Kali Puja 2021

‘দেখবে জগৎ নয়ন মেলি’

Advertisement

গৌতম মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২১ ০৯:০৩
Share:

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ (১৮৮২) ছিল বাংলার বিপ্লবী যুবমানসের আদর্শের উৎস। বাংলায় সংগ্রামী জাতীয়তাবাদ যে পথে চালিত হয়, গড়ে ওঠে নানা গুপ্ত সমিতি, তার পিছনে এই উপন্যাসের প্রভাব অনস্বীকার্য। বঙ্কিম-বর্ণিত কালী হয়ে উঠেছিল সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক। জমিদার মহেন্দ্রকে দেবালয়ের কালীমূর্তির সামনে এনে সত্যেন্দ্র ব্রহ্মচারী বলেন, “দেখ, মা যা হইয়াছেন।” মায়ের উগ্রচণ্ডী মূর্তি ধারণের কারণ ব্যাখ্যা করেন, “কালী— অন্ধকার সমাচ্ছন্না কালিমাময়ী। হৃতসর্বস্বা, এই জন্য নগ্নিকা। আজি দেশে সর্বত্রই শ্মশান— তাই মা কঙ্কালমালিনী।” এর পর জ্যোতির্ময়ী দশভুজা দুর্গার সামনে নিয়ে গিয়ে বলেন, “এই মা যা হইবেন। দশ ভুজ দশ দিকে প্রসারিত— তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত, পদতলে শত্রু বিমর্দিত...।” আনন্দমঠ-এর কালী বা দুর্গা ভারতমাতার দুই বিপ্রতীপ অবস্থানের কল্পিত রূপ। কালী সমকালীন শোষণের ইঙ্গিতবাহী, দুর্গা গর্বিতা বিজয়লক্ষ্মী।

Advertisement

সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা (১৯৬৮) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “রাজনারায়ণ বসুর সঞ্জীবনী সভা (১৮৭৬) নামে প্রতিষ্ঠিত গুপ্ত সমিতিকে বাংলাদেশে চরমপন্থী রাজনীতির সূত্রপাত বলা চলে।... জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ-ও তার সদস্য ছিলেন।” এর বিস্তারিত ইতিহাস নিয়ে প্রথাগত ইতিহাস চর্চাকারীরা নীরব, তবে প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনী-র প্রথম খণ্ডে লিখেছেন, এই গুপ্ত সভার আয়ুষ্কাল মোটামুটি ছ’মাস, পৌষ ১২৮৩ থেকে জ্যৈষ্ঠ ১২৮৪ পর্যন্ত। সঞ্জীবনী সভার কালীভক্তির বিবরণ মেলে জ্যোতিস্মৃতি-তে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লেখেন, “সভার অধ্যক্ষ ছিলেন বৃদ্ধ রাজনারায়ণ বসু। কিশোর রবীন্দ্রনাথও এই সভার সভ্য ছিলেন।... যেদিন নূতন কোন সভ্য এই সভায় দীক্ষিত হইতেন সেদিন অধ্যক্ষ মহাশয় লাল পট্টবস্ত্র পরিয়া সভায় আসিতেন। সভার নিয়মাবলী অনেকই ছিল, তাহার মধ্যে প্রধান ছিল মন্ত্রগুপ্তি।” মন্ত্রগুপ্তির শপথ নেওয়া হত কালীর সামনে।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইয়ং বেঙ্গল-এর সভ্যরা পশ্চিমি শিক্ষার গর্বে কালীকে ‘গুড মর্নিং ম্যাডাম’ বলে পরিহাস করেছিল। কিন্তু এই শতকেরই দ্বিতীয়ার্ধে রাজনারায়ণ বসুর মতো অনেকেই যৌবনের ভ্রম সংশোধন করে কালীর উপাসনায় মন দেন। সে কারণেই অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কালীর সামনে শপথ গ্রহণের রীতি চালু হয়েছিল।

