এখানে দ্বিচারিতা অনেক বেশি। দ্বিতীয় প্রত্যাখ্যান ছবির শেষে। খোকার মৃত্যুর পর প্রায় উন্মাদ কালীকিঙ্করকে দেখে উমা ছুটে যায় দয়ার কাছে, তাকে বাঁচাতে। দয়া ততক্ষণে ‘রাক্ষসী’-তে পর্যবসিত। দেবীত্বের পরীক্ষায় সে ব্যর্থ। অদ্ভুত আলোয় মাখামাখি দয়ার ঘর, তার মধ্যে আলুথালু বেশে উদভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে দয়া। মুখে অসংলগ্ন কথা। দুই প্রজন্মের পুরুষের নির্মাণের চাপে তত ক্ষণে দয়ার সহনশক্তি রূপ নিয়েছে ‘হিস্টিরিয়া’-র।
ছবিতে এই ‘হিস্টিরিয়া’-র বহিঃপ্রকাশ ঘটছে অস্বাভাবিক ভাবে আলোকিত ঘরের ফ্রেমে। সদর তখন প্রবল পরাক্রমে ঢুকে পড়েছে অন্দরে, বাইরের আলোর আধিক্য ভিতরের সঙ্গে মিশে তৈরি করছে এক আশ্চর্য পরাবাস্তব মুহূর্তের।
এই আধিক্যের সমান্তরাল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে সমকালীন ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র শেষ দৃশ্যে। পুরুষতান্ত্রিক নির্মাণের ফাঁদে সারা জীবন আত্মত্যাগে, আত্মবিসর্জনের ভারে ন্যুব্জ নীতার মুখে তখন সেই অবিস্মরণীয় সংলাপ: ‘দাদা, আমি বাঁচব’। নীতার বাঁচতে চাওয়ার আর্তিতে কেঁপে ওঠে পাহাড়, ঝর্না, ঝাউবন। যেন নিসর্গ প্রতিধ্বনিতে ফিরিয়ে দিচ্ছে সেই একই আর্তি। মনে পড়ে যেতে পারে জীবনানন্দের কল্পনায় বেহুলার কথা: ‘একদিন অমরায় গিয়ে/ ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিলো ইন্দ্রের সভায়/ বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিলো পায়’। বিষণ্ণ বেহুলার মতোই নীতার কাছে লুটিয়ে পড়েছিল প্রকৃতি। নীতার সংলাপও তখন ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে মেলোড্রামার সচেতন ব্যবহারে, তার আকুলতার প্রতিধ্বনিতে।
‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবির শেষে নীতার বাঁচতে চাওয়ার আর্তিতে কেঁপে ওঠে পাহাড়, ঝর্না, ঝাউবন।
‘দেবী’-র শেষ দৃশ্যে যেন তেমনই এক প্রতিধ্বনি; তবে শব্দ নয়, আলোর স্তরে। এত দিন ধরে বাহ্যিক নির্মাণ-প্রতিনির্মাণের চাপে সঙ্কটাপন্ন হতে হতে দয়া তখন খাদের কিনারে। উমা এসেছে তাকে ‘বাঁচাতে’। ঘরে শুধু আলো আর আলো। সেই ছটায় প্রায় সাদা হয়ে গিয়েছে ঘরের অন্দর। উমা পারবে দয়াকে উদ্ধার করতে? দয়া মুহূর্তে নস্যাৎ করে দেয় সেই সম্ভাবনা। কালীকিঙ্কর বা উমাপ্রসাদ- কোনও পুরুষ অভিভাবকের নির্মাণেই সে আর নিজের আত্মপরিচয়কে আটকে রাখে না। যে প্রকৃতির সঙ্গে মাতৃশক্তির নিবিড় সংযোগ, যে প্রকৃতি কেঁদেছে বেহুলা, বা নীতার মতো অভাগীদের পরিণামে, সেই প্রকৃতিতেই মিলিয়ে যায় সে।
মা কালীর ভর দয়াময়ী, আবার দয়াময়ী কালীর আর এক নামও বটে। মাতৃভক্ত রামপ্রসাদের গানের কথায়- ‘করুণাময়ী কে বলে তোরে দয়াময়ী,/ কারও দুগ্ধেতে বাতাসা গো তারা,/ আমার এমনি দশা, শাকে অন্ন মেলে কই’। এই কালীও কোনও দিন তোয়াক্কা করেননি পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণার। নিজের স্বামী শিবের বুকের উপর তার পা। লোল জিহ্বা। সেই রূপেই নানা নামে পূজিত তিনি। কিন্তু দয়া, বা নীতারা আজও নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করে চলেছে পুরুষতন্ত্রের ধাঁচায়, কাঠামোয়। যখন কালীর আরাধনার ধূমধাম চলবে এক প্রান্তে, অন্য প্রান্তে হয়তো তখন কালো হওয়ায় প্রত্যাখ্যাত হবে কোনও মেয়ে, ধর্ষিত হবে কোনও কিশোরী। কারণ পুরুষদের দেখার দৃষ্টিতেই এখনও চালিত হয় গোটা দুনিয়া। তাই ৫০ বছর আগের এক ছবিতে জনৈক বৃদ্ধ জমিদারের স্বপ্ন-দৃশ্যে একটি মেয়ের অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে এখনও ঈষৎ অস্বস্তি বোধ করেন দর্শক। অন্ধকারের বুক চিরে যখন মা কালীর ত্রিনয়ন মিলে যায় দয়ার তীক্ষ্ণ চোখজোড়ায়, যা সরাসরি তৃতীয় পর্দা ভেঙে অপলক তাকিয়ে থাকে দর্শকের দিকে, মনে হতে থাকে কী যেন খসে পড়ছে এক লহমায়। ভেঙে পড়ছে অনেকগুলি দেওয়াল। বুক কাঁপে। প্রত্যক্ষ এক রাজনৈতিক আঘাত হানে এই মর্মভেদী দৃষ্টি। অর্ধ শতাব্দী পরেও থাকুক বুকের এই মৃদু আন্দোলনটুকুই।