‘শ্যামাধন কি সবাই পায়?’ এই প্রশ্ন তো সব সাধকেরই। শক্তিরঙ্গ বঙ্গদেশ শ্যামাসাধনার এক পুণ্যক্ষেত্র। এমনটাই বিশ্বাস করেন ভারতব্যাপী শক্তিসাধকরা। আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, এই ভূমিতে বহু সাধকই কালীসাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন এবং তাঁদের আরাধ্যার দেখাও পেয়েছিলেন। রামপ্রসাদ সেন থেকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব, সর্বানন্দ দেব থেকে বামাখ্যাপা— এই অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এঁদের প্রত্যকের জীবনেই রয়ছে অগণিত অলৌকিক ঘটনা। বাংলার এই কালীসাধকদের মধ্যে তিন জনের দেহত্যাগের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অতিলৌকিক কাহিনি। এঁরা যথাক্রমে রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য এবং বামাচরণ চট্টোপাধ্যায় বা বামাখ্যাপা।
কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেনের জন্ম আনুমানিক ১৭১৮ থেকে ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে। তাঁর প্রয়াণ আনুমানিক ১৭৭৫ সালে। রামপ্রসাদের জীবনে অতিলৌকিক ঘটনার বহু উদাহরণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল, তাঁর বেড়া বাঁধার কাহিনি। যেখানে স্বয়ং জগদীশ্বরী তাঁর কন্যা রূপে দেখা দিয়ে তাঁকে বেড়া বাঁধতে সাহায্য করেন। কবিরঞ্জন তাঁর গানেও এই কাহিনির উল্লেখ করেছেন।
রামপ্রসাদের জীবনের অন্তিম লগ্নও কম কৌতূহলোদ্দীপক নয়। রামপ্রসাদের অন্যতম জীবনীকার দয়ালচন্দ্র ঘোষ তাঁর ‘প্রসাদ প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন সেই ঘটনার। দয়ালচন্দ্রের মতে, রামপ্রসাদ বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর ঐহিক লীলা শেষ হয়ে এসেছে। জীবনান্তের পূর্ব লক্ষণ বুঝতে পেরে তিনি বিশেষ পূজা করেন তাঁর আরাধ্যার। মৃন্ময়ীর মূর্তি বিসর্জনের কালে তিনি তাঁর নিজের লেখা গান গাইতে গাইতে হালিশহরের ভাগীরথী তীরে উপস্থিত হন। গঙ্গায় অর্ধনাভি নিমজ্জিত রেখে দণ্ডায়মান অবস্থাতেই ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। কথিত আছে প্রয়াণ-মুহূর্তে তিনি যে পদটি উচ্চারণ করছিলেন, সেটি এই— ‘মা গো, ও মা আমার দফা হল রফা, দক্ষিণা হয়েছে’। দয়ালচন্দ্রের মতে কবিরঞ্জনের মৃত্যু রোগে হয়নি। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ‘ভাব’-এ। (সঙ্গের ছবিটি হালিশহরে অবস্থিত রামপ্রসাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তির।)
বর্ধমানের মাতৃসাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে। কমলাকান্ত বর্ধমান রাজ তেজচন্দ্রের গুরু এবং সভাকবি ছিলেন। তেজচন্দ্র বর্ধমানের কোটালহাটে কমলাকান্তের জন্য কালীমন্দির তৈরি করে দেন। রাজা তেজচন্দ্র বেশ কয়েক বার কমলাকান্তের ঐশী শক্তির পরীক্ষা নিয়েছিলেন। কথিত আছে, এই সব পরীক্ষা তিনি তাঁর এক মন্ত্রী বা দেওয়ানের পরামর্শেই নিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সেই দেওয়ান রাজসভায় কমলাকান্তের প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে ঈর্ষান্বিত হয়েই নাকি রাজাকে কুমন্ত্রণা দিতে থাকেন।
তেজচন্দ্রের অনুরোধে কমলাকান্ত তাঁকে অমাবস্যা তিথিতে পূর্ণচন্দ্র দর্শন করিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। তবে তন্ত্রমার্গে ‘অমাবস্যায় চাঁদের উদয়’ এক প্রতীকী ব্যঞ্জনাও বহন করে। তা এক বিশেষ উপলব্ধির কথা বলে। এমনও হতে পারে, তন্ত্রাভিলাষী রাজাকে তাঁর গুরু হিসেবে কমলাকান্ত হয়তো সেই উপলব্ধির স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
সেই দেওয়ানের পরামর্শে রাজা কমলাকান্তকে নির্দেশ দেন, মা কালী মৃণ্ময়ী মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর সেই মূর্তি সত্যিই জীবন্ত কি না তার প্রমাণ দিতে হবে। রাজাকে কমলাকান্ত জানান, এতে ঘোরতর অমঙ্গল ঘটবে। কিন্তু রাজা তাঁর আদেশ কিছুতেই ফিরিয়ে না নিলে বাধ্য হয়ে কমলাকান্ত মায়ের মূর্তির পায়ে বেলগাছের কাঁটা বিঁধিয়ে রক্তপাত ঘটান।
কমলাকান্ত ভাবতে শুরু করেন, এই ঘটনার ফলে তিনি সাধনভ্রষ্ট হয়েছেন। মায়ের অপার কৃপা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ক্রমে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৮২০ বা মতান্তরে ১৮২১ সাল নাগাদ তাঁর দেহান্ত হয়। দেহত্যাগ কালে কমলাকান্ত চেয়েছিলেন তাঁর গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটুক। কিন্তু বর্ধমানের যে গ্রামে তিনি দেহ রাখেন, তার ধারেকাছেও গঙ্গা ছিল না। সাধকের অন্তিম ইচ্ছা পূর্ণ করতেই যেন তাঁর আরাধ্যা সক্রিয় হন। তাঁর সেই মন্দির প্রাঙ্গণের মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে গঙ্গার জল। পরবর্তী কালে সেই স্থানে একটি কুয়ো তৈরি করে দেওয়া হয়। সেই কুয়োর জলে আজও কালীপূজার সময়ে দেবীর ভোগ রান্না করা হয়।
বাংলার শক্তিসাধনার পরম্পরায় বামাচরণ চট্টোপাধ্যায় বা বামাখ্যাপা এক আশ্চর্য চরিত্র। সহস্র বছরেরও বেশি প্রাচীন শক্তিক্ষেত্র তারাপীঠের কাছে আটলা গ্রামে বামাচরণ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৭ সালে। তারাসাধক বামাচরণ তন্ত্রধর্মে বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত বশিষ্ঠ ধারার সাধক ছিলেন। সারা জীবন ধরে অজস্র অতিলৌকিক ঘটনার কেন্দ্রে রয়েছেন বামদেব। ১৯১১ সালে এই সাধকের প্রয়াণ ঘটে। তাঁর প্রয়াণকে ঘিরে রয়েছে এক রোমাঞ্চকর ঘটনা।
বামদেবের মহাপ্রয়াণ ঘটে ১৯১১ সালের ১৮ জুলাই। তিনি সে সময় পুরোপুরি শ্মশানবাসী। প্রয়াণের কয়েক দিন আগে এক ঘোর বর্ষার সন্ধ্যায় তারাপীঠের সেই মহাশ্মশানে নাকি আবির্ভাব ঘটে এক আশ্চর্য পুরুষের। তিনি ঘোর কৃষ্ণকায়, দীর্ঘকায় ও শীর্ণ। তাঁর মাথায় অবিন্যস্ত কেশ, চোখ বর্তুলাকার ও রক্তাভ। এই ব্যক্তি শ্মশানে বাস করতে শুরু করলেন। তিনি গলিত শবের মাংস আহার করেন। যা দেখে বামদেবের ভক্তকুল রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলেন।
এক দিন বামদেব তাঁর আসন শিমুলতলায় বসে আছেন, সেই সময় সেই লোকটি শব-মাংস ভক্ষণ করতে করতে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। বামদেব তাঁকে দেখে গালিগালাজ করতে লাগলেন।। তিনিও পাল্টা গালিগালাজ করলেন। এর পর থেকেই বামদেব খানিক নিরাসক্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর বার বার সমাধি হতে লাগল। কথাবার্তাও কমে এল। সেই আগন্তুক কিন্তু রোজই হানা দিতে থাকলেন বামদেবের আসনের কাছে। তাঁর অট্টহাসিতে কেঁপে উঠতে শুরু করত শ্মশান। (সঙ্গের ছবিটি তারাপীঠ মহাশ্মশানের।)
এক দিন প্রবল বৃষ্টির মধ্যে সেই আগন্তুক বামদেবের কুটিরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বামদেবের সঙ্গে অনেক তখন শিষ্য উপস্থিত। কিন্তু তিনি সকলকে উপেক্ষা করে বামদেবের উদ্দেশে বলে উঠলেন, “আর কেন?” বামদেবও গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে উত্তরে বললেন, “হুঁ।” বাবার শিষ্য নগেন্দ্রনাথ বাগচি সেই আগন্তুককে তখনকার মতো তাড়িয়ে দিলেন।
পর দিন বামদেব নগেন্দ্রনাথকে শ্মশানের এক বিশেষ স্থান দেখিয়ে সেখানে তাঁর অন্তিম সংস্কার করার নির্দেশ দিলেন। তার পর সমাধিস্থ হলেন। সন্ধের দিকে তাঁর সমাধি ভঙ্গ হল। তিনি তারানাম করে আবার সমাধিস্থ হলেন। ক্রমে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে লাগল। শিষ্যরা কবিরাজ ডাকতে রামপুরহাট গেলেন। এমন সময়ে সেই আগন্তুক আবার এসে দাঁড়ালেন সেখানে। তিনি জানালেন, বামদেব সব চিকিৎসার ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছেন। ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে তিনি নিরাকারে লীন হয়েছেন। (সঙ্গের ছবিটি তারাপীঠে বামদেবের মন্দিরের।)
এর পর বামদেবের অন্তিম সংস্কারের বন্দোবস্ত শুরু হল। সংস্কারের স্থান নিয়ে শিষ্যদের মধ্যে মতান্তর দেখা দিলে সেই আগন্তুক সেখানে আবির্ভূত হয়ে এক বিশেষ স্থান দেখিয়ে দিলেন। বামদেবের সমাধিকার্য যত ক্ষণ চলছিল, তত ক্ষণ সেই আগন্তুক সেখানে পুষ্প বর্ষণ করছিলেন। সমাধিকার্য শেষ হতেই তিনি ভূমিষ্ঠ হয়ে বামদেবকে প্রণাম করে প্রবল অট্টহাস্য করতে করতে শ্মশান সংলগ্ন অরণ্যে প্রবেশ করলেন। আর কোনও দিন তাঁকে দেখতে পাওয়া যায়নি।
কে ছিলেন সেই আগন্তুক? তন্ত্রজ্ঞরা বলেন, তিনি কালভৈরব। তিনি স্বয়ং শিবের এক রুদ্র রূপ। বামদেবও তাঁর ভক্তদের কাছে ‘ভৈরব’ হিসেবে পূজিত হন আজও। তা হলে কি স্বয়ং মহাকালই এসেছিলেন তাঁর একান্ত ভক্তকে নিয়ে যেতে? প্রহেলিকায় আচ্ছন্ন এর উত্তর। (সঙ্গের ছবিটি নেপালের কাঠমান্ডুর কাল ভৈরবের।)