Advertisement

বাংলায় চরমপন্থী রাজনীতির সঙ্ঘবদ্ধ প্রয়াসের সর্বোত্তম নিদর্শন অনুশীলন সমিতি। ১৯০২-এ সতীশচন্দ্র বসু এই সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন, অন্য দুই প্রধান সংগঠক প্রমথনাথ মিত্র ও সরলা দেবী। প্রথম পাঁচ বছর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনও যুক্ত ছিলেন। অরবিন্দ ঘোষের সমিতিতে যোগদানের ফলে বাংলা এক তীব্র বিপ্লবী উন্মাদনার সূতিকাগৃহে পরিণত হয়। সমকালীন অবস্থার ছবি মেলে জাতীয়তাবাদী নেতা অশ্বিনীকুমার দত্ত রচিত গানে, “আয় না হেথা নাচবি শ্যামা/ শব হব শিব পা ছুঁয়ে মা/ জগৎ জুড়ে বাজবে দামামা, দেখবে জগৎ নয়ন মেলি।”

ভারতের বিপ্লবী চেতনার বিকাশে অরবিন্দ রচিত ভবানী মন্দির, বঙ্কিমের আনন্দমঠ-এর অনুশীলন তত্ত্বের পরিপূরক। অরবিন্দ লেখেন: “আমরা শক্তিকে ত্যাগ করিয়াছি, শক্তিও আমাদের ত্যাগ করিয়াছেন। আমাদের হৃদয়ে, মস্তিষ্কে, বাহুতে মা নাই।... যা আমাদের সর্বাগ্রে অর্জন করা উচিত তা শক্তি— শারীরিক শক্তি, মানসিক শক্তি, নৈতিক শক্তি এবং সবার উপরে সকল জিনিসের অন্তহীন ও অবিনশ্বর উৎস, আধ্যাত্মিক শক্তি। যদি শক্তি পাই তবে অন্য সব জিনিস সহজে আপনিই আসিবে।... যে শক্তিরূপিণী মায়ের পূজা করিতেন রামকৃষ্ণ... তিনি কালী, ভবানী।” হিন্দু ধর্মের গর্ভগৃহ থেকেই অনুশীলন সমিতির সদস্যরা শক্তি সঞ্চয়ে মনোনিবেশ করেন। শক্তিরূপিণী কালী ভক্তের অন্তরে মহাজাগরণ ঘটাবেন, এই বিশ্বাসে স্থিতধী ছিলেন তাঁরা। অনুশীলন সমিতির ব্যাপ্তির পিছনে ছিল অরবিন্দের ভবানী মন্দির-এর আহ্বান। তিনি বলেছিলেন, “আমরা এমন কয়েকজন লোক লইয়া একটি মূল কেন্দ্র গড়িতে চাই যাহাদের মধ্যে শক্তি চরম পূর্ণতা লাভ করিবে,... বুদ্ধিতে ও হৃদয়ে অগ্নিময়ী ভবানীকে ধারণ করিয়া তাহারা আমাদের দেশের দূর দূরান্তরে বিচরণ করিবে, সে শিখা ছড়াইয়া দিবে।” এই কারণেই বিপ্লবীরা মাতৃমূর্তির সামনে কৃচ্ছ্রসাধনের শপথ নিতেন।

বিপ্লবী নলিনীকিশোর গুহের বাংলায় বিপ্লববাদ গ্রন্থে কালীপ্রতিমার সামনে শপথের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাশের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, “পি. মিত্রের আদেশ মতে একদিন (কলিকাতায়) একবেলা হবিষ্যান্ন আহার করিয়া সংযমী থাকিয়া পরের দিন গঙ্গা স্নান করিয়া পি. মিত্রের বাড়ীতে তাঁহার নিকট হইতে দীক্ষা লইলাম।... পুলিনবাবু বলেন: ‘পি. মিত্র যে পদ্ধতিতে আমাকে দীক্ষা দিয়াছেন গুপ্ত চক্রের মধ্যে গ্রহণ করিবার পূর্বে আমিও অনুরূপ পদ্ধতিতে আমার বাসায় দীক্ষা দিতাম।’” এই ভাবে ক্ষাত্রতেজে উদ্বুদ্ধ হতে কালীর সামনে দীক্ষার প্রথা অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের স্থির সঙ্কল্পে ব্রতী করেছিল।

ইতিহাস বিভাগ, সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement